ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বহু বছর ধরেই উত্তপ্ত। বিশেষ করে ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে, ইরান যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে। দুদেশের এই বৈরিতা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরাসরি সামরিক সংঘাতে রূপ নিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে শনিবার (২১ জুন) ইরানের পরিমানবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
আয়াতুল্লাহ খোমেনির ১৯৭৯ সালের নেতৃত্বে ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে পশ্চিমঘেঁষা শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভিকে ক্ষমতা থেকে সরানো হয়। সেই থেকেই ইরান ও আমেরিকার সম্পর্কের টানাপড়েন শুরু। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি, মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব ও যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ- এসব বিষয় ঘিরে দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে।
এদিকে, ইসরায়েল অনেক আগে থেকেই ইরানকে হুমকি মনে করে। গত সপ্তাহে তারা ইরানের বিরুদ্ধে বড় ধরনের সামরিক হামলা চালায়, অভিযোগ করে যে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বানাচ্ছে। যদিও এর কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নেই, তবুও এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ট্রাম্প আমেরিকাকে সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে ফেলেন।
স্থানীয় সময় শনিবার রাতে আমেরিকা ইরানের বিরুদ্ধে বড় ধরনের হামলা চালায়। এতে ১২৫টির বেশি যুদ্ধবিমান ও ৭৫টি নিখুঁতভাবে নিয়ন্ত্রিত বোমা ব্যবহার করা হয়। ওয়াশিংটনের দাবি, এতে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে এ ঘটনার পর তেহরানও পাল্টা প্রতিশোধ নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে।
নিচে ১৯৫৩ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো-
১৯৫৩ – সরকার পতন ও শাহকে পুনঃবহাল
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেক ব্রিটিশদের তেল কোম্পানি জাতীয়করণের উদ্যোগ নেন। এতে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র ক্ষুব্ধ হয়। পরে সিআইএ ও ব্রিটিশ গোয়েন্দা বাহিনী একত্রে মোসাদ্দেককে সরিয়ে আবার শাহকে ক্ষমতায় বসায়।
১৯৫৭ – পারমাণবিক সহযোগিতা
যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পারমাণবিক প্রযুক্তি দিতে রাজি হয়। এই সহযোগিতাই ভবিষ্যতে পারমাণবিক বিতর্কের ভিত্তি তৈরি করে।
১৯৭৯ – ইসলামি বিপ্লব
শাহের শাসনের বিরুদ্ধে দেশের মানুষ বিদ্রোহ করে। আয়াতুল্লাহ খোমেনি দেশে ফিরে এসে ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৮০ – কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন
শাহকে যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসার সুযোগ দেওয়ার পর ইরানের ছাত্ররা তেহরানে মার্কিন দূতাবাসে হামলা চালিয়ে ৫২ জনকে জিম্মি করে। এরপর যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং নিষেধাজ্ঞা দেয়।
১৯৮০-৮৮ – ইরান-ইরাক যুদ্ধ
সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বে ইরাক ইরানে হামলা চালায়। যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের পক্ষে অবস্থান নেয়। যুদ্ধ আট বছর ধরে চলে।
১৯৮৪ – সন্ত্রাসবাদে পৃষ্ঠপোষক তকমা
যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে ‘সন্ত্রাসবাদে সহায়তাকারী রাষ্ট্র’ হিসেবে ঘোষণা করে। এর পেছনে ছিল লেবাননে মার্কিন সেনাদের ওপর হামলা, যার দায় ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহর ওপর পড়ে।
১৯৮৮ – যাত্রীবাহী বিমান ভূপাতিত
মার্কিন নৌবাহিনী ইরানের একটি যাত্রীবাহী বিমান ভূলবশত গুলি করে নামায়। এতে ২৯০ জন নিহত হয়। যুক্তরাষ্ট্র দুঃখ প্রকাশ করলেও ক্ষমা চায়নি।
১৯৯৫ – কঠোর নিষেধাজ্ঞা
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ইরানের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা দেন। মার্কিন কোম্পানিগুলোকে ইরানের সঙ্গে বাণিজ্য করতে নিষেধ করা হয়।
২০০২ – ‘অ্যাক্সিস অফ ইভিল’ ঘোষণা
৯/১১ হামলার পর প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ইরানকে ‘অ্যাক্সিস অফ ইভিল’-এর অংশ বলেন। এর ফলে দুদেশের সম্পর্ক আরও খারাপ হয়।
২০১৩-১৫ – পারমাণবিক চুক্তি
ওবামা সরকারের অধীনে দীর্ঘ আলোচনার পর ২০১৫ সালে ইরান পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত করতে রাজি হয়। এর বিনিময়ে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হয়।
২০১৮ – ট্রাম্প চুক্তি থেকে বেরিয়ে যান
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একতরফাভাবে চুক্তি থেকে সরে আসেন এবং আবার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। ইরানও পারমাণবিক কার্যক্রম সীমা ছাড়িয়ে চালাতে শুরু করে।
২০২০ – কাসেম সোলেইমানি হত্যাকাণ্ড
বাগদাদে ড্রোন হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের শীর্ষ জেনারেল সোলেইমানিকে হত্যা করে। ইরান এর প্রতিশোধে ইরাকে মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালায়।
২০২৫ – নতুন আলোচনার প্রস্তাব
মার্চ মাসে ট্রাম্প ইরানের সর্বোচ্চ নেতা খামেনির কাছে একটি চিঠি পাঠান নতুন চুক্তির জন্য। যদিও ইরান প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে, তবে পরবর্তীতে ওমান ও ইতালিতে অঘোষিত আলোচনা শুরু হয়।
২০২৫ – যুক্তরাষ্ট্রের হামলা
ইসরায়েলের হামলার সাতদিন পর, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলা চালায়। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, এ হামলা আত্মরক্ষা ও ইসরায়েলকে সহায়তার অংশ।
ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বহু জটিল ও দীর্ঘ ইতিহাসে গাঁথা। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো আবারও দেখিয়ে দিচ্ছে, এ দ্বন্দ্ব কতটা গভীর এবং কীভাবে এটি বিশ্ব রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে পারে।
মন্তব্য করুন