পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সিরামিক খাতের কোম্পানি মুন্নু সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড দুইভাবে মিথ্যা তথ্য দিয়েছে। প্রথমত, কোম্পানিটি যে পরিমাণ পণ্য বিক্রি করেছে, তার থেকে বেশি বিক্রির তথ্য দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, সেই বাড়তি বিক্রি করা পণ্যের ভ্যাট রিটার্নের তথ্য দিতে পারেনি। এতে কোম্পানিটির শেয়ারদরে প্রভাব পড়েছে। বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়ায় ৯ কার্যদিবসে কোম্পানিটির শেয়ারদর বেড়েছে প্রায় ৭৭ কোটি টাকা।
শেয়ার নিয়ে কারসাজি করার অভিযোগ এর আগেও রয়েছে মুন্নু সিরামিকের বিরুদ্ধে। কারসাজি করে কোম্পানির শেয়ারকে কয়েকগুণ বাড়ানোর কারণে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ২০২১ সালে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ সব পরিচালককে ১ কোটি করে মোট ১৫ কোটি টাকা জরিমানা করে। সেই পুরোনো কারসাজির অভ্যাস থেকে বর্তমানেও বের হতে পারছে না কোম্পানিটি। শেয়ারদর বাড়াতে বানিয়েছে কৃত্রিম আর্থিক হিসাব। সর্বশেষ ২০২৪ হিসাব বছরের আর্থিক প্রতিবেদনে বিক্রির মিথ্যা তথ্য দেওয়ার ফলে কোম্পানির শেয়ারদর বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। এই মিথ্যা তথ্যের ওপর ভর করে কোম্পানিটির শেয়ার কিনে লোকসান গোনার পথে বিনিয়োগকারীরা।
নিরীক্ষা প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদনে ২০২৪ হিসাব বছরে ৩০ কোটি ২৭ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি দেখানো হয়েছে। কিন্তু ভ্যাট রিটার্ন অনুযায়ী এ বিক্রির পরিমাণ ২৪ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। এর অর্থ ভ্যাট রিটার্নের থেকে ৫ কোটি ৯১ লাখ টাকার বেশি পণ্য বিক্রি করা হয়েছে। ওই বিক্রির ওপরে ভ্যাট আসে ৮৮ লাখ টাকা, যা ব্যয় হিসেবে দেখানো হয়নি। অর্থাৎ ৮৮ লাখ টাকার মুনাফা বেশি দেখানো হয়েছে। অন্যদিকে হিসাব করলে কোম্পানিটি প্রকৃতপক্ষে ২৪ কোটি ৩৬ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করে আর্থিক প্রতিবেদনে দেখিয়েছে ৩০ কোটি ২৭ লাখ টাকা। বিক্রি বাড়িয়ে দেখিয়ে মুনাফার ওপর প্রভাব ফেলতেই তা করা হয়। এতে দুভাবেই প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে কোম্পানিটি।
আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে গত বছরের তুলনায় রপ্তানি আয় ব্যাপকভাবে কমেছে। বিদেশি ক্রেতাদের বাতিলকৃত অর্ডারগুলোর ওপর ভিত্তি করে রপ্তানি কমার যথাযথ প্রমাণপত্র পাওয়া যায়নি। এমন বাস্তবতায় বিদেশি গ্রাহকদের কাছ থেকে পাওনা আদায়ে প্রভাব ফেলতে পারে বলেও জানিয়েছে নিরীক্ষক।
জানা গেছে, কোম্পানিটির ২০২৩ হিসাব বছরের ওপর রাজস্ব বোর্ড অতিরিক্ত ৪৫ লাখ টাকার আয়কর ধার্য করেছে, যা কোম্পানি কর্তৃপক্ষ আন্তর্জাতিক হিসাব মান (আইএএস)-৮ অনুযায়ী ২০২৪ হিসাব বছরের আয় বিবরণীতে ব্যয় হিসেবে দেখায়নি। এর মাধ্যমে তারা ওই হিসাব বছরে ৪৪ লাখ ৫৫ হাজার টাকার মুনাফা বেশি দেখিয়েছে। তারা ওই অতিরিক্ত আয়করকে সরাসরি অবশিষ্ট আয়ের সঙ্গে সমন্বয় করেছে।
মুন্নু সিরামিকে গ্রাহকদের কাছে ৩৬ মাসের বেশি সময় ধরে ১ কোটি ৯৯ লাখ টাকার পাওনা অর্থ পড়ে রয়েছে। কিন্তু অর্থের বিপরীতে কোনো সঞ্চিতি গঠন করেনি কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। অথচ ওই অর্থ আদায়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে এসেছে। এ কারণে সঞ্চিতি গঠন করা দরকার, যা না করে অতিরঞ্জিত মুনাফা দেখানো হয়েছে।
কোম্পানিটি ২০২৪ হিসাব বছরের আর্থিক প্রতিবেদনে দেখিয়েছে, শেয়ারপ্রতি ৩৯ পয়সা করে মোট ১ কোটি ৪৭ লাখ টাকার নিট মুনাফা করেছে। কিন্তু কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ওই হিসাব বছরে ভ্যাট, আয়কর ও পাওনা টাকার বিপরীতে সঞ্চিতিবাবদ ব্যয় না দেখিয়ে এই কৃত্রিম মুনাফা দেখিয়েছে। কৃত্রিম মুনাফা দেখানো এ কোম্পানিটির শেয়ারদর গত কয়েকদিন টানা বাড়ছে। এর মধ্যে চলতি বছরের গত ৭ জানুয়ারি কোম্পানিটির শেয়ারদর ছিল ৬০ টাকা ৬০ পয়সা। এ শেয়ারটি ২০ জানুয়ারি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮১ টাকায়। অর্থাৎ গত ৯ কার্যদিবসে কোম্পানিটির শেয়ার দর বেড়েছে ৭৬ কোটি ৯৬ লাখ টাকা।
কোম্পানিটির ২০২৪ হিসাব বছরে ৮ কোটি ৫ লাখ টাকার উৎপাদন প্রক্রিয়ার কাঁচামালের অব্যবহৃত অংশও (ওয়েস্টেজ) বিক্রি করা হয়েছে বলে আর্থিক হিসাবে জানানো হয়েছে। এই বিক্রয় পরিচালনার জন্য কোম্পানি যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করেনি। এ ছাড়া বিক্রিতে প্রাপ্ত অর্থের অধিকাংশ নগদে লেনদেন করে আয়কর আইন ভঙ্গ করেছে।
আর্থিক প্রতিবেদনে মুন্নু সিরামিকের ৪১ কোটি ৭৪ লাখ টাকার মজুত পণ্য দেখানো হয়েছে। এ মজুত পণ্যের ক্যাটাগরিভিত্তিক তথ্য দিতে পারেনি। এ ছাড়া উৎপাদন প্রক্রিয়ায় গ্যাস সংযোগ সংকটের কারণে নিম্নমানের বা ক্ষতিগ্রস্ত পণ্য উৎপন্ন হয়েছে। এর ফলে নিরীক্ষক নিশ্চিত হতে পারেনি যে, ইনভেন্টরি আইএএস-২ অনুযায়ী খরচ মূল্যের কম দেখানো হয়েছে কি না।
এসব বিষয়ে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, অর্থবছর শেষে নিরীক্ষকের মতামতসহ তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর বার্ষিক প্রতিবেদন কমিশনে আসে, যা কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ যাচাই-বাছাই করে। এতে কোনো অনিয়ম বা অসংগতি পেলে, কমিশন আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
এ ব্যাপারে মুন্নু সিরামিকের কোম্পানি সচিব আরিফুর রহমান কালবেলাকে বলেন, আমরা যেসব রিপোর্ট জমা দিয়েছি, তা সবই ঠিক আছে। এর বেশি কিছু জানতে চাইলে কোম্পানির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) মো. সাইফুল হক শাফীনের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
পরবর্তী সময়ে সিএফও যোগাযোগের নম্বরে ফোন দেওয়া হলে তা রিসিভ করেন মুন্নু মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালের একজন। তিনি নিজেকে মুন্নু মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালের একজন সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে পরিচয় দেন। এরপর কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাশেদ মাইমুনুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি।
মুন্নু সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ১৯৮৩ সালে। কোম্পানিটি বি ক্যাটাগরিতে লেনদেন হচ্ছে। ১০০ কোটি টাকা অনুমোদিত মূলধনের কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন ৪৭ কোটি ৭২ লাখ টাকা। কোম্পানির ৩ কোটি ৭৭ লাখ ২৪ হাজার ৩১৭টি শেয়ারের মধ্যে উদ্যোক্তা পরিচালকদের হাতে রয়েছে ৩৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ১৩ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে দশমিক ১৭ শতাংশ এবং বাকি ৪৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে।
মুন্নু সিরামিক ২০২০ সালে বিনিয়োগকারীদের ৫ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দিয়েছে। এরপরের বছর ২০২১ সালে ১০ শতাংশ নগদ, ২০২২ সালে ১০ শতাংশ নগদ, ২০২৩ সালেও ১০ শতাংশ নগদ এবং সবশেষ ২০২৪ সালে ১ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে বিনিয়োগকারীদের। হিসাব বছর শেষে কোম্পানিটির বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে ঋণ রয়েছে ১০৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ ৬৬ কোটি টাকা এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ৩৯ কোটি টাকা।