কেবল এপ্রিল মাস, বছরের আরও সময় বাকি রয়েছে; কিন্তু আমরা এরই মধ্যে বছরের অন্যতম একটি ভালো ছবি পেয়ে গেছি, যা ফটো অব দ্য ইয়ার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হতে পারে। ১২ এপ্রিল জার্মান পুলিশ প্যালেস্টাইনের প্রতি সংহতি জানিয়ে আহ্বান করা সমাবেশ বন্ধ করে দেয়, যা বার্লিনে অনুষ্ঠিত হতে চলেছিল এবং সম্মেলনের সঙ্গে জড়িত কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ছিলেন উদি রাজ, যিনি একজন ধর্মপ্রাণ ইহুদি। ঘটনার ছবি এবং ভিডিওগুলোতে দেখা যায়, একজন পুলিশ সদস্য হাসিখুশি মনে আগ্রাসন চালাচ্ছেন। এ চিত্র ১৯৩০-এর দশকে তাদের পূর্বপুরুষদের কথাই মনে করিয়ে দেয়, যখন তারা একজন ইহুদিকে টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে গিয়েছিল।
জার্মানিতে ফিলিস্তিনে যুদ্ধের বিরুদ্ধে চলমান সংগ্রামে যারা ঝাঁপিয়ে পড়েছেন তাদের অনেকেই ইহুদি। প্যালেস্টাইন কংগ্রেস নিজেই বার্লিনভিত্তিক সংগঠন (মধ্যপ্রাচ্যে ন্যায়বিচারের জন্য ইহুদি ভয়েস) এবং প্যান-ইউরোপীয় রাজনৈতিক আন্দোলন এবং পার্টি DiEM25-এর যৌথ উদ্যোগ, যার শীর্ষ ব্যক্তি হলেন ইয়ানিস ভারোফাকিস। তবুও জার্মানির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখন ভারোফাকিদের শুধু দেশেই প্রবেশ করতে নিষেধ করেছে না, এমনকি সেখানকার যে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অনলাইনে অংশগ্রহণও নিষিদ্ধ করেছে।
ভারোফাকিস এই দাবিতে সম্পূর্ণ ন্যায্য, এই নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে জার্মান সরকারের কর্তৃত্ববাদী আচারণ প্রকাশ পেয়েছে। জার্মানের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, এমনকি গ্রিনস এবং ডাই লিঙ্ক (বাম)-সহ এই পদক্ষেপকে সমর্থন করেছে। একই ধরনের ঘটনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ঘটছে, উদাহরণস্বরূপ, হোবার্ট এবং উইলিয়াম স্মিথ কলেজের কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি রাজনৈতিক তাত্ত্বিক জোডি ডিনকে ছুটিতে পাঠিয়েছেন, যার অপরাধ হিসেবে বলা হয়েছে তিনি ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণকে একটি প্রবন্ধে মুক্তির সম্ভাবনা হিসেবে অভিহিত করেছেন।
ভারোফাকিস প্যালেস্টাইন কংগ্রেসে ইহুদিবিরোধী বক্তৃতা দিয়ে থাকতে পারেন— এমন শঙ্কা দূর করতে, তার মন্তব্য কলামটি পড়তে পারেন। নিবন্ধটিতে দ্ব্যর্থহীনভাবে যে কোনো ধরনের ইহুদি-বিদ্বেষের নিন্দা করা হয়েছে এবং দাবি করা হয়েছে যে যুদ্ধে উভয়পক্ষের জন্য একই নীতি প্রয়োগ করা প্রয়োজন।
১৩ এপ্রিল সিএনএন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যেখানে বলা হয়েছে, ‘শতশত ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারী ফিলিস্তিনের একটি গ্রাম ঘিরে ফেলে এবং অধিকৃত পশ্চিম তীরের বাসিন্দাদের ওপর আক্রমণ করে। অভিযোগ ছিল, ইসরায়েলের একটি পরিবারের একটি ছেলে নিখোঁজ।’ এই আক্রমণগুলোকে বলা হয় মব লিঞ্চিং। সাধারণত পুলিশি এসব বিষয় তদন্ত থেকে নিজেদের অনেক দূরে সরিয়ে রাখে। ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী কেবল সতর্ক বার্তা দিয়ে তাদের দায় এড়িয়ে গেছে। একজন ফিলিস্তিনি ছেলে নিখোঁজ হওয়ার পর যদি শত শত ফিলিস্তিনি ইসরায়েলি বসতিতে হামলা চালাত তাহলে আলোকিত পশ্চিমের প্রতিক্রিয়া কেমন হতো তা কেউ কল্পনা করতে পারেন।
অথবা অন্য একটি ক্ষেত্রে বিবেচনা করুন; ১৮ জানুয়ারি, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ধারণা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ইসরায়েল বর্তমানে তার দখলকৃত সমগ্র অঞ্চলকে নিয়ন্ত্রণ করবে। তার বক্তব্য, ‘আমি স্পষ্ট করছি, ইসরায়েল নদী থেকে সমুদ্র পর্যন্ত পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণ করবে’ নেতানিয়াহুর ‘নদী থেকে সমুদ্র পর্যন্ত’ শব্দ ব্যবহারে স্পষ্ট যে ফিলিস্তিন বলে বিশ্বে কোনো রাষ্ট্র তারা রাখতে চাইছে না। ফিলিস্তিনিরা যখন মুক্ত প্যালেস্টাইনের দাবিতে একই শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেছিল (যেমন জনপ্রিয় স্লোগানে : ‘নদী থেকে সমুদ্র পর্যন্ত, প্যালেস্টাইন স্বাধীন হবে’), পশ্চিমা দেশের লোকেরা তখন নির্লজ্জভাবে যুক্তি দিয়েছিল, তারা ইসরায়েলের সমস্ত ইহুদিদের হত্যার জন্য এ স্লোগান দিচ্ছে।
ফিলিস্তিনিরা যখন এ ধরনের শব্দ বা বাক্য ব্যবহার করে তখন সেটিকে গণহত্যার আগাম বার্তা হিসেবে নিন্দা করা হয়। কিন্তু যখন একই বাক্য নেতানিয়াহু ব্যবহার করে তখন কেউ কিছুই বলছে না। এমন দ্বিচারিতা শুধু পশ্চিমাদের জন্যই মানায়। ‘নদী থেকে সমুদ্র পর্যন্ত’ বাক্যটি ইসরায়েল আসলে কী করছে এবং করার পরিকল্পনা করছে তা আমাদের সামনে স্পষ্ট করে তুলে ধরে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নিজেই এটিকে অশ্লীলতায় পরিণত করেছেন।
২ এপ্রিল নেতানিয়াহুর বাহিনী গাজায় বিমান হামলা করে সাতজন ত্রাণকর্মীকে হত্যা করে। সে সময় নেতানিয়াহু এটিকে ‘আমাদের বাহিনীর অনিচ্ছাকৃতভাবে নিরপরাধ মানুষকে আঘাত করার একটি দুঃখজনক ঘটনা’ হিসেবে অভিহিত করেন। তাহলে, ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি শিশুর মৃত্যুকে তিনি কীভাবে বর্ণনা করবেন?
তাসের ঘর পড়ে যাচ্ছে। অনেক কিছুই এখন পরিষ্কার হয়ে উঠছে। আগে ইসরায়েল অন্তত দুটি নিয়ম অনুসরণ করার ভান করেছিল : এক. ইসরায়েল হামাসের ওপর আক্রমণ করে সাধারণ ফিলিস্তিনি তাদের লক্ষ্য নয়। দুই, তারা ফিলিস্তিনের সাধারণ নাগরিকের বিরোধী নয়। তবে ইদানীং এই পার্থক্যগুলো আর নেই। নেতানিয়াহু এক সাক্ষাৎকারে খোলাখুলিভাবে বলেছেন যেখানে ইহুদি বিরোধীদের পাওয়া যাবে সেখানেই হামলা চালানো হবে। এক্ষেত্রে ইসরায়েলের বাহিনী হামাস ও ফিলিস্তিনের সাধারণ জনগণকে একই পাল্লায় দেখছে এবং তাদের ওপর আক্রমণ করছে। এতে হাজার হাজার শিশু, নারী মারা যাচ্ছে, যারা এ যুদ্ধের জন্য কোনোভাবে দায়ী নয়, এমনকি জড়িতও নয়।
ইসরায়েলের কট্টরপন্থি অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচের মতে, ৭০ শতাংশের বেশি ইসরায়েলি ‘স্বেচ্ছাসেবী অভিবাসনকে উৎসাহিত করার’ ধারণাকে সমর্থন করেন। কারণ ‘(গাজায়) দুই মিলিয়ন মানুষ ইসরায়েল রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার ইচ্ছা নিয়ে না কি প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠে ‘ (যদি এটি সত্যও হয়ে থাকে, তারপরও গাজায় নির্বিচারে ইসরায়েলি বোমা হামলাকে বৈধতা দেওয়া যাবে না।)
ইসরায়েল যে হামাসকে প্রকৃতপক্ষে নির্মূল করতে চায় না তা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। হামাসকে নিমূল করা তাদের লক্ষ্য নয়। তাদের লক্ষ্য ইস্যুকে জিইয়ে রাখা। এটি ইসরায়েলের জন্য ভালো। ইসরায়েলের আসল লক্ষ্য হলো গাজা এবং পশ্চিম তীরকে শোষণ করা এবং ধীরে ধীরে একটি বৃহত্তর ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যেটি নদী থেকে সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। যতক্ষণ না এ লক্ষ্য অর্জিত হবে ততক্ষণ পর্যন্ত ফিলিস্তিনে সামরিক হস্তক্ষেপ অব্যহত থাকবে এবং এর ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য হামাস ইস্যুকে জিইয়ে রাখা হবে।
পশ্চিমা উন্নত দেশগুলো সে সঙ্গে কিছু আরব দেশের (যেমন মিসর, জর্ডান এবং মরক্কো) সরকার মূলত ইস্রায়েলকে সমর্থন দিচ্ছে, তাদের নাগরিকরা শুধু প্রতিবাদ করতে পারে । আন্দোলনের কারণে দেশগুলোর নাগরিকদের গ্রেপ্তার ও জেলে রাখা হচ্ছে। আমি যে বিপদটি দেখছি তা হলো, যদি জনগণের অসন্তোষ বিস্ফোরিত হয় তবে তা ইহুদি-বিদ্বেষে রূপ নেবে।
স্লাভো জিজেক : ইউরোপীয় গ্র্যাজুয়েট স্কুলের দর্শনের অধ্যাপক, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্কবেক ইনস্টিটিউট ফর দ্য হিউম্যানিটিজের আন্তর্জাতিক পরিচালক।
কপিরাইট: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ২০২৪
মন্তব্য করুন