রাশিয়ায় চলতি বছরের জুন মাসে দ্রুততার সঙ্গে ওয়াগনার গ্রুপ নিয়ে ‘ঘটনাপ্রবাহ’ সমাধানের পর পশ্চিমা পণ্ডিতদের অনেকেই চীন ও ইরানেও এমন সর্বনাশা কাণ্ড ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করেছিলেন। পশ্চিম থেকে এমনও কানাঘুষা শোনা গেছে : কী হতো যদি ওয়াগনার বিদ্রোহ চীনে ঘটত? শি’র জন্য সেটা কেমন দুঃসংবাদ হতো তা নিয়েও চলেছে গবেষণা। মূলত পশ্চিমের প্রতিপক্ষ চীনের রাজনৈতিক দুর্বলতার আখ্যান তৈরি করতে এমন দুর্যোগমূলক বাস্তবতার ‘কল্পনা’ করা হয়েছে।
যা হোক, চীনে সামরিক বাহিনীর দ্বারা কোনো বিদ্রোহের সম্ভাবনা কম। চীনের মতো একদলীয় মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে এমন সব ধারণা ভুলভাবে উপস্থাপন করে এবং অবমূল্যায়ন করে। এদিকে চীনের রাজনৈতিক বাস্তবতা হলো, শি’র নেতৃত্বে এখানে রাজনৈতিক শক্তি কেন্দ্রীভূত রয়েছে এবং তা ক্রমেই দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে যাচ্ছে।
চীন কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি) দ্বারা শাসিত। ১৯৪৯ গৃহযুদ্ধ সালের ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের পর মাও সে তুংয়ের সময় থেকে এই পার্টিই ক্ষমতা ধরে রেখেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের আদলে এ একদলীয় রাষ্ট্র গড়ে তোলা হয় এবং এই প্রক্রিয়ায় চীনা আমলাতন্ত্রের ঐতিহাসিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দীক্ষাও যুক্ত হয়। এই অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষরা ছাড়া নতুনভাবে গড়ে ওঠা চীন রাষ্ট্রকে কে গড়ে তুলত। ভূমি মালিকরা একপর্যায়ে বাতিল হয়ে গেলেও আমলারা টিকে থাকে। চীনে সরকারের একাধিক স্তর ও পর্যায় রয়েছে। তবে এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো এর কোনোটিই- ‘দল’ ও ‘আমলাতন্ত্র’ থেকে পৃথক নয়। পশ্চিমাদের ক্ষেত্রে বিষয়টি উল্টো। তাদের দেশে নির্দলীয় ও স্বাধীনভাবে সরকারি প্রশাসন কাজ করে থাকে।
এই ধরনের শাসনব্যবস্থায়, সকল নীতিনির্ধারণী ক্ষমতা একটি অনুক্রমিক পদ্ধতিতে কাজ করে থাকে। যেটার পেছনে থাকে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক শক্তি। কার্যনির্বাহী কমিটির মাধ্যমে তা স্থায়ী কমিটির কাছে পৌঁছে। এই প্রক্রিয়া অন্তবর্তী আমলাতান্ত্রিকতা দ্বিগুণ হয়। এতে অনেকের কার্যভার অন্যের সঙ্গে মিলে যায়, প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে একনায়কসুলভ আচরণ কমে আসে এবং জবাবদিহিতার জায়গা তৈরি হয়। একইভাবে চীনা পিপলস লিবারেশন আর্মিও পার্টিরই একটি অংশ যা দেশের জন্য অগ্রগামী ভূমিকা পালন করে। এটি কোনো স্বাধীন প্রতিষ্ঠান নয়, যেমনটা অন্যান্য দেশে দেখা যায়। লেনিনিস্ট মতাদর্শ মেনে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকরণের মূল শর্ত অনুসরণ করে। যা একটি দ্বন্দ্বপ্রবণ বহুদলীয় বা ফেডারেল শাসনব্যবস্থা থেকে আলাদা।
চীনের এমন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিদ্রোহের সম্ভাবনা ক্ষীণ। কারণ, শাসনব্যবস্থায় শি জিং পিং’র মতাদর্শ এবং পার্টির একতাই মূল শক্তি হিসেবে কাজ করে। সরকারের একদম উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে গ্রামীণ পর্যায় পর্যন্ত অনেক রাজনৈতিক চরিত্র নিজ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কাজ করে গেলেও, চলমান শাসনব্যবস্থায় কোনো একজন উচ্চপদস্থ ব্যক্তির পক্ষে ভিন্নমত পোষণ করা খুবই কঠিন। কোনো একজনের পক্ষে পুরো পার্টির বিপক্ষে দাঁড়ানো প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। এই ব্যাপারটি মাথায় রাখলে খুব সহজেই বোঝা যায়, চীনে ওয়াগনার গ্রুপের মতো ভাড়াটে যোদ্ধার কোনো সংগঠন গড়ে ওঠা সম্ভব নয় যারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করার মতো ক্ষমতা হাসিল করতে পারে।
এটি শুধু সামরিক বাহিনীর জন্য নয় বরং চীনের প্রায় প্রত্যেকটি বিষয়ের জন্য প্রযোজ্য। রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গ পার্টির নিয়ন্ত্রণ অনুযায়ী চলে। একারণে চীন শুধু দেশে নয় বরং দেশের বাইরেও রেকর্ড কম সময়ে উচ্চগতিসম্পন্ন রেলওয়ের বিরাট অবকাঠামো তৈরি করতে পারে। চীন চাইলেই যে কোনো দেশকে অর্থ ঋণ দিতে পারে এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানার প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আমদানি ও রপ্তানির সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে। এক্ষেত্রে তারা যে দেশগুলো থেকে পণ্য কিনতে চায় অথবা যাদের সঙ্গে কোনো বাণিজ্য চায় না সেটির সিদ্ধান্তও স্বাধীনভাবে নিতে পারে। কমিউনিস্ট পার্টির পদ্ধতির সঙ্গে আমেরিকার ‘ক্ষমতার বিভক্তিমূলক’ মডেলের আকাশপাতাল পার্থক্য রয়েছে। আমেরিকার সরকার ব্যবস্থায় রাজনৈতিক চরিত্ররা হরহামেশা একে অন্যের সঙ্গে নাটকীয়ভাবে বিবাদ ও দ্বন্দ্বে লিপ্ত হন।
চীনের সরকার ব্যবস্থায় চিরস্থায়ী কলহের কোনো সুযোগ নেই। উদাহরণস্বরূপ বলা চলে, কমিউনিস্ট পার্টির কার্যনির্বাহী বোর্ড, আইনবিভাগ, ন্যাশনাল পিপল’স কংগ্রেসের ভেতরে এমন কলহ ঘটবে না কারণ আরও উচ্চপর্যায় থেকে আইনগত বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। এ কারণে পুরো সিস্টেমে কোনো ধরনের জট অথবা অচলাবস্থা তৈরি হয় না। এমতাবস্থায়, চীনে যেভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করা হয়, তাতে শি’র বিরুদ্ধে কোনো বিদ্রোহ বা ওয়াগনার গ্রুপ নিয়ে ঘোর থাকার কোনো কারণ নেই। বাস্তবতা হচ্ছে, চীনের এই শাসন পদ্ধতি প্রতিপক্ষ দেশগুলোর চাইতে আরও বেশি সমন্বিত। রাশিয়ার মতো চীনের পতন দেখতে চায় পশ্চিমারা। কিন্তু এটা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
মূল লেখা : তিমুর ফোমেনকো, আরটিতে প্রকাশিত; ভাষান্তর : সরকার জারিফ।
মন্তব্য করুন