দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে মন্ত্রী-এমপি ও দলীয় নেতাদের মতো পালিয়ে বেড়াচ্ছেন প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পাওয়া বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তার হদিস না থাকায় সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোয় দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। প্রশাসনের হৃৎপিণ্ড সচিবালয় থেকে মাঠ পর্যন্ত বিরাজ করছে এমন অবস্থা। ফলে সেবাবঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এ অবস্থায় দ্রুত প্রশাসনকে সক্রিয় করে মানুষের জরুরি সেবাগুলো নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন সাবেক কর্মকর্তারা। তারা বলেন, প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ ও পদোন্নতি বন্ধ করতে হবে।
দ্রুত অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হলে অবশ্য প্রশাসন পুনরায় সচল হয়ে যাবে বলে বিশ্বাস করেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররফ হোসাইন ভূঁইয়া। তিনি কালবেলাকে বলেন, এখন একটা বিশেষ পরিস্থিতি চলছে। ঊর্ধ্বতনরা যেহেতু আগের সরকারের কর্মকর্তা, সেহেতু তাদের মধ্যে এক ধরনের ভয় থাকা স্বাভাবিক। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হলে তারা অফিসে ফিরবেন বলে আশা করি। ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। কর্মকর্তাদের ভয়ভীতি থেকে দূরে থাকার পরামর্শও দেন সাবেক এই মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
সচিবালয় ঘুরে দেখা গেছে, দু-একজন ছাড়া অন্যান্য সচিব ও সিনিয়র সচিব গত দুদিন অফিস করেননি। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন ও মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়াও আত্মগোপনে আছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরীও অফিস করছেন না। সেখানে ভারপ্রাপ্ত সচিব হিসেবে অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) মো. মাসুদুল হাসান দায়িত্ব পালন করছেন। ফলে তিনি কিছু কাজ এগিয়ে নিচ্ছেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কর্মকর্তারা অফিসে উপস্থিত হলেও তাদের হাতে কোনো কাজ নেই। মন্ত্রিপরিষদ সচিব অনুপস্থিত থাকায় বহু কাজ আটকে রয়েছে।
সাবেক সচিব ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ এ কে এম আব্দুল আউয়াল মজুমদার কালবেলাকে বলেন, এখন যারা দেশের দায়িত্বে আছেন তাদেরই কর্মকর্তাদের আশ্বস্ত করে অফিসে ফিরিয়ে আনতে হবে। অন্যথায় প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়বে। প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা অফিস ছেড়ে গা ঢাকা দিলে তা প্রশাসন ও দেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হবে। প্রয়োজনে কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে সেনাবাহিনী তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে অফিসে ফিরিয়ে আনতে হবে। কারণ সচিব ও অন্য কর্মকর্তারা প্রজাতন্ত্রের দায়িত্ব পালন করেন। কারা প্রশাসনে থাকবে, কারা থাকবে না—সেটি পরবর্তী সরকারই সিদ্ধান্ত নেবে। সে পর্যন্ত কর্মকর্তাদের অবশ্যই অফিস করতে হবে। প্রশাসন সচল রাখতে হবে। এভাবে চলতে পারে না।
ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বিসিএস ২০তম ব্যাচের একজন যুগ্ম সচিব কালবেলাকে বলেন, প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা এভাবে পালিয়ে থাকা কোনোভাবেই উচিত নয়। তারা তো সরকারের কর্মচারী। সুতরাং তাদের এত ভয় কেন। তারা অফিস করলে আমরা কোনো সমস্যা দেখি না। সচিব ও অন্যান্য দপ্তরের প্রধানদের অনুপস্থিতিতে সব কিছু স্থবির হয়ে পড়েছে। এভাবে চলতে পারে না।
কর্মকর্তাদের পালিয়ে থাকাকে ‘লজ্জাজনক’ আখ্যা দিয়ে এই যুগ্ম সচিব আরও বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়ার ফলেই তাদের মধ্যে ভয় আছে। তারা আজ পলাতক। সততা ও যোগ্যতা দিয়ে তারা পদোন্নতি পেলে এত খারাপ অবস্থায় পড়তে হতো না। রাজনীতিকীকরণের ফলে প্রশাসন একেবারেই দুর্বল হয়ে গেছে। ভবিষ্যতে যারাই সরকারে আসুক প্রশাসনকে ব্যাপকভাবে সংস্কার করতে হবে। প্রশাসনকে রাজনীতির রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত করতে হবে।
জানা গেছে, মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বাইরে অন্যান্য দপ্তর অধিদপ্তরের প্রধানরাও অফিসে অনুপস্থিত আছেন। তবে কোনো কোনো দপ্তরে কেউ কেউ অফিস করছেন। জেলা প্রশাসনেও ঠিকমতো কাজ হচ্ছে না। অনেকেই হামলা কিংবা সহিংসতার ভয়ে অফিস করছেন না। তবে জেলা প্রশাসকরা (ডিসি) নিয়মিত অফিস করছেন বলে জানিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও) মারাত্মক ভয়ের মধ্যে দিনাতিপাত করছেন। তারাও অফিস করছেন। তবে মাঠ প্রশাসনের এসব কর্মকর্তা তাদের বাংলোয় থাকছেন না। তারা অন্যত্র নিরাপদে অবস্থান করছেন বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। ইউএনওদের কেউ কেউ নিরাপত্তার অভাবে অফিসে অনুপস্থিত রয়েছেন। উপজেলা ভূমি অফিসগুলোর কার্যক্রমও অনেকটা বন্ধ রয়েছে। অনেক এসিল্যান্ড হামলার ভয়ে অফিস করছেন না। তবে মাঠ প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তা হামলার শিকার হননি।
এদিকে ইউনিয়ন ভূমি অফিসগুলোও কার্যত অচল অবস্থায় আছে। জেলা-উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে ঠিকমতো কার্যক্রম চলছে না। অনেকে অফিসে অনুপস্থিত। ফলে অসহায়, গরিব, দুস্থ ও বয়স্কদের ভাতা কার্যক্রমও বন্ধ রয়েছে।
একাধিক কর্মকর্তা জানান, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিশেষ করে সচিবরা মহাআতঙ্কে রয়েছেন। তারা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছেন। পদোন্নতি বঞ্চিতরা তাদের সামনে পেলে অপমান, অপদস্থ করবেন—এমন ভয়ও রয়েছে তাদের মধ্যে। তবে কয়েকজন সচিব গত মঙ্গলবার সচিবালয়ে অফিস করেছেন। আবার দ্রুত তারা অফিস ত্যাগও করেন। হামলা হতে পারে—এমন আশঙ্কা থেকে সাড়ে ১২টার দিকে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সচিবালয় ত্যাগ করেন। এ সময় তাদের হুড়াহুড়ি করতে দেখা যায়।
পুলিশে স্থবিরতা বেশি:
জেলা পুলিশ সুপারসহ (এসপি) তার কার্যালয়ের অন্য কর্মকর্তারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন বলে জানা গেছে। কারণ দীর্ঘদিন নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার সাধারণ মানুষ পুলিশের ওপর বেশি ক্ষুব্ধ। দেশের নানা স্থানেই পুলিশের ওপর হামলার খবর পাওয়া গেছে। ফলে এসপিদের কেউ কেউ অজ্ঞাত স্থান থেকে অফিস করছেন। ঠিক মতো তারা কোনো নির্দেশনাও দিতে পারছেন না। এমন অবস্থায় পুলিশের কার্যক্রমে সবচেয়ে বেশি স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে।
অন্যদিকে থানায় হামলা ও সহকর্মীদের হত্যার প্রতিবাদে অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতি ঘোষণা করে পুলিশের অধস্তন কর্মচারী সংগঠন। গত মঙ্গলবার রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইনে বিক্ষোভও করেন তারা। তাদের দাবি, রাজনৈতিকভাবে তাদের যেন কেউ ব্যবহার করতে না পারে এবং সিনিয়রদের তাঁবেদারি না করতে হয়। এরপর গতকাল বুধবার বিকেলে পুলিশের নতুন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম পুলিশ সদস্যদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিজ নিজ পুলিশ লাইন্স বা কর্মস্থলে যোগদানের নির্দেশ দিয়েছেন।
এর আগে কর্মবিরতি ঘোষণা করে গত মঙ্গলবার পুলিশ সদস্যরা জানান, কয়েক বছর ধরে পুলিশের কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দলীয়করণের মাধ্যমে দেশের মানুষের কাছে পুলিশের ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। যার ফলে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করার পর থেকে সারা দেশের পুলিশ সদস্যদের ওপর এবং পুলিশের প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নির্বিচারে হামলা চালানো হয়েছে। এতে অসংখ্য পুলিশ সদস্য নিহত হন। এ ছাড়া প্রায় ৪৫০টি থানা এবং ৭০টির মতো পুলিশ স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, লুটপাট চালানো হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে পুলিশ সদস্যদের নিরাপত্তার স্বার্থে বাংলাদেশ পুলিশের অধস্তন কর্মচারী সংগঠন দেশব্যাপী অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতি ঘোষণা করছে।
তাদের কর্মবিরতি ঘোষণার রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সব জেলার থানাগুলোতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বাহিনীটির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, থানার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার পাশাপাশি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা এবং ঢাকা শহরের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বও পালন করবেন আনসার সদস্যরা।