অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা থেকে গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে নজিরবিহীন হামলা চালিয়েছে হামাস। হামাসের এই হামলার পর গাজায় পাল্টা বিমান হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। পাল্টাপাল্টি হামলায় এরই মধ্যে দুই দেশের নিহতের সংখ্যা ২২০০ ছাড়িয়েছে। আহত হয়েছে আরও কয়েক হাজার মানুষ। দুই দেশের মধ্যে এখনো লড়াই চলছে। ফলে হতাহতের এই সংখ্যা আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
দুই দেশের এমন যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে এখন একটি প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। সেটি হলো এই সংঘাত কোন দিকে গড়াবে। গত মঙ্গলবার (১০ অক্টোবর) এক লেখায় এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন ওয়াশিংটন ডিসি ভিত্তিক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (সিএসআইএস)-এর ট্রান্সন্যাশনাল থ্রেটস প্রজেক্টের গবেষণা সহযোগী আলেকজান্ডার পালমার এবং এই প্রজেক্টের সিনিয়র ফেলো ও জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড্যানিয়েল বাইম্যান।
গত ৭ অক্টোবর শনিবার ভোরে ইসরায়েলে বিভিন্ন দিক থেকে হামলা চালায় ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। এ হামলায় বহু ইসরায়েলি নিহত হয়েছে। আরও ১৫০ জনের মতো ইসরায়েলি সামরিক ও বেসামরিক নাগরিককে জিম্মি করে গাজা উপত্যকায় নিয়ে গেছে হামাস যোদ্ধারা। হামাসের হামলার জবাবে গাজায় পাল্টা বিমান হামলা শুরু করেছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী (আইডিএফ)। ইসরায়েলি বাহিনীর টানা পাঁচ দিনের বিমান হামলায় শত শত ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। গাজায় খাদ্য, পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে চারদিক থেকে সম্পূর্ণ অবরোধ আরোপ করে রেখেছে ইসরায়েলি সেনারা। এমনকি হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে নেতানিয়াহু সরকার।
এবারে হামাসের হামলা একেবারে নজিরবিহীন। এর আগেও হামাস ইসরায়েলে রকেট ছুড়েছে, অনুপ্রবেশ করে ইসরায়েলিদের জিম্মি করেছে। তবে এবারের হামলায় এরই মধ্যে ইসরায়েলে নিহতের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে, যা ২০০৭ সাল থেকে হামাসের সব হামলা মিলিয়ে যত মানুষ নিহত হয়েছে তার চেয়েও বেশি। এমনকি এবার মাত্র ২০ মিনিটে পাঁচ হাজার রকেট ছুড়েছে হামাস যোদ্ধারা। তাদের কিছু রকেট ইসরায়েলের রাজধানী তেলআবিবে পর্যন্ত আঘাত হেনেছে।
এ হামলার পর ফিলিস্তিন, ইসরায়েল ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি কোন দিকে মোড় নেবে, তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে। তবে এখন এটা নিশ্চিত যে ইসরায়েল কড়া জবাবে দেবে। আগামী কয়েক দিনের ভেতরই স্পষ্ট হয়ে যাবে হামাসের হামলার জবাবটা আসলে ঠিক কীভাবে দেবে ইসরায়েল। তবে হামাসের এই নজিরবিহীন হামলার পুরোপুরি প্রভাব বুঝতে আরও কয়েক মাস বা এমনকি বছর লেগে যাবে।
গাজা নিয়ে এবার ইসরায়েলের হাতে তেমন ভালো বিকল্প নেই। এটা ঠিক, ইসরায়েলি সেনারা গাজায় অব্যাহত বিমান হামলা চালাচ্ছে। তাদের এসব হামলায় ২৩ লাখ মানুষের এই অঞ্চলে ইসরায়েলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা বা হামাসের ওপর বিজয় হিসেবে সম্ভবত দেখা হবে না। এমনকি এর মাধ্যমে হামাসের বিজয়কে অস্বীকার করাও যাবে না। গাজায় সম্পূর্ণ অবরোধ আরোপও যথাযথ হবে না। যদিও ইসরায়েলিদের এই অবরোধ ফিলিস্তিনিদের ওপর ভয়াবহ হবে। জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত বলেছেন, হামাসের সক্ষমতা একেবারে নির্মূল করে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে ইসরায়েল। আর এটি বিমান হামলা বা অবরোধের মাধ্যমে সম্ভব নয়।
এর ফলে গাজায় স্থল হামলার পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে পারে ইসরায়েল। তবে এ ধরনের হামলা ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর জন্য বেশ কঠিন হবে। একই সঙ্গে বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের ওপর এই হামলার প্রভাব ভয়াবহ হবে। গাজা বিশ্বের অন্যতম জনবহুল এলাকা। সামরিক হামলার ক্ষেত্রে শহুরে হামলা সবচেয়ে ভয়াবহ ও প্রাণঘাতী হয়ে থাকে। এ ধরনের হামলা নিয়ে কিছুটা ধারণা পেতে ২০১৪ সালে গাজায় ইসরায়েলি সেনাদের অপারেশন প্রোটেকটিভ এজের কথা বলা যায়। দুই সপ্তাহের ওই হামলায় দুই হাজার ফিলিস্তিনি, ৬৬ ইসরায়েলি সেনা এবং ছয় বেসামরিক ইসরায়েলি নিহত হয়েছিল। ফিলিস্তিনি নিহতদের মধ্যে পাঁচশ শিশু ছিল।
গাজা ছাড়াও ইসরায়েলকে আরও দুটি ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে হতে পারে। দুই ফ্রন্টের প্রথমটি হলো লেবানন সীমান্ত সংলগ্ন ইসরায়েলের উত্তর এলাকায়। এরই মধ্যে লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র ও মর্টার শেল নিক্ষেপ করেছে। এ ছাড়া ইসরায়েলি সেনারাও জানিয়েছে, তারা হিজবুল্লাহর বেশ কয়েকজন সদস্যকে হত্যা করেছে। একই সঙ্গে লেবাননের ওই এলাকায় বিমান হামলা চালাচ্ছে। ওই সীমান্ত এলাকায় পরিস্থিতি এখনো অনিশ্চিত এবং খুব দ্রুতই পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে।
দ্বিতীয়টি হলো পশ্চিম তীর। হামাসের এই হামলার আগ থেকেই পশ্চিম তীরের পরিস্থিতি উত্তপ্ত। পশ্চিম তীরে সহিংসতা এমনভাবে বেড়েছে যে বিশ্লেষকরা তৃতীয় ইন্তিফাদার কথা বলছেন। এর আগেও গাজায় ইসরায়েল কোনো সামরিক তৎপরতা চালালে পশ্চিম তীরে বড় ধরনের বিক্ষোভ হয়েছে। ফলে এবার যে এর ব্যতিক্রম হবে, এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। ইসরায়েল এরই মধ্যে এই বছর পশ্চিম তীরের জেনিন শরণার্থী শিবিরে বড় ধরনের স্থল হামলা করেছে। এমন পরিস্থিতিতে মাহমুদ আব্বাসের ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ সেখানের জনরোষ দমনে ব্যর্থ হলে ইসরায়েলকে আবারও হস্তক্ষেপ করতে হতে পারে।
ইসরায়েল যদি গাজায় পূর্ণ সামরিক শক্তি নিয়ে হামলা করেই, তাহলে দেশটি দুটি প্রশ্নের মুখোমুখে হবে। হয় ইসরায়েলকে হামাস অক্ষত রেখে তাদের হাতেই গাজার নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিতে হবে; নয়তো সেখানে হামাসের শাসনের অবসান ঘটাতে হবে। ২০০৭ সাল থেকে গাজা অঞ্চল কার্যত শাসন করছে হামাস। তবে ইসরায়েল যদি হামাসকে গাজার শাসন ক্ষমতা থেকে সরিয়েও দেয় তাহলে সেখানে শাসন ক্ষমতায় কে আসবে, সে প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দেবে। গাজায় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের তেমন রাজনৈতিক সমর্থন না থাকায় হামাসের পরিবর্তে সেখানে ক্ষমতায় আসার মতো মধ্যপন্থি ফিলিস্তিনি দল নেই। এমন পরিস্থিতিতে গাজাকে নিজেদের সরাসরি দখলে নিতে হবে ইসরায়েলকে, যা তাদের জন্য তেমন লাভজনক হবে না।
ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত আকারে অনূদিত।
ভাষান্তর : মোহাম্মদ শাহীন
মন্তব্য করুন