সিরাজুল আলম খান কিছুকালের জন্য রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। ষাটের দশকে ছাত্রলীগের র্যাডিক্যাল ধারার নেতা, মুক্তিযুদ্ধকালীন মুক্তিবাহিনীর বাইরে মুজিববাহিনী গঠন এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী পর্যায়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠন করেন। এর পরে ’৭৫ সাল পরবর্তী পর্যায়ে সামরিক বাহিনীর মধ্যে নানা অঘটনের সঙ্গে তিনি এবং তার অনুসারীরা যুক্ত ছিলেন। জাসদ গঠন একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ছিল ওই সময়। জাসদ গঠন করে তিনি তার এক সময়ের দল আওয়ামী লীগ সরকারকে যথেষ্ট বিপদে ফেলেছিলেন। অসংখ্য মেধাবী তরুণ এবং ছাত্রলীগের একটি অংশকে যুক্ত করতে পেরেছিলেন তথাকথিত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে। ওই অসংখ্য তরুণকে বিপদ ও বিপথগামী করেছিলেন।
আমার ধারণা, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে প্রকৃত সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসীদের যে ব্যাপক উত্থান হচ্ছিল তা যাতে বিকশিত হতে না পারে সেজন্য তিনি বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে জাসদ গঠন করেছিলেন এবং তার দল সেই কাজটি করেছিল। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে তিনি প্রকৃত সমাজতন্ত্রী প্রগতিশীল বামধারার যথেষ্ট ক্ষতি করেছেন। অন্যদিকে দেশের জনগণের নিত্যদিনের প্রকৃত সংকট এবং পররাষ্ট্রনীতির জনসমালোচনার যে ধারাটি চলছিল তাকে তিনি ভিন্ন দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন।
কিন্তু সিরাজুল আলম খানের ভূমিকা বড় করে দেখতে হবে একটি কারণে। স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগের পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসনের যে দাবি তার দলের প্রধান নেতা থেকে অন্যান্য নেতারা করেছিলেন মিট-মীমাংসার জন্য- তিনি তার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। সরাসরি স্বাধীনতার ডাক দেওয়ার জন্য তিনি তার দলের নেতৃত্বের ওপরে প্রধানত তরুণদের সংগঠিত করে একটি চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসনের দাবি যারা করেছিলেন তাদের বিপরীতে একটি স্রোত তৈরির চেষ্টায়রত ছিলেন। তবে তাকে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান পুরুষ কোনোক্রমেই বলা যাবে না।
সিরাজুল আলম খানকে সবাই রহস্যপুরুষ বলে থাকেন। কারণ তিনি পর্দার অন্তরালে থাকতেই ভালোবাসতেন। অনেকেই আবার তাকে প্রতিনায়ক বা এন্টি হিরো বলে মনে করেন।
রাজনীতির ইতিহাসে প্রতিনায়কেরা প্রকৃত নায়কের বিপরীতে কিছু মানুষ জড়ো করতে পারেন বটে, কিন্তু এটাও সত্য হিরোর যত গুণ এন্টি হিরোর সেসব গুণ থাকে না।
রাজ-রাজাদের সময় রাসপুতিনও যেমন থাকেন, তেমনি ম্যাকিয়াভ্যালি বা চাণক্যরাও থাকেন। ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তনে তারা অন্যতম ভূমিকা পালন করেছেন। সিরাজুল আলম খান কোনোক্রমেই রাসপুতিন ছিলেন না, তবে চাণক্য বা ম্যাকিয়াভ্যালির মতো অপরিহার্য হয়ে উঠতে পারেননি কখনোই। সম্ভবত তার সেই মেধা ছিল না। তারপরও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তার নাম চিরদিন মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।
আমীর খসরু : গবেষক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
মন্তব্য করুন