রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর রোস্তভ-অন-দন-এ গত ২৩ জুন ইয়েভগেনি প্রিগোজিনের বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর সিরিয়ায় ওয়াগনার গ্রুপের চার নেতাকে আটক করে রাশিয়ান মিলিটারি পুলিশ। পরে ফরেন পলিসি জানায়, তারা গোপন সূত্রের মাধ্যমে জানতে পেরেছে আটক ওয়াগনার গ্রুপের ওই চার নেতাকে হামেইমিম বিমানঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে এ বিষয়ে জনসমক্ষে কিছুই বলেনি রাশিয়া।
হামেইমিম বহু রাশিয়ান সৈন্য এবং ঠিকাদারদের আবাসস্থল। এটি সম্পূর্ণ রাশিয়া নিয়ন্ত্রিত এলাকা। এখান থেকে ওয়াগনার গ্রুপ দেশের বাইরে তাদের যুদ্ধের রসদ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এ ছাড়া সিরিয়ায় রুশ কার্যক্রমের কেন্দ্রও এটি।
এটি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরে রাশিয়া নিয়ন্ত্রিত দুটি বড় রানওয়ে বিশিষ্ট এলাকা; যেখানে অনায়াসে বৃহৎ আকৃতির বিমান রাখা, সেগুলোতে জ্বালানি ভরা, মেরামত এবং নিয়মিত সৈন্য পরিবহন করা সম্ভব। এখান থেকে ওয়াগনার গ্রুপের সৈন্যরা লিবিয়া, মালি, সুদান এবং মধ্য আফ্রিকার দেশগুলো—এমনকি ভেনেজুয়েলায়ও যায়। এ সময় তারা রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিমান ব্যবহার করে হামেইমিম থেকে চূড়ান্ত লক্ষ্যে রওনা হয়। ওয়াগনার গ্রুপের এই ঘাঁটিতে প্রবেশাধিকারের ঘটনাকে ক্রেমলিন কি অস্বীকার করবে? তাহলে তো প্রিগোজিনের বৈশ্বিক জগত চূর্ণ হয়ে পড়বে।
সিরিয়ার টার্টাস বন্দরে পারমাণবিক অস্ত্র সজ্জিত রণতরী রাখা এবং আফ্রিকায় চলমান বিভিন্ন অভিযানে আঘাত হানার কাজে হামেইমিম বিমানঘাঁটি গুরুত্বপূর্ণ।
অবাক করা বিষয় হলো—রাশিয়ার পুলিশ এবং ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিস ওয়াগনার গ্রুপের কার্যালয়ে অভিযান চালায় এবং এর অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলোও বন্ধ করে দেয়। হামেইমিমে অবস্থানরত ওয়াগনার নেতাদের রীতিমতো প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করে বাড়ি ফিরতে হয়েছে। বিগত বছরগুলোতে সিরিয়ায় রাশিয়ার প্রক্সি যুদ্ধে নানা চড়াই-উৎরাইয়ের পরও ওয়াগনার বাহিনী মস্কোর উদ্দেশ্য হাসিলে মূল ভূমিকা পালন করেছে। এ কারণে হঠাৎ করে প্রিগোজিন বাহিনীর পক্ষে সে অবস্থান থেকে সরে আসা সময়সাপেক্ষ বিষয়।
বর্তমানে সিরিয়ায় ওয়াগনার গ্রুপের ১ থেকে ২ হাজার সৈন্য রয়েছে। এই সৈন্যরা সিরিয়ার কেন্দ্রে অবস্থান করে প্রায় ১০ হাজার ব্যক্তিগত সামরিক ঠিকাদারদের সঙ্গে তেল, গ্যাস এবং ফসফেটসংক্রান্ত পরিকাঠামোতে নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব পালন করছে।
ওয়াগনার গ্রুপ সিরিয়ার ব্যক্তিগত সামরিক ঠিকাদারদের এসব পরিকাঠামো থেকে পাওয়া লভ্যাংশ থেকে অর্থ দিয়ে থাকে। এসব কোম্পানির বেশিরভাগ পরিচালনা করেন ‘জেনাডি টিমচেঙ্কো’ এবং মালিকানাও তার। তিনি প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কাছের বন্ধু। বিশেষজ্ঞরা বলেন, তিনি পুতিনের ধন-সম্পদের তত্ত্বাবধান করে থাকেন।
রাশিয়া জ্বালানি ও পণ্যদ্রব্য রপ্তানিতে বিশ্বে প্রথম। সিরিয়ায় প্রাকৃতিক উৎস থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ রাশিয়ার কাছে নিতান্তই তুচ্ছ। যদিও বিদেশি মুদ্রা অর্জনের কথা বিবেচনায় আনলে সিরিয়ার জন্য এটি একান্ত জরুরি বিষয়। যুদ্ধপরবর্তী চিত্র হিসেবে কোনোভাবেই রাশিয়া দামেস্কের সঙ্গে পূর্বে সাধিত ভূ-কৌশলগত চুক্তির দোহাই দিয়ে এসব করতে পারে না।
এসব চুক্তিতে রয়েছে—রাশিয়া হামেইমিমকে আফ্রিকার প্রজেক্ট পাওয়ারের লঞ্চিং প্যাড হিসেবে ব্যবহার এবং পারমাণবিক অস্ত্রসজ্জিত রণতরী নোঙর করার কাজে সিরিয়ার টার্টাস বন্দর ব্যবহার করতে পারবে। ১৯৭০ সালের পর থেকে এটা মস্কোর শ্রেষ্ঠ ভূ-কৌশলগত অর্জনের একটি; যেটি ন্যাটোর দক্ষিণ ফ্ল্যাঙ্কের বিরুদ্ধে রাশিয়াকে পারমাণবিক প্রতিরোধ তৈরিতে সহায়তা করবে।
ওয়াগনার নেতারা ব্যক্তিগতভাবে কী সিদ্ধান্ত নেন সেটি বিবেচনায় না এনে এটা বলা যায়, দামেস্কের ওপর রাশিয়ার যে কর্তৃত্ব বা দাবি রয়েছে তার অর্থ হলো—প্রিগোজিনের কাছে সিরিয়ার ব্যক্তিগত সামরিক ঠিকাদার বাহিনীর আনুগত্য নিশ্চিত করা। এসব বাহিনীকে দেওয়া সুযোগ-সুবিধা কমালে রাশিয়াকে মূল প্রতিপক্ষ ইরানের কাছে হারতে হবে। কেননা ইরান এসব সৈন্যদের অস্ত্র ও আরও ভালো ভাতা দেওয়ার প্রস্তাব দিতে পারে।
প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদকে সমর্থন দেওয়ার পরও ২০১৭ সাল থেকে সিরিয়া নিয়ে রাশিয়া ও ইরান মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ২০১৮ সালে তাদের দুই দেশের ভাড়াটে যোদ্ধাদের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ বাধে। দুই দেশের প্রক্সি যোদ্ধাদের ভেতর সিরিয়ার ফসফেটের পরিকাঠামোর রিজার্ভ ও অন্যান্য সম্পদ নিয়ে যুদ্ধ হয়।
নিজেদের অবস্থান রক্ষার জন্য লড়াই মস্কোর জন্য বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে উঠছে। বিশেষ করে সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনা খুবই কমে এসেছে। সিরিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা সরানোর ব্যাপারে পুতিন বেশ কয়েক বছর ধরেই আসাদের সঙ্গে কথা বলে চলেছেন। এটা হলে রাশিয়ান কোম্পানিগুলো সিরিয়া থেকে আরও অর্থ উপার্জন করতে পারত। তবে পুতিনের চেষ্টা ও পশ্চিমা উন্নয়নের টোটকা সমাধান আনতে ব্যর্থ হয়েছে।
২০২১ সাল নাগাদ রাশিয়া বিভিন্ন দেশে প্রক্সি যুদ্ধে সহায়তা বন্ধ করায় অনেক জায়গাতেই যোদ্ধারা বেশি বেতনের আশায় ইরানের দুয়ারে কড়া নেড়েছে। ২০২২ সালে ইউক্রেনে মস্কোর অভিযান শুরু হওয়ার পর এই প্রক্রিয়া আরও ত্বরাণ্বিত হয়েছে।
রাশিয়া আসন্ন সময়ে এমন সহযোগিতা নাও দিতে পারে এবং সে জায়গায় শেষ অস্ত্র হিসেবে ইরানের আগমন ঘটতে পারে। বিগত কয়েক মাসে আসাদ প্রশাসন এবং আরব লিগের দেশগুলো মধ্যে এ নিয়ে একধরনের স্বাভাবিকতা দেখা গেছে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও জর্ডানও প্রয়োজনে ইরানের সাহায্য নেবে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
সিরিয়াজুড়ে রাশিয়ার কঙ্কালসার বাণিজ্যের মূল উপাদান হিসেবে বিভিন্ন তেল ও গ্যাসক্ষেত্রে ওয়াগনার যোদ্ধা এবং তাদের ঠিকাদারদের নেটওয়ার্ক এখনো টিকে আছে। এগুলো স্বাধীন ও টেকসই লাভের মুনাফাপ্রবাহ মেনে চলে। বলা বাহুল্য এগুলো সিরিয়ায় ইরানের যে কোনো কার্যক্রমের মুখাপেক্ষী।
যে কোনো উপায়ে যদি পুতিন সরকারের একটি ভিত পড়ে যায়, তাহলে ওয়াগনারের সঙ্গে সিরিয়ায় লড়াই করা বাহিনী ও অন্যান্য রুশ বাহিনীর অবস্থানও পরিবর্তন হতে পারে। এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে।
উত্তর-পূর্ব সিরিয়ায় ২০২১ সালের এপ্রিলে আদিবাসী নিয়ন্ত্রিত একটি সামরিক গোষ্ঠী যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত কুর্দিস বাহিনীর হামলা থেকে বাঁচার জন্য আবেদন করলে তা এড়িয়ে যায় রাশিয়ানরা। যুদ্ধে হারার পর ঘরছাড়া অবস্থায় আদিবাসী যোদ্ধারা ইরানের জন্য তাদের দুয়ার খুলে দেয়। ইরানের মাধ্যমে তারা নতুন ভারী অস্ত্রশস্ত্র এবং বেতন পান।
দক্ষিণ সিরিয়ায় সিরিয়ান আর্মির অষ্টম ব্রিগেড রাশিয়ার সবচেয়ে বিশ্বস্ত ইউনিট ছিল। যদিও ২০২১ সালের শেষ দিকে মস্কো এই দলটির ওপর হতাশ হয়ে পড়ে। ইসলামিক স্টেটের সঙ্গে লড়াইয়ে যথেষ্ট সংখ্যক সৈন্য পাঠাতে ব্যর্থ হওয়ায় দলটির সৈন্যদের বেতন অর্ধেক করে দেয় মস্কো। ২০২২ সালে তারা দলটির সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে অষ্টম ব্রিগেড সিরিয়ার মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স ডিরেক্টরেটের অধীনে ইরানের অন্যতম ক্ষমতাবান ব্রিগেড হিসেবে কাজ করছে। এই ব্রিগেডটি হিজবুল্লাহ ও অন্যান্য গ্রুপের মাধ্যমে প্রাদেশিক মাদক পরিবহন ও অন্যান্য অপরাধ দমনে সফলভাবে কাজ করছে।
মূল লেখা : জেরেমি হডজ, জোমিয়া সেন্টারে নন-স্পেস স্টেট বিষয়ক তদন্তকারী।
ভাষান্তর : সরকার জারিফ।
মন্তব্য করুন