দক্ষিণ এশিয়া আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। কাশ্মীরের পেহেলগামে হামলার পর ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে দ্রুত অবনতি ঘটেছে। সীমান্তে গুলির লড়াই, কূটনৈতিক হুমকি, যুদ্ধ মহড়া, আকাশ ও স্থলসীমা বন্ধের মতো পদক্ষেপ এবং চীনের প্রকাশ্য পাকিস্তান-সমর্থন— এ সব কিছুর মধ্য দিয়ে আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি এক ভয়াবহ মোড় নিচ্ছে। ভারত ক্রমেই একঘরে হয়ে পড়ছে এই অঞ্চলে, আর চীন-পাকিস্তান জোট আগের চেয়ে অনেক বেশি সক্রিয় ও সংঘবদ্ধ। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশও নিজের নিরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে নতুন করে ভাবছে।
কাশ্মীর ইস্যু ও সীমান্তে যুদ্ধ-পরিস্থিতি
পেহেলগাম হামলার সূত্র ধরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনার মাত্রা দ্রুত বেড়েছে। ভারত যদিও সরাসরি পাকিস্তানকে দায়ী করেনি, তবে ভিসা বাতিল, কূটনীতিক বহিষ্কার এবং সিন্ধু নদের পানি চুক্তি স্থগিতের মতো পদক্ষেপে তাদের মনোভাব স্পষ্ট। পাল্টা জবাবে পাকিস্তানও আকাশসীমা বন্ধসহ একাধিক কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই অবস্থান দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা যে শুধু কূটনৈতিক স্তরে সীমাবদ্ধ নয়, তা সীমান্তে গোলাগুলি ও সামরিক মহড়ায় রূপ নিয়েছে।
যুদ্ধ হলে ভারতের পরাজয় নিশ্চিত, কারণ তাকে পাকিস্তানের পাশাপাশি চীনকেও মোকাবিলা করতে হবে
সম্প্রতি কিয়ানি ও মন্ডল সেক্টরে হামলার জবাবে পাকিস্তানি বাহিনী একটি ভারতীয় চেকপোস্ট ধ্বংস করেছে। এসব ঘটনাকে সীমান্তে সরাসরি সামরিক সংঘর্ষের আলামত হিসেবে দেখা হচ্ছে। এ পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট। দেশটিতে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও হিন্দুত্ববাদের প্রবল উত্থান দেখা যাচ্ছে, এতে আন্তর্জাতিকভাবে কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতায় পড়ছে।
পাকিস্তান-চীন কৌশলগত সম্পর্ক ও ভারতের উদ্বেগ
এই সংকটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক। লাহোরে চীনা কনসাল জেনারেল ঝাও শিরেন প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, ‘চীন পাকিস্তানের পাশে ছিল, আছে এবং থাকবে।’ এটি শুধু এক কূটনৈতিক বার্তা নয়; বরং ভারত ও তার মিত্রদের উদ্দেশ্যে একটি কৌশলগত সতর্কবার্তা। চীনের এই অবস্থান পাকিস্তানকে মনোবল ও কৌশলগত আশ্রয় দিয়েছে।
চীন এরইমধ্যেই পাকিস্তানে অবকাঠামো, প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তিতে বিপুল বিনিয়োগ করেছে। চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর (সিপিইসি) এবং গোয়াদার বন্দর নিয়ে তাদের পারস্পরিক নির্ভরতা অনেক বেড়েছে। ফলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের যেকোনো আগ্রাসন সরাসরি চীনের স্বার্থে আঘাত বলে গণ্য হতে পারে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের সাবেক কংগ্রেস বিধায়ক ইউডি মিঞ্জকের বিতর্কিত এক পোস্টে লিখেন ‘যুদ্ধ হলে ভারতের পরাজয় নিশ্চিত, কারণ তাকে পাকিস্তানের পাশাপাশি চীনকেও মোকাবিলা করতে হবে।’ এমন পরিস্থিতিতে ভারত একসঙ্গে দুই শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঝুঁকি নেবে কিনা, তা এখন বড় প্রশ্ন।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হই হই অবস্থার মধ্যে রয়ে গেছে। যেন আজকেই শুরু হয়ে যাবে যুদ্ধ। প্রস্তুতি না নেওয়াটা আত্মঘাতী
চীনের উত্থান ও পাকিস্তানের ওপর সরাসরি সমর্থন এক নতুন ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি করেছে। ভারতের এই সংকটকালে ঐতিহ্যগত মিত্র যেমন রাশিয়া, ইরান বা যুক্তরাষ্ট্রও অনেকটাই সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। ফলে ভারত ক্রমেই নিজ অঞ্চলে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশের কৌশলগত হিসাব-নিকাশ ও নিরাপত্তা প্রস্তুতি
এই ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে বাংলাদেশ নিজেদের অবস্থান নিয়ে সতর্ক। বিশেষ করে, ভারতের বিরুদ্ধে সীমান্তে নজরদারি বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সহিংসতা উসকে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এমন পরিস্থিতি বাংলাদেশকে সীমান্ত নিরাপত্তা, সামরিক প্রস্তুতি ও কূটনৈতিক ভারসাম্য নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি বলেছেন, ‘ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হই হই অবস্থার মধ্যে রয়ে গেছে। যেন আজকেই শুরু হয়ে যাবে যুদ্ধ। প্রস্তুতি না নেওয়াটা আত্মঘাতী। আধাআধি প্রস্তুতির কোনো জায়গা নাই।’ তার এমন মন্তব্য শুধু সাধারণ সতর্কবার্তা নয়, বরং এটি দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে একটি সক্রিয়, বাস্তববাদী অবস্থানের ইঙ্গিত দেয়। দেশপ্রেম, পেশাদারিত্ব ও আধুনিক প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিয়ে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা মূলত একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা কাঠামো গঠনের নির্দেশ বহন করে।
সরকার এরইমধ্যেই বিমানবাহিনীকে আধুনিকায়নের জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, যার মধ্যে যুদ্ধবিমান, এয়ারক্রাফ্ট ক্যারিয়ার ও রাডার প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। নিয়মিত অনুশীলন এবং আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। স্পষ্টতই, বাংলাদেশ আঞ্চলিক সংকটে নিজেকে শুধু দর্শক নয়, বরং প্রস্তুত কৌশলগত খেলোয়াড় হিসেবে গড়ে তুলতে চায়।
চীন পাকিস্তানের পাশে ছিল, আছে এবং থাকবে
বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে তা সরাসরি বাংলাদেশের নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতায় প্রভাব ফেলতে পারে। সীমান্তে শরণার্থী প্রবাহ, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, বৈদেশিক বিনিয়োগে স্থবিরতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা—সবকিছুই বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে।
আঞ্চলিক ভূরাজনীতি ও বাংলাদেশের অবস্থান
বাংলাদেশের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ‘নিরপেক্ষতা’ ও ‘সতর্কতার’ সঙ্গে কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষা করা। ভারত যদি চীন-পাকিস্তান জোটের বিরোধিতায় সরাসরি পথে নামে, তবে বাংলাদেশের ওপর চাপ তৈরি হবেই। একদিকে ভারতের সঙ্গে ঐতিহাসিক ও ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্ক; অন্যদিকে চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক নির্ভরতা ও অবকাঠামো সহযোগিতা— এই দুইয়ের মধ্যে কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষা করাটাই বাংলাদেশের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।
বাংলাদেশকে এই মুহূর্তে তিনটি স্তরে কৌশল তৈরি করতে হবে—
সীমিত সংঘর্ষ না পূর্ণ যুদ্ধ?
যদিও এখনো পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের সম্ভাবনা কম বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তবুও সীমিত সংঘর্ষের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। সীমান্তে রকেট হামলা, বিমান প্রতিরক্ষা সক্রিয়করণ ও সামরিক মহড়াগুলো যুদ্ধ প্রস্তুতিরই ইঙ্গিত দিচ্ছে, যা শিগগির নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
দুই পরমাণু শক্তিধর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আশঙ্কা শুধু দুই দেশের জন্য নয়, বরং পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এক গভীর বিপর্যয়ের আশঙ্কা তৈরি করছে। এর অর্থনৈতিক, মানবিক ও পরিবেশগত মূল্য হবে ভয়াবহ। এ প্রেক্ষাপটে চীন-পাকিস্তান ঘনিষ্ঠতা যেমন ভারতের কূটনৈতিক অবস্থান দুর্বল করছে, তেমনি বাংলাদেশের জন্য তৈরি করছে এক কৌশলগত বাস্তবতা, যেখানে ভুল সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী হতে পারে।
বাংলাদেশের জন্য এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো সঠিক সময়ে, সঠিক প্রস্তুতি নেওয়া। শুধু অস্ত্র বা সামরিক মহড়ায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং কূটনৈতিকভাবে বহুমাত্রিক জোট, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং জনমনে আত্মবিশ্বাস তৈরি করা। যুদ্ধ না চাইলেও, যুদ্ধের প্রস্তুতি রাখতে হবে— আর সেটিই আজকের পৃথিবীর বাস্তবতা।
মন্তব্য করুন