ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের যুদ্ধ আজ রোববার (৭ এপ্রিল) ছয় মাস পার হয়ে সাত মাসে গড়িয়েছে। ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় গাজা মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। ঘরবাড়ি ছাড়া হয়েছেন আরও লাখ লাখ মানুষ। ইসরায়েলি বাহিনী পূর্ণ অবরোধ আরোপ করে রাখায় গাজায় ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এতকিছুর পরও ইসরায়েলের তরফ থেকে যুদ্ধ বন্ধের কোনো লক্ষণ নেই। বিশ্বজুড়ে যেখানে গাজায় যুদ্ধ বন্ধের দাবি জোরালো হচ্ছে সেখানে তেল আবিবের মিত্ররা ইসরায়েলকে যুদ্ধের পক্ষে রাজনৈতিক সমর্থনের পাশাপাশি দেদার মারণাস্ত্র দিয়ে যাচ্ছে।
ছয় মাস ধরে ইসরায়েলি হামলায় গাজায় প্রাণহানি ও ধ্বংসযজ্ঞের ভয়াবহ চিত্র একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা।
কত মানুষ হতাহত হলেন?
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, গত ৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরুর পর থেকে গাজায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর হাতে অন্তত ৩৩ হাজার ১৩৭ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এ ছাড়া হামলায় ধসে পড়া ভবন ও ধ্বংসস্তূপের নিচে আরও হাজার হাজার মানুষ নিখোঁজ রয়েছে। তারা সবাই মারা গেছেন বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
নিহতদের অধিকাংশ নারী ও শিশু। সেভ দ্য চিলড্রেনের তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলি হামলায় গাজায় ১৩ হাজার ৮০০ জনের বেশি শিশু নিহত হয়েছে। এ ছাড়া ১৭ হাজারের মতো ফিলিস্তিনি শিশু বর্তমানে বাবা-মা ছাড়া বসবাস করছে।
অন্যদিকে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৭৫ হাজার ৮১৫ জন আহত হয়েছে। এর মানে হলো গাজায় প্রতি ১০০ জনের মধ্যে চারজন মানুষ আহত হয়েছেন। প্যালেস্টাইন রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী, গাজার প্রায় এক হাজার শিশু তাদের একটি বা দুটি পা হারিয়েছে। এ ছাড়া ইসরায়েলি হামলায় প্রতিদিন শত শত মানুষ হতাহত হচ্ছে।
মানুষ কি অনাহারে থাকছেন?
গাজায় মানবিক পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য অবনতি হয়েছে। কারণ ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজায় ত্রাণসহায়তা প্রবেশে বাধা দিচ্ছে। তারা ক্ষুধাকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবাহর করছে। বর্তমানে ২৩ লাখ ফিলিস্তিনি অনাহারে ভুগছে। জাতিসংঘ বলছে, মে মাসের মধ্যে গাজার বিভিন্ন অংশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে।
উত্তর গাজায় পানিশূন্যতা ও অপুষ্টির শিকার হয়ে শিশুদের মৃত্যুর খবর আসছে। এরপরও সেখানে মানবিক ত্রাণসহায়তা প্রবেশে বাধা দিচ্ছে ইসরায়েল।
কত মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন?
উত্তর গাজা থেকে স্থল অভিযান শুরু করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। তাই যুদ্ধের শুরু থেকে ফিলিস্তিনিদের দক্ষিণে সরে যেতে নির্দেশ দিয়ে আসছে তারা। এরপর থেকে উত্তর গাজায় কেউ তাদের বাড়িতে ফিরতে পারেনি। কেননা গাজা উপত্যকাকে দুই ভাগে ভাগ করে মাঝখানে একটি সামরিক করিডোর স্থাপন করেছে ইসরায়েল।
বর্তমানে ১৯ লাখ ফিলিস্তিনি ঘরবাড়ি ছাড়া। এই সংখ্যাটা গাজার মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ। ঘরবাড়ি ছাড়া এসব মানুষের বেশিরভাগ স্কুল ও হাসপাতালের মতো জাতিসংঘের স্থাপনায় আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। এসব জায়গায় আশ্রয় নিয়েও ইসরায়েলি হামলা থেকে রক্ষা পায়নি তারা। আশ্রয়কেন্দ্রে ৪০০ জনের বেশি নিহত এবং কমপক্ষে এক হাজার ৪০০ জন আহত হয়েছে।
কতটা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে?
শুরু থেকেই ইসরায়েলি হামলার প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়েছে ছোট এই উপত্যকার বিভিন্ন স্থাপনা। ফলে গাজার বিভিন্ন জরুরি স্থাপনা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে থাকে ইসরায়েলি সেনারা। ইসরায়েলি এই ধ্বংসযজ্ঞ এতই ভয়াবহ ছিল, যুদ্ধের মাত্র চার মাসে প্রায় সাড়ে ১৮ বিলিয়ন বা এক হাজার ৮৫০ কোটি ডলারের অবকাঠামো হারিয়েছেন ফিলিস্তিনিরা।
মঙ্গলবার (৩ এপ্রিল) জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য ওঠে এসেছে। প্রতিবেদন বলছে, ইসরায়েলি হামলায় গাজায় চার মাসে যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা ২০২২ সালে অধিকৃত পশ্চিম তীর ও গাজার সম্মিলিত জিডিপির ৯৭ শতাংশের সমান।
হাসপাতাল সচল আছে কি?
আন্তর্জাতিক আইনে যুদ্ধের মাঝে হাসপাতাল সুরক্ষিত রাখার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক আইনের পরোয়া না করে শুরু থেকেই গাজার হাসপাতালে তাণ্ডব চালিয়ে আসছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। গাজার সব হাসপাতাল ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে। বর্তমানে ৩৬টি হাসপাতালের মধ্যে মাত্র ১০টি আংশিকভাবে সচল রয়েছে। তবে এসব হাসপাতালে রোগীদের উপচে পড়া ভিড় লেগেই থাকে।
গাজার সবচেয়ে বড় হাসপাতাল আল-শিফা ও এর আশপাশের এলাকায় দুই সপ্তাহ থরে অবরোধ আরোপ করে রাখে নেতানিয়াহু বাহিনী। এই সময় হাসপাতালটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া অন্তত ৪০০ জন মানুষ নিহত হয়েছে এবং আরও শতাধিক গ্রেপ্তার হয়েছেন।
মন্তব্য করুন