দক্ষিণ এশিয়ার দুই পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রের লড়াই আপাতত থেমেছে। তবে থেমে থাকেনি বৈরিতা। এবার নতুন উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে ইন্দাস (সিন্ধু) নদীর পানি, যা ঘিরে রয়েছে বহু বছরের পুরোনো এক চুক্তি, আর সেই চুক্তি নিয়েই এবার দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদ।
এপ্রিল মাসে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে এক সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জনের প্রাণহানির পর ভারত সরাসরি পাকিস্তানকে সীমান্তপারের জঙ্গিদের মদদদাতা হিসেবে অভিযুক্ত করে। এর পরপরই নয়াদিল্লি জানায়, তারা ১৯৬০ সালের ইন্দাস পানি চুক্তি ‘কার্যত স্থগিত’ রাখবে।
চুক্তিটি দুই দেশের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইন্দাস নদীর পানি কয়েক কোটি মানুষের জীবন, কৃষি ও অর্থনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ভারতের এই পদক্ষেপে পাকিস্তান চরম উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং একে ‘যুদ্ধের ঘোষণা’ বলে আখ্যায়িত করে।
বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের সিদ্ধান্ত শুধু সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার কৌশল নয়, বরং বহুদিনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। ভারতের মতে, ১৯৬০ সালের চুক্তিটি পাকিস্তানপক্ষে পক্ষপাতমূলক এবং তা ভারতের জন্য পানি ব্যবহারে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে ভারত চুক্তির শর্ত পুনর্বিবেচনায় আগ্রহী।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিষয়টিকে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগিয়ে বলেন, ‘আমরা শুধু বলেছি চুক্তি স্থগিত করেছি, আর ওরা (পাকিস্তান) ঘামতে শুরু করেছে।’
ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের পর দীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে ১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় ইন্দাস পানি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী, পাকিস্তান সিন্ধু নদীর পশ্চিমাঞ্চলের তিনটি শাখা (ইন্দাস, ঝেলাম, চেনাব) পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারে।
আর ভারত পূর্বের তিনটি শাখা (রবি, বিয়াস, সুতলজ) ব্যবহার করে। ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের নদীগুলোতে সীমিত পরিমাণ পানি ব্যবহার, সেচ ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনুমতি থাকলেও, পাকিস্তান তা নিয়েও বহুবার আপত্তি জানিয়েছে।
জল ও সংঘাত বিষয়ক বিশ্লেষক ব্রহ্ম চেলানির মতে, চুক্তির আওতায় পাকিস্তানকে ইন্দাস নদীর প্রায় ৮০ শতাংশ পানি দেওয়া হয়, যা এক ধরনের ‘অসাধারণ উদারতা’।
যদিও চুক্তির আওতায় নিরপেক্ষ সালিশ ব্যবস্থা, যৌথ কমিশন এবং তথ্য আদান-প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে, কিন্তু পারস্পরিক অবিশ্বাস চুক্তির বাস্তবায়নে বারবার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
১৯৯২ সালের বন্যায় পাকিস্তান অভিযোগ করে যে, ভারত পূর্ব সতর্কতা না দিয়েই বাঁধ খুলে দিয়েছে। ভারত দাবি করে, নিয়ম মেনেই কাজ করা হয়েছে। তদুপরি, ভারতের বাঁধ প্রকল্পগুলোর (যেমন কিশেনগঙ্গা) বিরুদ্ধে পাকিস্তানের বিরোধ দীর্ঘদিনের।
২০১৬ ও ২০১৯ সালে কাশ্মীরের জঙ্গি হামলার পরও ভারত পানি প্রবাহ কমানোর হুমকি দিয়েছিল, কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। এবার যদিও ভারত পুরোপুরি চুক্তি থেকে সরে আসেনি, তবে ‘কার্যত স্থগিত’ রাখার সিদ্ধান্তই নতুন উদ্বেগ তৈরি করেছে।
পাকিস্তানের বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ভারতের দেওয়া তথ্য ছাড়া বন্যা মোকাবিলা ও কৃষিকাজে সমস্যা হতে পারে। কারণ ভারতের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই পাকিস্তান বরফ গলা পানি, স্লুইস গেট খোলা এবং বৃষ্টিপাতের বিষয়ে প্রস্তুতি নিয়ে থাকে।
সাবেক পাকিস্তানি কমিশনার শিরাজ মেমন জানান, ভারতের দেওয়া তথ্য আগে থেকেই সীমিত ছিল- মাত্র ৪০ শতাংশ। আর এখন কার্যত তা বন্ধ। আরেক সাবেক কর্মকর্তা ফজলুল্লাহ কুরেশি বলেন, তথ্য না থাকায় ২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যার আগাম পূর্বাভাস দেওয়া যায়নি, যা ১,৭০০ প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল।
ভারতের জনসংখ্যা বর্তমানে ১৪০ কোটির কাছাকাছি এবং পানির চাহিদা বাড়ছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের মাত্র ৪ শতাংশ জলসম্পদ থাকা সত্ত্বেও ভারতের জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১৮ শতাংশ। এ ছাড়া নাসার তথ্য বলছে, সিন্ধু অববাহিকা বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পানি সংকটপূর্ণ ভূগর্ভস্থ জলাশয়।
সরকারি তথ্যে বলা হয়েছে, ভারত এখনো পূর্বাঞ্চলের নদীগুলোর পানিও পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারেনি। বিশ্লেষকরা বলছেন, যথাযথ অবকাঠামো না থাকায় বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি পাকিস্তানে চলে যায়।
আইআইটি গান্ধীনগরের অধ্যাপক ভিমল মিশ্র বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতায় চুক্তিটির আধুনিকায়ন দরকার। বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে পানি ব্যবস্থাপনায় সংস্কার এখন সময়ের দাবি।
যদিও সামরিক সংঘাত এখন স্থগিত, তবে পানি নিয়ে উত্তেজনার এ নতুন অধ্যায় দুই দেশের সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলছে। সিন্ধু নদী একসময় দুই জাতির সভ্যতা গড়ার উৎস ছিল- আজ তা রূপ নিয়েছে কূটনৈতিক দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংকট সমাধানে দরকার পারস্পরিক আস্থা ও জলবায়ু সংবেদনশীল আলোচনার টেবিল; না হলে দুই দেশের ভবিষ্যৎ শুধু রাজনৈতিক নয়, মানবিক সংকটেও জর্জরিত হতে পারে।
মন্তব্য করুন