মহাসপ্তমীর আনন্দ উচ্ছ্বাসের পরই ভক্তদের মন ভালো নেই। চোখে জল। মণ্ডপে মণ্ডপে বিষাদের সুর। বিজয়া দশমী শেষে বিসর্জনের মধ্য দিয়ে বাপের বাড়ি থেকে কৈলাশে স্বামীর বাড়ি ফিরে যাবেন দেবী দুর্গা। এরমধ্য দিয়ে শেষ হবে মর্ত্যে বাবার বাড়িতে সন্তানদের নিয়ে দুর্গতিনাশিনীর বার্ষিক অবকাশ। আবার এক বছর পর ফিরবেন।
সোমবার শারদীয় দুর্গোৎসবের মহানবমী তিথিতে কল্পারম্ভ আর বিহিত পূজায় সারা দেশের মণ্ডপে মণ্ডপে দুর্গাদেবীর অর্চনা করেছেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হয় সন্ধি পূজা। ধূপের গন্ধ ভরা পূজা মণ্ডপে আনন্দময়ীকে অঞ্জলি দেন তারা। শঙ্খনাদ আর ঢাকের বাদ্যের সঙ্গে চলে অবিরাম মন্ত্রপাঠ। ভক্তরা নিজ, পরিবার সহ গোটা পৃথিবীর শান্তি আর মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা জানিয়েছেন দেবী দুর্গার কাছে। সকাল থেকে রাতভর নগরীর মণ্ডপগুলোতে প্রতীমা দর্শনে ভিড় করেন ভক্তরা। অনেক স্থানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আর দেবরাজ্যের নানা কাহিনি প্রদর্শন করা হয়।
সন্ধ্যায় ঢাকেশ্বরী মন্দির, বনানী পূজা মণ্ডপ হাজারো ভক্তের ভিড় চোখে পড়ে। ঘণ্টাব্যাপী লাইনে দাঁড়িয়ে খামারবাড়ি মণ্ডপে প্রবেশ করেন অনেকেই। তেমনি শাখরিবাজার ও তাঁতি বাজার এলাকায় যেন শ্বাস ফেরার জায়গা নেই। পায়ে পায়ে মানুষের স্রোত পুরোনো ঢাকার এই এলাকার প্রতিটি মণ্ডপে। বিস্তর জায়গা হওয়ায় রমনা ও বরদেশ্বরী কালীমাতা মন্দিরেও দেখা গেছে মানুষের ব্যাপক ভীড়। জগন্নাথ হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শীব মন্দির প্রাঙ্গণ, মীরপুর বড় বাজার মণ্ডপের চিত্রও একই রকম। খিলক্ষেত রেল গেইট এলাকায় দুটি আর লেকসিটির ভেতরে পূজা মণ্ডপের গভীর রাত পর্যন্ত ভক্তদের আনাগোনা দেখা গেছে। ভক্তিমূলক গান পরিবেশনায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন সবাই। সব মন্দিরেই ভক্তদের মধ্যে নানা রকম প্রসাদ বিতরণ করা হয়েছে।
শাস্ত্রমতে, নবমী পূজার মাধ্যমে মানুষের সম্পদলাভ হয়। শাপলা-শালুক ও বলিদান সঙ্গে নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে নবমী পূজা পালিত হয়। নবমীতেই দেবী বন্দনার সমাপ্তি। তাই ভক্তরা প্রার্থনা করতে থাকেন দেবীর উদ্দেশ্যে। যজ্ঞের মাধ্যমে দেবী দুর্গার কাছে আহূতি দেওয়া হয়। ১০৮টি বেল পাতা, আম কাঠ, ঘি দিয়ে এই যজ্ঞ হয়েছে। ধর্মের গ্লানি আর অধর্ম রোধ, সাধুদের সেবা, অসুরের বধ আর ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতি বছর দুগর্তিনাশিনী দেবী দুর্গা ভক্তদের মাঝে আবির্ভূত হন। নবমীর উচ্ছ্বাস-আনন্দের পরই বিদায়ের সুর নিয়ে আসে বিজয়া দশমী। আজ দশমী পূজা শেষে বিকাল ৩টায় ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির থেকে বিজয়া শোভাযাত্রা গিয়ে শেষ হবে সদরঘাট বুড়িগঙ্গার পাড়ে ওয়াইজঘাটে। এরপর পরই ২৪৬টি মণ্ডপের প্রতীমা বিসর্জন শুরু হবে। বিজয়া শোভাযাত্রা উপলক্ষে রাজধানীসহ সারাদেশে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পুরোহিত রাজিব চক্রবর্তী বলেন, মহানবমীর দিন সকাল থেকে শুরু হয়ে ৯টা ৫৭ মিনিটের মধ্যে শ্রী শ্রী দুর্গাদেবীর মহানবমী কল্পারম্ভ ও মহানবমী বিহিত পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঢাকা মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের উপদেষ্টা প্রণব চক্রবর্তী বলেন, প্রতিদিন সকাল এবং সন্ধ্যায় পূজা এবং অন্যান্য রীতি পালন করা হচ্ছে। একেক দিনের পূজার ভিন্ন ভিন্ন মাহাত্ম রয়েছে। মূলত নবমীর দিন থেকে মাকে বিদায়ের সুর বেজে ওঠে ভক্তদের মনে। এদিন ভক্তরা যেমন উৎসব করে আবার মাকে বিদায়ের প্রস্তুতিও নেয়। পঞ্জিকামতে, দেবী দুর্গা এবার মর্ত্যে এসেছেন ঘোটকে অর্থাৎ ঘোড়ায় চড়ে। ফিরবেনও তাতেই। এই বাহনের ফল হল ‘ছত্রভঙ্গ’। পুরোহিত রাজিব চক্রবর্তী বলেন, ঘোটকে যেহেতু দেবীর আগমন এবং গমন, সেটি অশুভ বার্তা, তবে ভক্তের আরাধনায় দেবীর মন তুষ্ট হলেই মিলবে শান্তি। মহানবমীতে তাই দেবীর কাছে ভক্তদের প্রার্থনা যেন মায়ের মন ভক্তের জন্য সহানুভূতিশীল হয়। অশুভের বিনাশ হয়, শুভশক্তির জয় হয়।”
শারদীয় দুর্গোৎসবে প্রতিমা বিসর্জনের দিন মঙ্গলবার সারা দেশের মণ্ডপসহ সব জায়গায় ‘বিশেষ নিরাপত্তার’ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে র্যাব। ‘নিরাপত্তা বিবেচনায় প্রযোজনীয় সবকিছু করা হবে’ বলে জানিয়েছেন বাহিনীটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন। গতকাল রাজধানীর গুলশান-বনানী পূজা মণ্ডপ পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, এখনো যতটুকু সময় আছে সেটি ধরে প্রতিমা বিসর্জনে র্যাব সারাদেশে স্পেশাল নিরাপত্তা দেবে।
ষষ্ঠীতে দেবীর বোধনের মধ্য দিয়ে শুক্রবার থেকে পাঁচ দিনের যে যে দুর্গোৎসব শুরু হয়েছিল, মঙ্গলবার প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এ আয়োজন। দেশজুড়ে ৩২ হাজার ৪০৭টি মন্দির-মণ্ডপে পূজা হচ্ছে এবার।
মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সভাপতি মনীন্দ্র কুমান নাথ কালবেলাকে জানান, মঙ্গলবার বিজয়া দশমী শেষে বেলা ৩টার পর প্রতি মণ্ডপ থেকে সরাসরি স্ব স্ব বিসর্জন ঘাটে প্রতীমা নেয়ার জন্য বলা হয়েছে। মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির নেতৃত্বে বিকাল তিনটায় পলাশী মোড় থেকে বিজয়া শোভাযাত্রা বের হবে। শ্রী শ্রী ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির-পলাশী বাজার-জগন্নাথ হল-কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার-দোয়েল চত্বর-হাইকোর্ট-বঙ্গবাজার-ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ভবন-গোলাপ শাহ মাজার-গুলিস্তান মোড়-নবাবপুর রোড-রায় সাহেব বাজার-বাহাদুর শাহ পার্ক-বুড়িগঙ্গার ওয়াইজ ঘাটে গিয়ে শোভাযাত্রা শেষ হবে। এরপর প্রতীমা বিসর্জন।
দশমীতে মণ্ডপে মণ্ডপে হবে সিঁদুর খেলা। পরিবার ও স্বামীর মঙ্গল কামনায় নারীরা একজন আরেকজনের কপালে সিঁদুর পরিয়ে দিবেন। শিক্ষায় এগিয়ে যাওয়ার আশির্বাদ নিতে শিশুরা প্রতীমার পায়ে বই ছোয়াবে। জল, পাখার বাতাস আর মিষ্টিমুখ করিয়ে দেবীকে বিদায় জানাবেন ভক্তরা।
মন্তব্য করুন