ভারতশাসিত কাশ্মীরে গত ২২ এপ্রিল একটি ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ভারত তার প্রতিটি সন্ত্রাসী এবং তাদের মদতদাতাদের খুঁজে বের করবে এবং তাদের উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করবে।
এ হামলা কাশ্মীরে ১৯৮৯ সালের বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর থেকে সবচেয়ে বড় এবং ভয়াবহ হামলা হিসেবে গণ্য হচ্ছে। বিশেষভাবে এটি ২০১৯ সালে ভারতের আধাসামরিক বাহিনীর ওপর আত্মঘাতী হামলার পর সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলা।
এই ঘটনার পর ভারত প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ হিসেবে ২৭ এপ্রিল দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র মহড়া চালিয়েছে। এর পাশাপাশি পাকিস্তানের কয়েকজন কূটনীতিককে বহিষ্কার করা হয়েছে এবং ১৯৬০ সালের সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিত করা হয়েছে। দুই দেশের সীমান্তে নতুন করে গোলাগুলি শুরু হয়েছে, যা সংঘর্ষের আশঙ্কা বাড়াচ্ছে।
প্রমাণ দিতে হবে ভারতকে
ভারত সন্ত্রাসী হামলার প্রতি প্রতিক্রিয়া জানাতে চাইলে প্রথমত প্রমাণের প্রয়োজন। ইতোমধ্যে স্থানীয় পুলিশ দুই পাকিস্তানি এবং এক ভারতীয় সন্দেহভাজনের সন্ধানে রয়েছে। ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ) নামে একটি গোষ্ঠী হামলার দায় প্রথমে স্বীকার করলেও পরে দাবি করেছে, তাদের সামাজিক মাধ্যম অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়েছিল। ২০১৯ সালে ভারতের কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পর টিআরএফ গঠিত হয় এবং ২০২৩ সালে ভারত সরকার এটিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
ভারতীয় গোয়েন্দারা বিশ্বাস করেন, টিআরএফ একটি পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তৈয়বার (এলইটি) ছদ্মবেশী শাখা। এলইটি পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক বজায় রেখেছে এবং ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার জন্য দায়ী, যেখানে প্রায় ১৭০ জন নিহত হন। তবে টিআরএফের সঙ্গে সরাসরি এলইটির সম্পর্কের প্রমাণ এখনো মেলেনি।
ভারতের দ্বিতীয় শর্ত হলো, তাদের প্রতিক্রিয়া কৌশলগতভাবে কার্যকর হতে হবে এবং ভারতের সামরিক, রাজনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক লক্ষ্যগুলির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। ২০১৬ এবং ২০১৯ সালের হামলার পর ভারত পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরে বিমান হামলা এবং বিশেষ অভিযান চালিয়েছিল। মোদি সরকার ২০১৯ সালে কাশ্মীরকে সরাসরি শাসনের আওতায় এনে শান্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তবে এখন তিনি রাজনৈতিকভাবে চাপের মুখে আছেন এবং নিজের শক্তিশালী নেতৃত্বের পরিচয় দিতে প্রতিশোধ নিতে আগ্রহী হতে পারেন।
সামরিক প্রতিক্রিয়া : সংযত থাকতে হবে
যদিও ভারত সীমিত সামরিক প্রতিক্রিয়া দেখানোর কথা ভাবছে, তবে তা দ্রুত বড় আকার ধারণ করতে পারে। পাকিস্তান ইতোমধ্যেই একটি ভারতীয় ড্রোন ভূপাতিত করেছে এবং ভারতে সম্ভাব্য হামলার বিষয়ে সতর্ক করেছে।
২০১৯ সালের মতো সংঘর্ষ শুরু হলে পাকিস্তান হয়তো আগের মতো নমনীয় থাকবে না। বর্তমান পাকিস্তানি সেনাপ্রধান আসিম মুনির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপ থেকে নজর সরানোর জন্য ভারতকে উসকানি দিতে পারেন। একবার যুদ্ধ শুরু হলে তা থামানো কঠিন হতে পারে, যা দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল করে তুলবে।
এ কারণে, ভারতকে হামলার প্রকৃত উৎস নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত সংযত থাকতে হবে। যদি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বা সামরিক ঘাঁটিতে হামলা হয়, তবে তা যুক্তিসঙ্গত হতে পারে। তবে যদি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততার নিশ্চিত প্রমাণ না পাওয়া যায়, তবে সেনা ঘাঁটিতে হামলা ন্যায্য হবে না।
যুদ্ধ ছাড়াও অন্য কৌশল
যুদ্ধের বিকল্প হিসেবে ভারতের হাতে কিছু অন্যান্য কৌশলও রয়েছে। ভারত আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রমাণ প্রকাশ করে পাকিস্তানকে লজ্জিত করতে পারে অথবা পাকিস্তানের জন্য আইএমএফের ৭০০ কোটি ডলারের তহবিল বন্ধ করার চেষ্টা চালাতে পারে।
ভারত যদি পানিচুক্তি স্থগিত করেও পানিপ্রবাহ বন্ধ না করে, তাও একটি শক্তিশালী বার্তা হতে পারে, পাকিস্তান তার প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে গঠনমূলক সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে উপকৃত হতে পারে।
মোদি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মোদিকে দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গিতে চিন্তা করতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রধান শক্তি হিসেবে ভারত যে ভূমিকা নিতে চায়, পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ সেই লক্ষ্য ব্যাহত করতে পারে। চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য যুদ্ধের সুযোগ নেওয়ার পরিকল্পনাও বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
তাই, ভারতের উচিত সামরিক আধুনিকায়নে মনোযোগ দেওয়া, যা পাকিস্তানকে মোকাবিলা করতে এবং চীনের সঙ্গে শক্তির ভারসাম্য তৈরি করতে সাহায্য করবে। বাস্তবিক অর্থে, ভারতের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান নয়, বরং চীন।
এভাবে ভারত যদি সতর্ক এবং কৌশলগতভাবে এগিয়ে যায়, তাহলে কেবল পাকিস্তান নয়, দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতি সমাধান করা সম্ভব হতে পারে।
মন্তব্য করুন