‘মসজিদ আমাদের ব্যারাক, গম্বুজ হেলমেট, মিনার বেয়নেট, মুসল্লিরা আমাদের সৈনিক, তারা পাহারা দেবে দ্বীনকে।’ কঠোর ধর্মনিরপেক্ষ দেশ তুরস্কে জনসমক্ষে এই কবিতা আবৃত্তি করে চার মাস কারাবরণ করতে হয়েছিল জনপ্রিয় নেতা রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানকে। ছোটবেলা থেকেই শত সংগ্রাম, বাধাবিপত্তি আর প্রতিরোধ অতিক্রম করে আজ তুরস্কের প্রেসিডেন্ট তিনি। তার বর্ণাঢ্য জীবনে রয়েছে নানা অজানা ও চমকপ্রদ তথ্য।
১৯৫৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তুরস্কের ইস্তাম্বুলের কাশিমপাশায় জন্মগ্রহণ করেন মুসলিম রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। বাবা আহমদ এরদোয়ান পেশায় ছিলেন কোস্টগার্ডের ক্যাপ্টেন। মা তানজিলে হানিম ছিলেন গৃহিণী। পাঁচ সহোদরের মধ্যে এরদোয়ান তৃতীয়।
কাশিমপাশা পিয়ালে মাদ্রাসা থেকে প্রাথমিক ও ইমাম হাতিব মাদ্রাসা থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করেন এরদোয়ান। পরে মারমারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবসায় শিক্ষা ও অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নেন তিনি।
এরদোয়ানের জন্ম অসচ্ছল এক ধার্মিক পরিবারে। তার জীবনের বড় একটি অংশ কেটেছে অর্থনৈতিক দীনতার সঙ্গে লড়াই করে। ছাত্রজীবনে জীবিকা ও পড়াশোনার খরচ বহন করতে স্থানীয় বাজারে রুটি ও শরবত বিক্রি করতেন এরদোয়ান। তার একটা অংশ দিতেন পরিবারকে, আর বাকিটা দিয়ে পড়াশোনার খরচ চালাতেন।
১৯৮৩ সালে ওয়েলফেয়ার পার্টি (রেফাহ পার্টি) নামে একটি দলে যোগ দেন এরদোয়ান। দলের মধ্যে তার ছিল ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা। যার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৯৪ সালে। নতুন দলে যোগদানের ১০ বছর পরই ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচিত হন এরদোয়ান।
ইস্তাম্বুলের নগর পিতা হয়ে শহরটির ব্যাপক সংস্কার করেন এরদোয়ান। যানজটে নাকাল শহরটিতে তিনিই নিয়ন্ত্রিত ট্রাফিক সিস্টেম প্রণয়ন করেন। বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ মহানগরগুলোর মধ্যে অন্যতম ইস্তাম্বুল যানজটের জন্য ব্যাপকভাবে পরিচিত ছিল। কিন্তু মেয়র হওয়ার পর সেই তকমা মুছে দেন এরদোয়ান। মাত্র চার বছর মেয়রের দায়িত্ব পালন করেই শহরটিকে ইউরোপ-আমেরিকার শহরের পর্যায়ে নিয়ে যান তিনি।
২০০১ সালের আগস্টে আবদুল্লাহ গুলের সঙ্গে মিলে ইসলামপন্থি জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একে পার্টি) গঠন করেন এরদোয়ান। নতুন দল গঠনের এক থেকে দেড় বছরের মধ্যেই, অর্থাৎ ২০০৩ সালে জাতীয় নির্বাচনে অভাবনীয় সাফল্য পায় একে পার্টি। আর এরদোয়ান পান প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব। এরপর ২০০৭ ও ২০১১ সালে টানা তৃতীয়বার তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী হন তিনি।
২০১৪ সালের আগস্টে প্রথমবার জনপ্রিয় ভোটে তুরস্কের ১২তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এরদোয়ান। ২০১৮ সালের ২৪ জুন দ্বিতীয়বার দেশটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি। এর আগে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা ছিল নামেমাত্র। ২০১৭ সালে সংবিধান পরিবর্তন করে প্রেসিডেন্টকে সব ক্ষমতা দেওয়া হয়। ফলে দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হয়ে দেশটির প্রেসিডেন্টশাসিত সরকারের প্রথম প্রেসিডেন্ট হন এরদোয়ান।
২০১৬ সালে তাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে পশ্চিমা কিছু দেশের পরোক্ষ মদদে সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়। কিন্তু এরদোয়ানের জনপ্রিয়তার কাছে হার মানে ওই অভ্যুত্থান। যদিও অভ্যুত্থান ঠেকিয়ে অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া সেনা অফিসারদের প্রতি কঠোর আচরণ করেন। এতে তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখেও পড়েন।
তুরস্কে খেলাফতের বিলুপ্তি ঘটিয়ে ১৯২২ সালে দেশটির প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক। আতাতুর্ককে আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। ইসলামী বিধানের ওপর প্রতিষ্ঠিত তুরস্কে তিনি ধর্মনিরপেক্ষতা কায়েম করেছিলেন। এ জন্য হিজাব নিষিদ্ধ, মাদ্রাসা শিক্ষা বন্ধ, রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকেও বিলুপ্ত করা হয়। কিন্তু এরদোয়ান তুরস্কের ক্ষমতায় আসার পর থেকেই কৌশলে ও ধীরে ধীরে মোস্তফা কামালের সেই পদক্ষেপগুলো থেকে তুর্কিদের বের করে আনার চেষ্টা করছেন। বর্তমানে তুরস্কের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিচয় আবারও ইসলামের দিকে ঝুঁকছে। মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্ক পুনরায় জাগিয়ে তুলছেন তিনি।
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও সাহসী ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ গোটা মুসলিম বিশ্ব। এশিয়া থেকে ইউরোপ, ককেশাস থেকে আফ্রিকা মহাদেশের পাদদেশ কিংবা মধ্যপ্রাচ্য; প্রতিটি মুসলিম ভূখণ্ডেই রয়েছে এরদোয়ানের অসংখ্য ভক্ত-অনুরাগী। তারা এরদোয়ানের মধ্যে ওসমানীয় সুলতানদের ছায়া দেখতে পান, দেখতে পান হারানো খেলাফত পুনরায় প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাও। এ জন্য অনেকেই তাকে ভালোবেসে ‘নব্য তুর্কি সুলতান’ বলে ডাকেন। তবে সমালোচকদের দাবি, তিনি ধর্মকে ব্যবহার করছেন আর ক্রমে স্বৈরশাসক হয়ে উঠছেন। কঠোর হস্তে দমন করছেন বিরোধীদের।
মন্তব্য করুন