মো. তাজুল ইসলাম
প্রকাশ : ২৪ মে ২০২৪, ০৪:৪৮ পিএম
আপডেট : ২৪ মে ২০২৪, ০৫:৫৯ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

আমিরুল ইসলাম চৌধুরী : জাহাঙ্গীরনগরের গারিঞ্চা পাখি

প্রফেসর আমিরুল ইসলাম চৌধুরী। ছবি : সৌজন্য
প্রফেসর আমিরুল ইসলাম চৌধুরী। ছবি : সৌজন্য

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার কর্মকালের একটি বড় প্রাপ্তি ছিল প্রফেসর আমিরুল ইসলাম চৌধুরী, অর্থাৎ এ আই সি, অর্থাৎ ময়না ভাইয়ের সাথে ঘনিষ্ঠতা।

কিন্তু এখন ভাবলে হাসি পায়, তার প্রতি একটা অব্যক্ত বিরূপতার মধ্য দিয়েই আমার জাহাঙ্গীরনগর যাত্রা শুরু হয়েছিল। সালটি ছিল ১৯৮১; দেশে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ তখন প্রায় নির্বাসিত শব্দ সমাহার; তার সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নও। তাই দরখাস্তের প্রায় পাঁচ মাস পর যখন নিয়োগপত্রটি নিয়ে বিভাগে উপস্থিত হলাম (একটি বন্যাজনিত বন্ধ, একটি কর্মচারী ধর্মঘট, একটি অফিসার ধর্মঘট অতিক্রম করে) তখন কেমন জানি একটু অস্বস্তি অনুভব করলাম। বিভাগের কলিগগণ খুব হাসিমুখে সাদর অভ্যর্থনা জানালেও মাঝে মাঝে দুএকটা প্রশ্ন বা ফোড়ন থেকে মনে হল সোভিয়েত ডিগ্রি নিয়ে আমার আগমন বিভাগের একাডেমিক অঙ্গনে না হলেও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ভালোই একটা চাপ সৃষ্টি করেছে। কিছু দিনের মধ্যেই বুঝতে পারলাম বিভাগেও যেমন, বিশ্ববিদ্যালয়েও তেমনি দুটি ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ধারা বিরাজ করছে।

প্রবল ধারাটি যখন আওয়ামী-ভারত-সোভিয়েত বৈরিতার সূত্রে মুক্তিযুদ্ধের একটি বিকল্প অর্থের অনুসন্ধানে ব্যস্ত, অন্য ক্ষীণ ধারাটি তখন হারিয়ে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধের রেশটাকে ধরে রেখে কোন প্রকারে টিকে থাকতে সচেষ্ট। জনাব আমিরুল ইসলাম চৌধুরীকে কোনও ধারাতেই ঠিক ফেলতে না পারলেও বন্ধুবান্ধব ও আড্ডাবাজির বিচারে তাকে আমি প্রবল ধারার মধ্যেই ফেলে দিলাম। ফলে আমার অবচেতন মনেই অমিত্র জনগোষ্ঠীর কাতারে তার জায়গা হয়ে গেল।

সেকালে জাহাঙ্গীরনগরে আজকের মত মারমার কাটকাট কোন দলাদলি ছিল না; তবে নির্বাচন ছিল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রবল ধারার কিছু প্রবল নেতা ঠিক করে দিতেন কে কোন পদ দখল করবেন, বা কোন চেয়ারে বসবেন। একবার বিপত্তি বাধল। সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের ডিন হিসাবে জনাব চৌধুরী এই প্রক্রিয়ায় মনোনীত হলেও পথ ছাড়তে রাজি হলেননা তারই বন্ধু স্থানীয়, সরকার ও রাজনীতি বিভাগের জনাব আজিজুল হক। অতএব ভোট। এই ভোটের সুবাদেই ময়না ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্কটি এক নতুন মাত্রা পেল। মফিজ ভাইয়ের (অর্থনীতির সহযোগী অধ্যাপক, প্রবল ধারার প্রবলতমদের একজন) রুমে ভোটের হিসাব নিকাশ হচ্ছে; রুমের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ কানে এলো, ময়না ভাই বলছেন, “তাজুলের ভোটটা আমি বাদ দিয়ে ধরেছি”। মনটা যারপরনাই খারাপ হয়ে গেল, কারণ ভোটটাতো আমি তাকেই দিব বলে ঠিক করে রেখেছিলাম। কারণটা খুব সিম্পল। ময়না ভাই বা আজিজ ভাই, দুজনেই আমার দৃষ্টিতে সেই প্রবল ধারার প্রতিভূ, তাদের মধ্যে একজনকে যদি বাছতে হয় তবে কেন আমি ঘরের জনকে রেখে বাইরে হাত বাড়াবো?

যাই হোক, মনের ক্ষোভ প্রকাশের একটা সুযোগ করে দিলেন আখলাক স্যার, প্রফেসর আখলাকুর রহমান। মুষ্টিবদ্ধ হাতে সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে ( এটা স্যারের মজলিশি সিগারেট খাওয়ার সিগনেচার স্টাইল) স্যার জিজ্ঞাসা করলেন, “ও মিয়া কারে ভোট দিবা?” আমার উত্তরের আগেই স্যার আমাকে হতভম্ব করে দিয়ে বললেন, “আজিজকে দিলে কেমন হয়? ময়নাতো এমনিতেই খুব পাওয়ারফুল, আরো পাওয়ারফুল করা কি ভাল হবে?” অনেক কষ্টে বিস্ময় ভাবটাকে দমিয়ে রেখে উত্তর দিলাম, স্যার আমি ভোটটা ময়না ভাইকেই দিব, তবে তার একটা কথায় আমি খুবই কষ্ট পেয়েছি; বললাম আমার কষ্টের কথা।

এবার স্যার আমাকে আরেক প্রস্থ হতভম্ব করে দিয়ে বললেন, ”মিয়া আমি তো তোমাকে পরীক্ষা করলাম; ভোটতো অবশ্যই ময়নাকে দিবা, অন্য ডিপার্টমেন্টে ভোট দিতে যাবা কোন দুঃখে? “আমার কাছে বিষয়টি আজও ধাঁধাই রয়ে গেল, আসলে ঐদিন স্যারের মনের কথাটা কী ছিল? সে যাই হোক, আসল ঘটনাটা ঘটল পরের দিন, কিংবা তার পরের দিন। ঘরে একা বসে আছি, ময়না ভাই ঘরে ঢুকে কোন ভণিতা না করে আমার হাতটি দুহাতে নিয়ে বললেন, তাজুল, আমি আপনার উপর খুব অবিচার করেছি , আমাকে মাফ করে দিবেন। আমি অপ্রস্তুত হয়ে তোতলাতে তোতলাতে কী বলেছি ভাল মনে নেই, তবে ময়না ভাই যে প্রায় ফসকে যাওয়া একজন ভোটারকে বাগে আনার প্রয়াসে অভিনয় করছেন না, তা তার কথার টোন থেকে অনুভব করলাম। আর নিশ্চিত হলাম, যখন তিনি বললেন, আমাকে আপনি ভোট দিবেন কি দিবেননা তা নিয়ে আর কথা বলবনা, তবে জুনিয়র কলিগ হিসাবে আপনি মনে কষ্ট পেয়েছেন এই চিন্তায় আমি সারারাত অস্থিরতায় কাটিয়েছি। আর কি রাগ থাকতে পারে? সেই শুরু, তারপর বহুদিন বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতিতে তার বিপরীত প্লাটফর্মে অবস্থান করেছি, কিন্তু ব্যক্তি ময়না ভাইকে ধীরে ধীরে ফিলসফার এবং গাইডের ভুমিকায় নিয়ে এসেছি নিজের অজান্তেই (বন্ধু শব্দটাকে ইচ্ছে করেই বাদ দিয়েছি; একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যায়, এই ভয়ে)।

আমাদের অন্তরঙ্গতা গড়ে উঠার পিছনে দুজনেরই বোধহয় আগ্রহ ছিল। আমার যে ষোল আনা ছিল তার মধ্যে কোন সন্দেহ নেই। আমরা দুজনেই নওয়াবপুর গভর্নমেন্ট স্কুলের ছাত্র ছিলাম; প্রায় দশকের ব্যবধান হলেও বান্দরের ঘর, পণ্ডিত স্যার, বারী স্যার, নুরুল হক স্যার, উর্দু সেকশানের সাথে ঝগড়া মারামারি ইত্যাদি নিয়ে কথা উঠলে দুজনেই তন্ময় হয়ে যেতাম। এর মধ্যে আবার যুক্ত হয়েছেন নজরুল ভাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের অধ্যাপক, তার সবচেয়ে অন্তরঙ্গ বাল্যবন্ধু ও স্কুলের ক্লাসমেট, আর আমার বন্ধুর বড়ভাই-কাম দেশীয়, কাম পূর্বপরিচিত (এক অঞ্চলের বাসিন্দা)। নজরুল ভাই আমার সম্বন্ধে তাকে কিছু ভাল ভাল কথা বলে বিষয়টাকে আমার অনুকূলে নিয়ে এসেছেন, বুঝতে পারতাম। ময়না ভাইয়ের একভাই আবার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন, এটাও আমাদের আলাপচারিতার অনেক কাঁচামালের যোগান দিত। জাহাঙ্গীরনগরে কালক্রমে আমার মতাদর্শিক বন্ধু বা শুভানুধ্যায়ীর সংখ্যা বেশ বড়ই হয়েছিল; কিন্তু ময়না ভাইর সাথে সম্পর্কটি গড়ে উঠেছিল কেবল মাত্র ব্যক্তিগত ভাল লাগার উপর ভিত্তি করে।

কালক্রমে অনেক ভাঙ্গা গড়া, চড়াই উতরাই পেরিয়ে জাহাঙ্গীরনগরের পলিটিক্স পলিটিক্স খেলায় আমরা কখন যে এক নৌকায় উঠে বসলাম মাঝে মাঝে তা ভাবলে অবাক লাগে। সেই কাহিনি বেশ চমকপ্রদ; স্থান সংকুলানের ভয়ে এখানে তার অবতারণা থেকে বিরত রইলাম; অন্য কোন সুযোগে তা বলা যাবে। এক কথায়, সেই প্রথম, দীর্ঘদিন উপেক্ষিত, অপাঙ্‌ক্তেয় এবং প্রান্তিক অবস্থানে থাকার পর জাহাঙ্গীরনগরের একাডেমিক ও প্রশাসনিক নীতি নির্ধারণে কিছুটা ভূমিকা রাখার সুযোগ এলো। ময়না ভাই হলেন ভাইস চ্যান্সেলর, আর আমার সুযোগ হল, তাকে প্রশাসক হিসাবে অতি কাছ থেকে দেখার; তার তদাবধি অপ্রকাশিত কিছু চমৎকার গুণাবলি প্রত্যক্ষ করার। সেই সম্বন্ধে কিছু বলার জন্যই এত দীর্ঘ ভণিতা।

তখনো মাসখানেক হয়নি ময়না ভাই ভিসি হয়েছেন, একদিন প্রফেসর মফিজউদ্দিন অর্থাৎ মফিজভাই প্রচণ্ড উত্তেজিত অবস্থায় আমার রুমে ঢুকলেন। তিনি এমনিতেই লাল, রাগে একেবারে সিঁদুরে লাল তার অবস্থা; বললেন “তাজুল ময়নাকে সামলান, আমার সহ্যের সীমা পার হয়ে গেছে”। আমিতো হতভম্ব। ময়না- মফিজ জোড়া নাম জাহাঙ্গীরনগরের শব্দ ভান্ডারে কিংবদন্তীসম, ময়না ভাই ভিসি হওয়ার পিছনে মফিজ ভাইয়ের অবদান আকাশচুম্বী, সেই মফিজ ভাইয়ের সহ্যের সীমা পার হয়ে যাওয়াতো হাত পা ঠান্ডা করে দেবার মত ঘটনা; বিশেষ করে আমরা যারা ময়না নামক ঘোড়াটির উপর বাজি ধরেছি তাদের জন্যতো বটেই। মফিজ ভাইয়ের সহ্য বিনষ্টকারী অভিযোগটি জানা গেল , “ ময়না কেন রেজিস্ট্রারের ঘরে যায়, কেন তাকে ডেকে এনে অর্ডার করেনা?” অভিযোগটি শুনে আমি বরং কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেলাম, কারণ ব্যাপারটা আমার কাছে ঠিক আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মত মনে হল না। আমাকে একটু নিশ্চুপ দেখে তিনি কী বুঝলেন জানিনা, হঠাৎ আমার হাত ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, চলেন এখনি ময়নার কাছে, একটা বিহিত করতে হবে। ময়না ভাই তো প্রথমে হেসেই খুন; কিন্তু মফিজ ভাইয়ের সিরিয়াস ভাবের কাছে তিনিও সিরিয়াস হলেন, বললেন, ”মোহাম্মদ আলী (রেজিস্ট্রার) আমার দীর্ঘ দিনের বন্ধু, তুমি তুমি সম্পর্ক। এখন ভিসি হয়েছি বলেই কি বন্ধুত্বকে বিসর্জন দিয়ে বস হয়ে বসতে হবে? এতটা অধঃপতনের (শব্দটা ঠিক কী ছিল মনে নেই, তবে এরকমই একটা কিছু) আগে আমি বরং ভিসিপদ ছেড়ে দিব।“ মফিজ ভাই ততটা কনভিন্সড হলেন না, তবে আর পীড়াপীড়িও করলেন না। আর আমি আবিষ্কার করলাম আরেক ময়না ভাইকে, ক্ষমতা বা পদ যাকে সামান্যতমও পরিবর্তন করতে পারেনি, আর নীতির প্রশ্নে যিনি তার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু এবং শুভানুধ্যায়ীকেও অগ্রাহ্য করতে পারেন।

ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক জীবনে ভিন্ন ভিন্ন আবহের মধ্যে থাকতেই আমরা (অনেকে) স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। কিন্তু ময়না ভাই তার ব্যক্তিগত সারল্যকে প্রাতিষ্ঠানিক আবহেও এভাবেই খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছেন দেখে আমি সত্যিই সেদিন চমৎকৃত হয়েছিলাম। ময়না ভাইয়ের সারল্য ও মহানুভবতা নিয়ে আরো দু একটা ঘটনার কথা বলব, তবে তার আগে মফিজভাই’র সাথে তার আর একটি এপিসোডের উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছিনা। মফিজভাই ছিলেন অবিসংবাদিতভাবে জাবিতে বিএনপি ঘরানার এক নম্বর ব্যক্তিত্ব (অনেকটা পীরস্থানীয় বলা যায়)। তার প্রভাবেই ছাত্রদল প্রশাসনের সাথে সহযোগিতাপূর্ণ একটা অবস্থান নিয়ে চলত। বিএনপি সরকারের আমলে এর কিছুটা সুফল প্রশাসনের পক্ষে আসছিল। ছাত্রলীগ, ছাত্রইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট এরাও প্রশাসনের বেশ অনুকূলেই ছিল। আসলে তখনাবধি প্রশাসন-ছাত্র সংগঠনের অনৈতিক সমীকরণগুলি বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়েই তেমনভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেনি; জাহাঙ্গীরনগরেতো অবশ্যই নয় (দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া) । সে যাই হোক মফিজভাই চাইলেন ছাত্র দলের নেতাদেরকে ভিসি সাহেব চায়ের দাওয়াত দিক, যাতে সরকারের উচ্চ মহলে প্রশাসনের একটা লিয়াঁজো গড়ে ওঠে। ময়না ভাই কিছুতেই সেটি করবেন না, কারণ তাহলে ছেলেরা মাথায় চড়ে বসবে। এ নিয়ে দুই বন্ধুর মুখ দেখাদেখি বন্ধের উপক্রম হলেও ময়না ভাই কিছুতেই তার অবস্থান থেকে সরে আসবেন না। অগত্যা মফিজভাইকেই সরে আসতে হল (মফিজভাই’র এই একটি গার্জিয়ানসুলভ গুণ ছিল, নিজের পছন্দ না হলেও কোন ইস্যুতে তিনি গোঁ ধরে থাকতেন না)। আজ পিছনে ফিরে তাকালে বুঝতে পারি, কী শক্ত নৈতিক অবস্থান থাকলে এ ধরনের চাপ উপেক্ষা করা যায়।

ছোট খাটো কিছু ঘটনায় ভিসি হওয়ার আগে থেকেই ময়না ভাইয়ের নৈতিক দৃঢ়তার সাথে আমার পরিচয় ঘটেছিল। সে রকম একটি ঘটনার কথা বলি। ছাত্রদের অনুরোধে পরীক্ষা পেছানো অর্থনীতি বিভাগের একটি মুদ্রাদোষে পরিণত হয়েছিল, যা ময়না ভাই তেমন পছন্দ করতেন না। কঠিন কোন পরীক্ষার আগের দিন অথবা ঐ দিন সকালে দেখা যেতো ভাল ছাত্রদের মধ্যে একজন গুরুতর অসুস্থ, আমাদের মেডিক্যাল সেন্টারের এই মরে তো সেই মরে ধরনের সার্টিফিকেট নিয়ে বন্ধুদের কয়েকজন পরীক্ষা কমিটির সামনে ধর্ণা দিয়ে বসে আছে, এত ভাল ছাত্রের ক্যারিয়ারটা যেন স্যাররা নষ্ট করে না দেন। সব কিছু বুঝেও কমিটির পক্ষে পরীক্ষা না পিছিয়ে উপায় থাকতনা। ময়না ভাই প্রায়শই বলতেন একবার না পিছিয়ে দেখিই না ছাত্ররা কতদূর যায়! কিন্তু ‘নিষ্ঠুর’ দুর্নামের ভয়েই হোক আর আন্দোলনের ভয়েই হোক, এক্সপেরিমেন্টটা কেউ করতে সাহস পেতনা। একবার এরকম এক ঘটনায় ফোকাসে চলে এলেন ময়না ভাই নিজেই।

ভাবীর আপন বোনপো (নাকি ভাইপো সঠিক মনে নেই, তবে অত্যন্ত নিকট আত্মীয়)- নামটা এখন মনে নেই- অসুস্থ হল এবং যথারীতি মেডিক্যাল সেন্টারের সুপারিশসহ পরীক্ষা স্থগিতের দরখাস্ত চলে এলো। কাকতালীয়ভাবে পরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান হলেন ময়না ভাই; ফাইনাল কথাটি তিনিই বলবেন। অনেক কাতর অনুনয়, অনেক আবেগাত্মক চাপ উপেক্ষা করে ময়না ভাই তার সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। ছেলেটি সিকবেডে (রাইটার নিয়ে নাকি নিজে, ঠিক মিনে নেই) পরীক্ষা দিতে বাধ্য হয়েছিল। আমার হিসাবে এর আগে আমরা যতগুলি পরীক্ষা পিছিয়েছি তার অন্তত সত্তর ভাগের চেয়ে তার অবস্থা খারাপ ছিল। এই যুক্তিটা ময়না ভাইকে দেবার পর তিনি বলেছিলেন ঐ সত্তর ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা ভুল করেছিলাম, একখানে এসে তো ব্যাপারটা থামতে হবে। হ্যাঁ, ব্যাপারটা থেমেছিল। এরপর দীর্ঘদিন ডা. হান্নানের সুপারিশ সম্বলিত আবেদন আসা বন্ধ ছিল (ডা. হান্নান মেডিক্যাল সেন্টারের প্রধান, ছাত্র-সুহৃদ হিসাবে তিনি বেশ প্রসিদ্ধ ছিলেন), আর আসলেও আমরা উপেক্ষা করার মত মনোবল দেখাতে পারতাম। একবারতো ক্লাসের ফার্ষ্টবয়কেও রক্ত আমাশয় নিয়ে ( তার দাবি এবং ডাক্তারের সুপারিশ অনুযায়ী) পরীক্ষায় বসতে বাধ্য করেছিলাম।

মফিজভাই ঠাট্টা করে প্রায়শই বলতেন, ময়না একটা ভিতুর ডিম; অর্থাৎ সাহস করে বড় ধরনের অন্যায় তিনি করতে পারতেননা (ছোট মাঝারি কিছু অন্যায় যে তার আমলে হয়নি তা নয়, তবে ন্যায়ের ভাগ যে অনেক বেশি ছিল একথা তার অতি বড় শত্রুও স্বীকার করবেন)। কিন্তু নৈতিক প্রশ্নে তিনি যে সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন তা জাহাঙ্গীরনগরের ইতিহাসে উজ্জ্বলতম ঘটনা হিসেবে আজও অমলিন।

আমি তখন শহিদ সালাম বরকত হলের প্রভোস্ট; একদিন কাকভোরে ঘুম ভাঙল গুলি, বোমা আর স্লোগানের শব্দে। খবর এলো ছাত্র শিবিরের সশস্ত্র ছেলেরা বিভিন্ন হলে দখল নিয়েছে। বাড়ির ছাদে উঠে দেখলাম, উত্তরে আলবেরুনি আর দক্ষিণে কামাল উদ্দিন হলের ছাদে অস্ত্রধারীরা পাহারারত। আমার হলটা মাঝখানে মুক্ত অবস্থায় (তার প্রধান কারণ, হলটি চারদিক থেকে উন্মুক্ত)। তাদের দাবিনামা সম্বলিত লিফলেটও চলে এলো, যা নিয়ে কর্তৃপক্ষের সাথে তারা আলোচনা করতে চায়। ইতিমধ্যে ভিসি সাহেবের নির্দেশ এলো, যে সমস্ত হলগুলি দখলমুক্ত সেখানে যেন প্রভোষ্টগণ হাউজ টিউটর সহ সার্বক্ষণিক অবস্থান নেন এবং সাধারণ ছাত্রদের মনোবল অটুট রাখার ব্যবস্থা করেন। তাই আর ভিসি অফিসে যাওয়া হল না, নিজের হল আগলেই বসে রইলাম। ক্ষণে ক্ষণে দখলকারীদের হুমকি আসতে লাগলো, তাদের সাথে আলোচনায় না বসলে তারা চরম ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে। এদিকে ভিসি সাহেব অনড়, হল দখলে থাকা অবস্থায় তাদের সাথে কোন রকম আলোচনায় যাবেনা প্রশাসন; বরং তিনি বার বার পুলিশকে তাগাদা দিচ্ছেন হলে ঢোকার জন্য। বি এন পির তৎকালীন রাজনৈতিক সমীকরণের কারণেই হোক(বিএনপি তখন সরকারে), বড় ধরনের ক্ষয় ক্ষতির ভয়েই হোক আর পুলিশের নিজস্ব নিরাপত্তার চিন্তায়ই হোক, বেলা গড়িয়ে গেলেও রেইড আর হয়না। একপর্যায়ে ভিসি সাহেব ছাত্র শিক্ষক কর্মচারীদের নিয়ে রাস্তায় নামলেন, তিনি হলে ঢুকবেন, পরিণতি যাই হোক। উপায়ান্তর না দেখে পুলিশকে তড়িঘড়ি করে হল রেইড করতে হল; আর বহ্বারম্ভে লঘু ক্রিয়ার মতো অনায়াসেই দখলকারীদের কাবু করে ফেললো।

এই ক্লাইমেক্স সময়টিতেই আমি মিস করেছি, সেসময় নিজের হল সামলানোর ব্যস্ততায়। তবে এই ঘটনা ‘ভিতুর ডিম’ আমিরুল ইসলাম চৌধুরীকে কোন্‌ উচ্চতায় নিয়ে গেছে তা অনুভব করেছি ক্ষণে ক্ষণে, ক্যাম্পাসের সর্বত্র ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারী, পথচারী সকলের আলাপচারিতায়। আমার এক পুরানো ছাত্র বর্তমানে এক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার কলিগ। সে যখন ছাত্র তার অনেক আগেই ময়না ভাই ডিপার্ট্মেন্ট ছেড়েছেন। একদিন কথায় কথায় সে যখন জানালো তাদের সময়ও এই কাহিনি ক্যাম্পাসে সজীব ছিল তখন বুঝতে পারলাম জাবি ইতিহাসের কোথায় স্থান করে নিয়েছেন আমিরুল ইসলাম চৌধুরী।

ময়না ভাই’র আরো দুয়েকটা মানবিক বৈশিষ্ট্যের কথা বলব বলেছিলাম। সেটি দিয়েই শেষ করছি: আমি বেশ কয়েক বছর ময়না ভাইয়ের সাথে কোরবানি দিয়েছি। আমি আর ময়না ভাইই হাটে গিয়ে গরু কিনতাম, কোনোবার আশুলিয়া, কোনোবার কালামপুর কোনোবার এমনকি গাবতলী পর্যন্ত গিয়ে। ময়না ভাই গরুর পরে অবশ্যই একটা খাসি কিনতেন। এটা তিনি কিনতেন জামাই কিংবা বেয়াই খাওয়ানোর জন্য নয়। তার খাসীর বিশেষ অতিথিরা ছিলেন ক্যাম্পাসের অমুসলিম অধিবাসীগণ। ঈদের পরদিন তারা সকলে তার বাসায় নিমন্ত্রিত ছিলেন। ময়না ভাই প্রত্যেককে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিমন্ত্রণ করতেন, কখনো টেলিফোনে দাওয়াত দিতেন না।

একবার ঈদের দিন বিকেলবেলা ময়না ভাই’র বাসায় এসেছিলাম, দেখি তিনি গাড়িতে করে বের হয়ে যাচ্ছেন। তিনি বিশমাইলের দিকে যাচ্ছেন, আমিও সাথে উঠে বসলাম। বিশমাইল এসে আমাকে বসতে বলে গাড়ি থেকে নামলেন, সাথে একটা পোটলা গোছের। মিনিট দশেক পর ফিরে আসলে কথায় কথায় বের হল তিনি জাফরের বাসায় কোরবানির মাংস নিয়ে এসেছিলেন; সিরাজ (পিয়ন) বাসায় নেই তাই তিনিই দিয়ে গেলেন। জাফর অর্থনীতি বিভাগের পিয়ন, আর আমিরুল ইসলাম চৌধুরী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি। এই হলেন ময়না ভাই। পদমর্যাদা তুচ্ছ করে পিয়নের বাসায় কোরবানির মাংস বয়ে আনা, গুলিখাওয়া ছাত্রের মৃত্যুশয্যায় রাতের পর রাত হাজিরা দেয়া, রাস্তা অবরোধকারী ছাত্রদেরকে ঘরে ফিরিয়ে আনতে গভীর রাত পর্যন্ত তাদের সাথেই আরিচা রোডে বসে থাকা, এসব কি আমাদের সমাজের খুবই পরিচিত ছবি? মনে হয়, না।

একবার একটা লেখা পড়েছিলাম ব্রাজিল ফুটবল টিম, পেলে এসব নিয়ে। যারা খবর রাখেন তারা জানেন, সেই ১৯৫৮’র বিশ্বকাপ থেকে পেলে আর ব্রাজিল প্রায় সমার্থক। তবে একজন ব্রাজিলিয়ানকে জিজ্ঞাসা করলে সে আরেকটা নাম বলবে। তার আসল নামটা অনেক বড়, তবে ব্রাজিলিয়ানরা তাকে ডাকত টুনটুনি গোত্রের ছোট্ট একটা পাখি, গারিঞ্চা নামে। সেই ৫৮ থেকে ৭০ পর্যন্ত বিশ্ব ফুটবলের একচ্ছত্র কর্তৃত্বকারী ব্রাজিল দলের প্রাণভোমরা ছিল পেলে আর গারিঞ্চা। একটা রেকর্ড আছে, পেলে আর গারিঞ্চা একসাথে দলে ছিল এরকম কোন খেলায় ব্রাজিল কখনো হারেনি। ৬২’র বিশ্বকাপতো বলতে গেলে গারিঞ্চা একাই ঘরে তুলল, পেলে দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই ইনজুরিতে পড়ার পর। কালক্রমে ব্যক্তিত্ব, নেতৃত্ব, উচ্চাভিলাষ, নিজেকে তুলে ধরার ক্ষমতা ইত্যাদির মধ্যদিয়ে পেলে আন্তর্জাতিক ফুটবলে চিরস্থায়ী আসন করে নিলেন, আর গারিঞ্চা? বোদ্ধা মহলে এখনো সমান মূল্যায়িত হলেও ( সর্বশেষ, এক্সপার্ট ভোটে শতাব্দীর সেরা বিশ্বদলে স্থান পেয়েছেন) এলেবেলে গোছের লোকটি ঐ সব গুনাবলীর অভাবে আস্তে আস্তে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে, সাধারণ ফুটবল প্রেমিকদের কাছে প্রায় অচেনা হয়ে উঠলেন। কিন্তু ব্রাজিলে যান, সেখানকার চিত্র ভিন্ন। এখনো সেখানে পেলে গারিঞ্চা সমান ভাবে উচ্চারিত নাম।

আর সবচেয়ে মজার কথাটি কী জানেন? একজন ব্রাজিলিয়ানকে যদি জিজ্ঞাসা করেন পেলে আর গারিঞ্চাকে তিনি কীভাবে তুলনা করেন, সবচেয়ে সম্ভাব্য উত্তরটি হল,” পেলেকে আমরা শ্রদ্ধা ( এডমায়ার) করি, আর গারিঞ্চাকে আমরা ভালোবাসি”। পেলে ছিলেন স্টার, সেলিব্রিটি, আর গারিঞ্চা ছিলেন তার সরল, হুল্লুড়ে বেপরোয়া জীবন নিয়ে একেবারেই মাটির মানুষ, সাধারণের কাছের মানুষ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ভিসি এসেছেন- কাজে, দক্ষতায়, নেতৃ্ত্বগুণে তারা শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু আমার বিশ্বাস, মানুষের ভালবাসা অর্জনের ক্ষেত্রে আমিরুল ইসলাম চৌধুরি হলেন জাহাঙ্গীরনগরের গারিঞ্চা। লক্ষ্য করেছেন? ‘গারিঞ্চা’ এবং ‘ময়না’, দুটিই খুব লোকপ্রিয় পাখি! (প্রফেসর আমিরুল ইসলাম চৌধুরি ৮৪ বছরে পদার্পণ করেছেন। তার সুস্থ শতায়ু কামনা করি)

মো. তাজুল ইসলাম: ভূতপূর্ব প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ধরা পড়ে শিক্ষক বললেন, ‘আমাদের ভুল হয়েছে’

ভিনি ম্যাজিকে সালজবুর্গকে উড়িয়ে দিল রিয়াল

হঠাৎ মাঝ আকাশ থেকে বিমানের জরুরি অবতরণ

ছুটি কাটাতে গিয়ে বস চাইলেন লাইভ লোকেশন

অজানা ভয় সঙ্গী করে ঘরে ফিরছেন তেহরানের মানুষ

ক্লাব বিশ্বকাপের শেষ ষোলোয় কে কার মুখোমুখি?

খুলনায় ২ যুবককে গুলি করে হত্যা

রেলের জমি থেকে মণ্ডপ সরানো নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে : রেল উপদেষ্টা

সেই পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনাধীন

দুপুরের মধ্যে যেসব অঞ্চলে ঝড় হতে পারে

১০

৯ জনকে ধর্ষণ-হত্যার পর ধরা, সেই ‘টুইটার খুনি’র মৃত্যুদণ্ড কার্যকর

১১

২৯তম বিসিএসে ২১ ভুয়া ক্যাডার

১২

খাবার টাটকা রাখতে ফ্রিজের তাপমাত্রা কত রাখবেন

১৩

গত ২৪ ঘণ্টায় বিশ্বের বড় ১০ খবর

১৪

টিভিতে আজকের খেলা

১৫

চট্টগ্রামে বিএনপি নেতা বহিষ্কার

১৬

যুদ্ধ আমাদের ইমানি শক্তি বাড়িয়েছে : ইরানি আলেমদের প্রতিক্রিয়া

১৭

রাশিয়ায় ইরানি শিশুর সঙ্গে এ কেমন আচরণ, সারা বিশ্বে তোলপাড় (ভিডিও)

১৮

২৭ জুন : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৯

ইরানকে ৩০ বিলিয়ন ডলারের গোপন প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রের

২০
X