পছন্দের কোম্পানিকে চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহের কাজ দিতে দরপত্রের শর্ত বদলে ফেলেছে কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি)। সব দেশে গ্রহণযোগ্য মান সনদের পরিবর্তে ইচ্ছামাফিক শর্ত জুড়ে দেওয়ায় বিশ্ববিখ্যাত অনেক কোম্পানি ৪২ কোটি টাকার এই কাজের যোগ্যতা হারায়। সেই সুযোগে চীনা কোম্পানির কাছ থেকে নিম্নমানের এক্স-রে মেশিন ও ক্যাথ ল্যাব কেনার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
দেশের সব সরকারি হাসপাতালের জন্য চিকিৎসা উপকরণ ক্রয়, মজুত ও সরবরাহের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি)। সদ্য বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের আওতায় ৫টি প্যাকেজে মোট ৪২ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কিনছে সরকারের এই প্রতিষ্ঠান। এর আগে সিএমএসডিসহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মেডিকেল যন্ত্রপাতি কেনার ক্ষেত্রে পণ্যের গুণগত মান নির্ধারণে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের ইউরোপিয়ান স্ট্যান্ডার্ড (ইইউ-সিই) অথবা আমেরিকান স্ট্যান্ডার্ড (ইউএস-এফডিএ) সনদ বাধ্যতামূলক থাকত। কিন্তু গত অর্থবছরে সেই নিয়ম বদলে ইইউ-সিই এবং ইউএস-এফডিএ অথবা ইউএস-এফডিএ এবং জিআইএস সনদ থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়। বিশ্বজুড়ে চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনাকাটায় ইইউ-সিই ও ইউএস-এফডিএ সনদকে সমমানের বিবেচনা করা হয়। ফলে এর যে কোনো একটি সনদ থাকলেই ওই প্রতিষ্ঠানকে যোগ্য মনে করা হয়। কিন্তু সিএমএসডির এই কেনাকাটায় দুটি সনদ থাকা বাধ্যতামূলক করায় অতীতে গুণগত মানসম্পন্ন যন্ত্রপাতি সরবরাহকারী অনেক প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নিতে পারেনি। এ ধরনের দরপত্রে আগে ৮-১০টি কোম্পানি প্রতিযোগিতা করলেও এবার শর্তের বেড়াজালে অনেক বিখ্যাত কোম্পানিও দরপত্রে অংশ নিতে পারেনি।
জানা গেছে, যন্ত্রপাতি ক্রয়ের ৫টি প্যাকেজে সর্বোচ্চ দুই থেকে তিনটি কোম্পানি অংশ নেয়। এমনকি একাধিক প্যাকেজে মাত্র একটি কোম্পানি টেন্ডারে অংশ নিয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত করে ইতোমধ্যেই ক্রয়াদেশ দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে পছন্দের কোম্পানির কাছ থেকে পণ্য ক্রয়ের সুযোগ পাচ্ছে সিএমএসডি। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ও সিএমএসডির কতিপয় কর্মকর্তা যোগসাজশ করে কোটি কোটি টাকা নিজেদের পকেটে ভরতে কেনাকাটার শর্ত বদলে ফেলেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্ট নথি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত অর্থবছরের বাজেটের টাকায় ৫টি প্যাকেজে ৩৪ কোটি টাকার এক্স-রে মেশিন কিনছে সিএমএসডি। ইতোমধ্যেই পছন্দের চীনা প্রতিষ্ঠান অরিচমেডকে কাজটি পেয়ে গেছে। এ ছাড়াও বর্তমান বাজার মূল্যের দ্বিগুণ দামে এইচএসএম-২২০৩ প্যাকেজের আওতায় ৮ কোটি টাকায় একটি এনজিওগ্রাম মেশিন (ক্যাথল্যাব) কেনা হচ্ছে। এসব মেশিন বেসরকারি হাসপাতাল তিন থেকে সাড়ে ৩ কোটি টাকায় কেনাকাটা করে। অথচ সিএমএসডি দ্বিগুণ দামে ক্রয়াদেশ প্রদান করেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মেডিকেল যন্ত্রপাতি তৈরি ও সরবরাহে বিশ্ববিখ্যাত প্রতিষ্ঠান সিমেন্স, জিই, ফিলিপস, অ্যালেঙ্গার্স, ফুজি ও হিটাচিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গুণগত মান নির্ণয়ক সনদ একটি করেই থাকে। এসব প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে পছন্দের কোম্পানির পণ্য কিনতে নিয়ম বদলানো হয়েছে।
২০২১-২২ অর্থবছরের সিএমএসডির এইচএসএম-২১০৩ প্যাকেজে দেখা গেছে, ডিজিটাল রেডিওলজি সি-আর্ম মেশিন কেনা হয়েছে। সেখানে আদর্শ মান ও নিরাপত্তা হিসেবে ইউএস-এফডিএ অথবা ইইউ-সিই অথবা জাপানের জেআইএস আন্তর্জাতিক গুণমান সনদ আছে এমন কোম্পানির পণ্য ক্রয়ের কথা বলেছে। অথচ পরের অর্থবছরে এই দুটি সনদই বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এভাবে মান সনদের শর্ত বদলে একটি নতুন চীনা কোম্পানিকে ৫টি প্যাকেজের মাধ্যমে এক্স-রে মেশিন সরবরাহের কার্যাদেশ (নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়্যার্ড) দেওয়া হচ্ছে।
৩৪ কোটি টাকার এক্স-রে মেশিন ক্রয়ের প্যাকেজ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জিডি-২২০৭ প্যাকেজে ২০টি ৫০০ এমএ এক্স-রে মেশিন ক্রয় করা হবে। এসব মেশিন কয়ে প্রায় ১১ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। জাইকা-২২০৩ প্যাকেজে তিনটি ৫০০ এমএ এক্স-রে মেশিন ক্রয়ে ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এইচ এস এম-২২০৫ প্যাকেজে ৫টি ১০০০ এমএ এক্স-রে মেশিন ক্রয়ে ৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। আবার এইচ এস এম-২২০৯ প্যাকেজে ১০টি ৫০০ এমএ এক্স-রে মেশিন ক্রয়ে ৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। জি-২২১৪ প্যাকেজের আওতায় ১২টি ৫০০ এমএ এক্স-রে মেশিন ক্রয়ে ৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, সিএমএসডির টেন্ডারের সঙ্গে সম্পৃক্ত কতিপয় অসাধু সরকারি কর্মকর্তা যোগসাজশ করে নির্দিষ্ট কোম্পানির পণ্যকে ভিত্তি করে স্পেসিফিকেশন তৈরি করে এবং পরবর্তীতে কৌশলে তাদেরকে নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে। বেসরকারি হাসপাতালগুলো যেই এনজিওগ্রাম মেশিন (ক্যাথল্যাব) তিন থেকে সাড়ে ৩ কোটি টাকায় কিনে, সিএমএসডি সেগুলোর ক্রয়াদেশ দিয়েছে দ্বিগুণ দামে (প্যাকেজ নাম্বার: এইচ এস এম-২২০৩)।
গত ৩০ মে দেওয়া কার্যাদেশে বলা হয়েছে, গত ২৯ মার্চের টেন্ডারের বিপরীতে পাঁচটি ১০০০ এমএ ডিজিটাল রেডিওগ্রাফি এক্স-রে মেশিন ক্রয় বাবদ খরচ হবে ৪ কোটি ১৩ লাখ ১২ হাজার ৭০০ টাকা। এসব যন্ত্রপাতি সরবরাহ করবে চায়না কোম্পানি অরিচমেড। প্রতিটি মেশিনের দাম পড়বে ৮২ লাখ ৬২ হাজার ৫৪০ টাকা। এসব মেশিন স্থাপনের রুম প্রস্তুতকরণ, স্থাপন, পরিচালনায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন কর্তৃক মেশিনটির রেজিস্ট্রেশন ও পণ্যটি শিপমেন্টের আগে উৎপাদকের দেশে ৫ দিনের জন্য পরিদর্শনে যাবেন চারজন। এসব কাজে খরচ হবে আরও ৯ লাখ ৫০ হাজার ১৯০ টাকা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অরিচমেড-এর বাংলাদেশি পরিবেশক এর আগে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে মানহীন মেডিকেল যন্ত্রপাতি সরবরাহের অভিযোগে সিএমএসডির কালো তালিকাভুক্ত হয়েছে। এর পরও সিন্ডিকেটের কারণে সিএমএসডির কর্মকর্তা ও অধিদপ্তরের যোগসাজশে নতুন কোম্পানি খুলে কেনাকাটায় অংশ নিচ্ছেন। অরিচমেডের বাংলাদেশি পরিবেশক ইউএস-এফডিএ এর গুণমান সনদ জমা দেয়নি বলেও অভিযোগ রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পণ্যের গুণগত মান নির্ণয়ে কঠোরতা কোনো দোষ নয়। সেটা যদি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার হাতিয়ার হয়। তাহলে বড় ধরনের অন্যায়। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ঔষধাগার দায় এড়াতে পারে না। আন্তর্জাতিক একটি সুনামধন্য প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশি পরিবেশক কালবেলাকে বলেন, বিশ্বজুড়ে মেডিকেল যন্ত্রপাতি সরবরাহে একদিকে বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান অন্যদিকে একাধিক সার্টিফিকেটের আড়ালে মানহীন চায়না কোম্পানি। এ ক্ষেত্রে দেশীয় পরিবেশক ও সরকারি নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান জোগসাজশে বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের পণ্য বাদ দিয়ে অপ্রচলিত কোম্পানির পণ্য ক্রয় করে অর্থ লোপাট করে থাকে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে সিএমএসডির পরিচালক মো. তোফায়েল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের কেনাকাটায় মানের ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ইউএস-এফডিএ অথবা ইইউ-সিই এর যে কোনো একটি আন্তর্জাতিক গুণমান সনদ থাকলে টেন্ডারে অংশ নেওয়া যেত। এখন আর কেউ শুধু ইইউ-সিই গুণমান সনদ দিয়ে টেন্ডারে অংশ নিতে পারবে না। ইউএস-এফডিএ আবশ্যিকভাবে থাকতে হবে।’
দুটি আন্তর্জাতিক গুণমান সনদ তো একই সমমানের এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘মোটেও এমনটি নয়; শুধু ইইউ-সিই মান সনদ দেখে পণ্য কেনাকাটা করলে অনেকে সময় পণ্যের গুণমান ভেরিফাই করা যায় না। মানহীন পণ্য সরবরাহের ঝুঁকি থেকে যায়। তাই টেকনিক্যাল এক্সপার্ট ও যাদের জন্য পণ্য ক্রয় করা হচ্ছে তাদের পরামর্শেই নতুন নিয়মে কেনাকাটা করা হচ্ছে। এখানে পছন্দের লোকদের কাজ পাইয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যাদের পণ্যের মান ভালো শুধু তারাই টেন্ডারে অংশ নিতে পারবে।’
মন্তব্য করুন