মঙ্গলবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১ আশ্বিন ১৪৩২
মুজাহিদুল ইসলাম
প্রকাশ : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০:২৭ পিএম
আপডেট : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০:২৯ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
বিশ্লেষণ

ইসলামিক আর্মি গঠনের দিকে এগোচ্ছে মুসলিম বিশ্ব?

প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।

মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা যেন এক অশেষ ধারাবাহিকতা। ফিলিস্তিন, সিরিয়া, লেবানন কিংবা ইয়েমেন—যেখানেই চোখ রাখা যায়, সেখানেই আগুনের লেলিহান শিখা। তবে সাম্প্রতিক দোহা হামলা পরিস্থিতিকে এক নতুন মোড় দিয়েছে। কাতারের রাজধানীতে ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ শুধু হামাসের বৈঠককে লক্ষ্য করেই হয়নি, বরং পুরো আরব বিশ্বকে যেন প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ করেছে।

গত ৯ সেপ্টেম্বর দোহায় হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন পাঁচজন হামাস নেতা এবং একজন কাতারি নিরাপত্তা কর্মকর্তা। কাতারের মাটিতে এ হামলা আন্তর্জাতিক আইনের সরাসরি লঙ্ঘন হিসেবে সমালোচিত হচ্ছে। আরব বিশ্বে এই ঘটনাকে শুধু রাজনৈতিক আক্রমণ নয়, বরং নিরাপত্তার প্রতি সরাসরি হুমকি হিসেবেই দেখা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ইসলামি সামরিক জোট বা ইসলামিক আর্মির প্রশ্ন নতুন করে সামনে এসেছে।

ইরাকের প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান

ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শিয়া আল সুদানি সম্প্রতি আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন—মুসলিম দেশগুলোর আত্মরক্ষার জন্য যৌথ সামরিক বাহিনী গঠন এখন সময়ের দাবি। তার মতে, আরব ও ইসলামি দেশগুলো চাইলে শুধু সামরিক নয়, বরং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অংশীদারত্বেও একসঙ্গে এগোতে পারে। তিনি সতর্ক করে দেন যে ইসরায়েলি আগ্রাসন কাতারে থেমে থাকবে না; বরং এর প্রভাব গোটা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে।

আল সুদানির বক্তব্যের মূল বার্তাই হলো, যদি মুসলিম দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি নিরাপত্তা বাহিনী গড়ে তোলে, তবে ইসরায়েল কিংবা তার সমর্থকদের আগ্রাসন ঠেকানো সম্ভব হবে। এই বক্তব্য দোহায় আসন্ন আরব-ইসলামিক সম্মেলনের প্রেক্ষাপটে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

যৌথ আরব বাহিনীর পুরোনো প্রস্তাব

ইসলামি সামরিক জোটের ধারণা নতুন নয়। প্রায় এক দশক আগে মিসর এই উদ্যোগের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আরব বিশ্বে রাজনৈতিক মতপার্থক্য, আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং ভিন্ন ভিন্ন জোটগত সম্পর্কের কারণে সে সময় পরিকল্পনাটি এগোয়নি। এখন দোহা হামলার পর আবারও সেই প্রশ্ন সামনে এসেছে—মুসলিম দেশগুলো কি সত্যিই নিজেদের একটি সামরিক জোট গড়তে পারবে?

কাতারে অনুষ্ঠিতব্য জরুরি সম্মেলনে এ বিষয়টি আবার আলোচনায় আসছে। আরব দেশগুলোর নিরাপত্তা নীতি এবং প্রতিরক্ষা কৌশল নতুন করে বিবেচনা করা হচ্ছে।

উপসাগরীয় রাজনীতির টানাপড়েন

ইসরায়েলের হামলা ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ উপসাগরীয় দেশগুলো—বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)—বড় এক পরীক্ষার মুখে পড়েছে। ২০২০ সালে ইউএই ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছিল, যা তৎকালীন মার্কিন প্রশাসনের বড় একটি সাফল্য হিসেবে প্রচারিত হয়। কিন্তু দোহা হামলার পর এই সম্পর্কের ওপর নতুন করে চাপ তৈরি হয়েছে।

আমিরাতের পাশাপাশি সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, ওমান—সব দেশই এখন নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে বাধ্য হচ্ছে। যদি ইসলামি আর্মি গঠনের উদ্যোগ শক্তিশালী হয়, তবে এসব দেশের জন্য একধরনের কূটনৈতিক দ্বিধা তৈরি হবে। একদিকে পশ্চিমা জোটের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা, অন্যদিকে মুসলিম বিশ্বের অভ্যন্তরীণ ঐক্যের চাপ—দুটি বিষয়ই সমান্তরালে চলতে পারে না।

ফিলিস্তিন প্রশ্ন ও মুসলিম বিশ্বের ঐক্য

দোহা হামলার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রাম। গত দুই বছর ধরে গাজায় চলমান হত্যাযজ্ঞের বিষয়টি উল্লেখ করে ইরাকের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন—এখনই সময় মুসলিম দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার। ফিলিস্তিন ইস্যুই বহুদিন ধরে আরব বিশ্বকে একত্রিত করার মূল কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে।

তবে প্রশ্ন থেকেই যায়—এই ঐক্য কি বাস্তবে সামরিক রূপ নিতে পারবে? অতীতে আরব লীগ কিংবা ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) রাজনৈতিক প্রস্তাব, নিন্দা ও বিবৃতি দিলেও কার্যকর সামরিক উদ্যোগ নেয়নি। এখন দোহা হামলার পর জনমত আগের চেয়ে অনেক বেশি সংবেদনশীল। আরব বিশ্বের তরুণ প্রজন্ম সামাজিক মাধ্যমে ইসলামি আর্মির দাবিতে সরব।

সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

ইসলামি আর্মি গঠনের পথে কয়েকটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে—

প্রথমত, আরব দেশগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক বিভক্তি। সৌদি-ইরান প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা কাতার অবরোধের মতো ঘটনা অতীতে ঐক্যের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দ্বিতীয়ত, ভিন্ন ভিন্ন সামরিক জোট—যেমন ন্যাটোর মিত্র দেশ আমিরাত বা বাহরাইন—ইসরায়েলের বিপক্ষে কতটা সক্রিয় হবে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ।

তৃতীয়ত, অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং সামরিক প্রযুক্তির বৈষম্য। সব দেশই সমান অবদান রাখতে পারবে না।

তবু বাস্তবতা হলো—যদি মুসলিম দেশগুলো সত্যিই একটি যৌথ বাহিনী গড়ে তোলে, তবে সেটি কেবল ইসরাইল নয়, বরং বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্যেও নতুন মাত্রা যোগ করবে।

পরিশেষে

দোহা হামলা দেখিয়ে দিল—ইসরায়েল এখন আর কেবল গাজা বা লেবাননেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোতেও সরাসরি হামলা চালাতে দ্বিধা করছে না। এমন পরিস্থিতিতে ইসলামি আর্মির ধারণা শুধু রাজনৈতিক প্রতীকী বিষয় নয়; বরং বাস্তব চাহিদা হিসেবে সামনে এসেছে।

মুসলিম বিশ্ব কি সত্যিই ঐক্যবদ্ধ হয়ে সামরিক বাহিনী গঠন করবে, নাকি আবারও কূটনৈতিক জটিলতায় তা থেমে যাবে—এখন সেটিই বড় প্রশ্ন। তবে দোহা হামলা নিঃসন্দেহে এই প্রশ্নকে জোরালোভাবে সামনে এনেছে। আর ইতিহাস বলছে, যখনই আগ্রাসন সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখনই ঐক্যের আহ্বান আরও জোরালো হয়ে ওঠে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আর্থিকভাবে অসচ্ছল শিক্ষার্থীর পাশে দাঁড়ালেন ছাত্রদল নেতা

তিন জেলার ডিসিকে প্রত্যাহার

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুর্গাপূজার ছুটি কবে থেকে শুরু

ডাকসুর ভোট এবার ম্যানুয়ালি গণনার জন্য উমামার লিখিত আবেদন

আরও বাড়ল ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ

চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শুরুর আগে রিয়াল শিবিরে সুসংবাদ

সাতক্ষীরায় ৭ বস্তা পলিথিন পোড়ালেন ভ্রাম্যমাণ আদালত

‘আমার নাম স্বস্তিকা, বুড়িমা নই’ ক্ষোভ ঝাড়লেন স্বস্তিকা

এক দিনে ২৬ ব্যাংক থেকে ৩৫ কোটি ডলার কিনল বাংলাদেশ ব্যাংক

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক / ছয় লেনের পদক্ষেপ না নিলে কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি

১০

আদালতের বারান্দায় নৃশংস হামলা, বিচার চেয়ে কাঁদল ভুক্তভোগী পরিবার

১১

এবার হরতালের ডাক মুক্তিযোদ্ধা পরিবার-বস্তিবাসীর 

১২

বিদেশি নয়, মন টানে দেশি ছেলেই : সেমন্তী সৌমি

১৩

দুধ দিয়ে গোসল করে ২৫ বছরের সংসার ছাড়লেন লিটন

১৪

চাকসুর ভোটার তালিকায় এমফিল-পিএইচডির ৩৪৮ শিক্ষার্থী

১৫

অপরিকল্পিত সড়ক আর নানা অব্যবস্থাপনায় জলাবদ্ধ জামালপুর পৌরসভা

১৬

তারেক রহমানের নেতৃত্বে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা পাবে : আনোয়ার

১৭

এশিয়া কাপে ওমানকে ৪২ রানে উড়িয়ে দিল আমিরাত

১৮

শারদীয় দুর্গাপূজার প্রস্তুতি / প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে হিন্দু নেতাদের সাক্ষাৎ

১৯

সরকারি গাড়ি নেই লালমাই এসিল্যান্ড অফিসে, ব্যাহত জনসেবা

২০
X