মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা এখন সর্বোচ্চ চূড়ায়। ইসরায়েল প্রথমে হামলা চালিয়েছে ইরানে, পালটা জবাবে প্রতিদিনই রকেট ছুড়ছে তেহরান। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে সমর্থন জানিয়ে শনিবার রাতে আঘাত হেনেছে ইরানের বেশ কয়েকটি পরমাণু স্থাপনায়।
তবে এত সব হামলার পরও থেমে নেই ইরান- নিয়মিতভাবে পালটা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরানের এই অব্যাহত জবাব দেওয়ার পেছনে অন্যতম শক্তির উৎস হলো তাদের ‘ভূগর্ভস্থ মিসাইল সিটি’।
ইরান তার দুর্গম ও পর্বতময় অঞ্চলের নিচে গড়ে তুলেছে গোপন সুড়ঙ্গের বিস্তৃত জাল। দেশটির ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি) যেসব ভূগর্ভস্থ অস্ত্রঘাঁটি গড়ে তুলেছে, সেগুলোর নাম ‘মিসাইল সিটি’।
এই ঘাঁটিগুলোয় গোপনে মজুত রাখা হচ্ছে ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন, বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এমনকি কিছু যুদ্ধজাহাজও। এগুলোর মধ্যে কিছু ঘাঁটি আবার সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদনের কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।
আইআরজিসির প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, এসব ঘাঁটির কোনোটি মাটির ৫০০ মিটার গভীরে নির্মিত, যার ওপরে রয়েছে একাধিক স্তরের কংক্রিটের সুরক্ষা। সুড়ঙ্গগুলো একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত এবং দেশব্যাপী ছড়িয়ে রয়েছে।
চলতি মাসের ১৩ জুন থেকে ইসরায়েল ধারাবাহিকভাবে ইরানের পরমাণু ও সামরিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও এতে কিছু কমান্ডার নিহত হয়েছেন, তবে এখনো পর্যন্ত ‘মিসাইল সিটি’গুলোতে বড় কোনো ক্ষয়ক্ষতির তথ্য পাওয়া যায়নি। কারণ এসব ঘাঁটি এতটাই গভীরে ও গোপনে যে মার্কিন ও ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার কাছেও সেগুলোর অবস্থান নিশ্চিত নয়।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিংক ট্যাঙ্ক এফডিডি-এর বিশ্লেষক বেহনাম বেন তেলেব্লু বলেন, উপগ্রহের নজর এড়িয়ে মজুত ও উৎক্ষেপণ করার উপযোগী করে ঘাঁটিগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। সেগুলো চিহ্নিত করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
বিবিসির ফার্সি বিভাগ বলছে, এসব ঘাঁটির ভেতরে রয়েছে রকেট লঞ্চারসহ ট্রাকের সারি, যেগুলো মাটির নিচ দিয়ে সরে গিয়ে নির্ধারিত স্থানে গিয়ে রকেট উৎক্ষেপণ করে। এমন একটি ভিডিওতে দেখা যায়, সমুদ্রতীরবর্তী একটি ট্রাক থেকে সরাসরি রকেট ছোড়া হচ্ছে।
ইরান দাবি করে, তাদের হাতে থাকা সেজ্জিল, এমাদ, খেইবার শেকান, হজ কাসেম, কদর-এইচ এবং পাভেহ্ ক্ষেপণাস্ত্র দুই হাজার কিলোমিটার দূর পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। এর ফলে শুধু ইসরায়েল নয়, সৌদি আরব, ভারত, এমনকি রাশিয়া ও চীনও এর আওতায় পড়ে।
২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে ইরান যখন ইসরায়েলের ওপর হামলা চালায়, তখন এমাদ মিসাইল দিয়েই নেভাতিম বিমানঘাঁটিতে বড় ধরনের আঘাত হানা হয়। পাশাপাশি সেজ্জিল ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকেও চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছিল।
এখন প্রশ্ন উঠছে- এই মিসাইল সিটিগুলোর সঙ্গে কি ইরানের বিতর্কিত পারমাণবিক কর্মসূচির কোনো সংযোগ আছে? যুক্তরাষ্ট্রের থিংক ট্যাঙ্ক সিএসআইএস বলছে, ইরানের এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো পারমাণবিক ওয়ারহেড বহনে সক্ষম হলেও বর্তমানে তাতে পারম্পরিক বিস্ফোরক ব্যবহার করা হচ্ছে।
যুক্তরাজ্যের আরইউএসআই গবেষক সিদ্ধার্থ কৌশলের মতে, কারমানশাহ বা সাহাব-৩-এর মতো ঘাঁটিই পারমাণবিক অস্ত্র নিক্ষেপের জন্য সম্ভাব্য স্থান হতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত সরাসরি কোনো সংযোগের প্রমাণ মেলেনি।
আইএসডব্লিউ-এর তথ্যমতে, ইরান এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৭০টি ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে, যার বড় একটি অংশ এসেছে এই মিসাইল সিটি ঘাঁটি থেকেই। তবে সংঘাতের এই সময়ে এই হার কিছুটা কমে গেছে। সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, এর কারণ ইসরায়েলের আঘাতে কিছু উৎক্ষেপণ কেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া।
সম্প্রতি ইসরায়েল খোররামাবাদ, কারমানশাহ ও তাবরিজে ইরানের ভূগর্ভস্থ ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে বলে জানা গেছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত এসব ঘাঁটির সংখ্যা, অবস্থান ও কার্যক্রমের পুরো চিত্র স্পষ্ট নয়।
তেহরান থেকে প্রকাশিত তথ্য ও বিশ্লেষকদের ভাষ্য অনুযায়ী, ইরানের মিসাইল সিটিগুলো শুধু অস্ত্রের গুদাম নয়- এগুলোই এখন প্রতিরোধের প্রধান ভরকেন্দ্র। এই ঘাঁটিগুলোর অস্তিত্ব ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি বিরাট কৌশলগত চ্যালেঞ্জ। কারণ এখান থেকেই ইরান অদৃশ্য ঘাঁটি থেকে মুহূর্তেই ছুড়তে পারে বিধ্বংসী রকেট।
এখন দেখার বিষয়- ইসরায়েল কি সত্যিই এসব অদৃশ্য অস্ত্রঘাঁটি খুঁজে বের করে ধ্বংস করতে পারবে? না কি ইরানের এই ভূগর্ভস্থ ‘মিসাইল সিটি’ই পরিণত হবে মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ যুদ্ধের টার্নিং পয়েন্টে?
মন্তব্য করুন