ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর দায়িত্ব নিয়েই রাষ্ট্র সংস্কারে মনোযোগ দেয় নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু গত চার মাস ধরেই সরকারকে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো নানাভাবে চাপ দিয়ে আসছিল। নির্বাচন নিয়ে উপদেষ্টাদের নানামুখী বিচ্ছিন্ন বক্তব্যের পর অবশেষে বিজয় দিবসে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দেন সরকারপ্রধান। তার বক্তব্য অনুযায়ী, সংস্কার শেষে আগামী বছর ডিসেম্বরের মধ্যে এবং সংস্কার খানিকটা বিলম্ব হলে ছাব্বিশের জুনের মধ্যে এ নির্বাচন হতে পারে। প্রধান উপদেষ্টার এমন বক্তব্যকে খানিকটা সমালোচনার পাশাপাশি স্বাগত জানিয়েছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ রাজনৈতিক দলগুলো। নবগঠিত নির্বাচন কমিশনও বলেছে, নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত রয়েছে তারা। সংস্থাটির প্রধান এ. এম. এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, নির্বাচনের লক্ষ্যে তারা প্রথম দিন থেকেই কাজ শুরু করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, এই সময়ের মধ্যে নির্বাচন করতে নির্বাচন কমিশন আসলেই কতটা প্রস্তুত?
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি পুরোপুরি নির্ভর করবে সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ওপর। যদি সংস্কার কমিশনের ছোটখাটো সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করে পরবর্তী সরকারের জন্য রেখে দেওয়া হয়, তবে প্রস্তুতিতে তেমন সময় লাগবে না। আর যদি কমিশনের সম্ভাব্য সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করে নির্বাচনে যেতে হয়, তবে তা অনেক সময়সাপেক্ষ হতে পারে। কারণ, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন এবং সংবিধান সংস্কার কমিশনেও দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদ চালু, সংখ্যানুপাতিক ভোটসহ অনেক বড় বড় সংস্কারের কথাবার্তা উঠে আসছে। এগুলো করতে গেলে এত কম সময়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্ভব নয়।
নির্বাচন কমিশন সূত্র বলছে, নতুন কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পর এখন পর্যন্ত একটি কমিশন সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই সভায় কেবল ভোটার তালিকার বিষয়ে সিদ্ধান্ত এলেও চেকলিস্ট অনুযায়ী নির্বাচনের বেশিরভাগ কাজই দৃশ্যমান নয়। ভোটের প্রস্তুতিমূলক সব কাজই বাকি। এ ছাড়া প্রস্তুতির বড় একটি অংশ নির্ভর করছে নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ওপর। ওই কমিশন থেকে যেসব সুপারিশ আসে তার ওপর ভিত্তি করে কমিশনকে প্রস্তুতি নিতে হবে। পাশাপাশি সংবিধান সংস্কার কমিশন এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান সংস্কার কমিশনের সুপারিশের সঙ্গেও নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। ফলে কমিশন এখনই প্রস্তুত, সেটা বলার সময় এখনো আসেনি। তবে সরকারের চাওয়া বা ঘোষণা অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে ভোটের পূর্বপ্রস্তুতিমূলক কাজগুলো এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।
সূত্র আরও জানায়, প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য অনুযায়ী ২০২৫ সালের শেষ দিকে ভোট হলে নতুন কমিশন সময় পাবে এক বছরেরও কম। আর ২৬-এর জুনের মধ্যে ভোট হলে সেক্ষেত্রে দেড় বছরের মতো সময় পাবে তারা। কিন্তু বিগত চারটি কমিশনের দায়িত্বকাল পর্যালোচনা করলে দেখা যায়—তাদের প্রায় সবাই সংসদ নির্বাচনের আগে হাতে দুই বছরের মতো সময় পেয়েছিল। আর সংসদ নির্বাচনের আগে চারটি কমিশনই ট্রায়াল রান হিসেবে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের কিছু নির্বাচন করে নিজেদের পোক্ত করা এবং সক্ষমতা যাচাই করে নেয়। অন্যদিকে বর্তমান কমিশন জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের কোনো ধাপেরই নির্বাচন করবে না বলে সিইসি জানিয়ে দিয়েছেন। ফলে দেড় থেকে দুই বছরের মধ্যেই নির্বাচনের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিতে বর্তমান কমিশনকে। সেজন্য আগের কমিশনগুলোর চেয়ে আরও ত্বরিত গতিতে কাজ করতে হবে।
ইসির কর্মকর্তারা জানান, কমিশন এখন পর্যন্ত কেবল ভোটার তালিকার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে। সেক্ষেত্রে এ বছর হালনাগাদ তালিকা করা হবে। মার্চের পর বাড়ি বাড়ি গিয়ে তালিকা করবে কমিশন। সেক্ষেত্রে ২০২৫-এর ডিসেম্বরের মধ্যে ভোট হলে এ তালিকাতেই ভোট করতে হবে কমিশনকে। আর ২০২৬-এর জুনের মধ্যে নির্বাচন হলে পরবর্তী ভোটার তালিকার ভিত্তিতে ভোট করতে হবে।
নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু একটি ভোটার তালিকাই ভোটের প্রস্তুতির জন্য যথেষ্ট নয়। ভোটার তালিকা ছাড়াও নির্বাচনের আগে সংসদীয় এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণ, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের তথ্য যাচাই, দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক নীতিমালা ও পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন, নির্বাচনী বাজেট, ভোটকেন্দ্র স্থাপন, নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণসহ পূর্বপ্রস্তুতিমূলক বেশ কিছু কাজ রয়েছে ইসির। এর বাইরে এবার নতুন করে প্রবাসীদের ভোটদানের সুযোগের বিষয়টি জোরালো আলোচনা রয়েছে। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনও প্রবাসী ভোটারদের বিষয়ে বেশ গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। তাদের সুপারিশে প্রবাসী ভোটার এবং পোস্টাল ব্যালটের বিষয়টি যে থাকছে, সেটি নিশ্চিত। বিগত তিনটি নির্বাচনের আগে যে সীমানা পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আখ্যা দিয়ে বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও সম্ভাব্য প্রার্থীরা এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ দিয়েছে। পতিত সরকার নিজ দলের প্রার্থীদের জয় নিশ্চিত করতে সুদূরপ্রসারী নকশার অংশ হিসেবে অনেক আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করে। এই অভিযোগগুলো আমলে নিয়ে সীমানা পুনর্নির্ধারণ ইসির জন্য সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এর বাইরে সময়মতো নির্বাচনী সরঞ্জাম সংগ্রহ এবং কেন্দ্রগুলোতে পৌঁছানোর বিষয় রয়েছে। এ ছাড়া সংসদ নির্বাচন ব্যালটে করতে হলে তার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ সংকুলান এবং ব্যালট ছাপানোর বিষয়টিও রয়েছে। আগামী সংসদ নির্বাচন ব্যালটে হবে বলে এরই মধ্যে সিইসি জানিয়ে দিয়েছেন। এর বাইরে নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা বা সংলাপের বিষয়টিও থাকছে। ফলে নির্বাচন কমিশন প্রস্তুত বলে ঘোষণা দিলেও বাস্তবে তার প্রায় সব কাজই অসম্পন্ন অবস্থায় রয়েছে।
এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, আইন অনুযায়ী সীমানা পুনর্নির্ধারণের ক্ষেত্রে বর্তমানে যা আছে সেটি বহাল রেখেই নির্বাচন করা যায়। কিন্তু আসন নিয়ে অনেকের দাবি আছে। এ নিয়ে অনেকের ক্ষোভ আছে, বক্তব্য আছে। সেগুলো আমলে নিয়ে কাজ করলে তা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। শুধু সীমানা নির্ধারণেই চার থেকে পাঁচ মাস সময় লাগতে পারে। আর যে রকম আছে সেই অবস্থায় রেখে নির্বাচন করতে হলে তেমন সময় লাগবে না। মোদ্দা কথা, বড় ধরনের কোনো সংস্কার ছাড়া নির্বাচনে যেতে চাইলে এক থেকে দেড় বছর সময়ই যথেষ্ট। এর বাইরে কিছু করতে গেলে প্রস্তুতিতে সময় লাগতে পারে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ কালবেলাকে বলেন, নির্বাচন যত দেরি হবে ফ্যাসিবাদী শক্তি ততই ষড়যন্ত্র করবে। সেজন্য যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনের দিকে যাওয়া জরুরি। প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা করা ভোটের রোডম্যাপ নিয়ে বিএনপির যে প্রত্যাশা ছিল, তা পূরণ হয়নি মন্তব্য করে তিনি বলেন, সরকার আন্তরিক হলে চার থেকে ছয় মাসের মধ্যেই নির্বাচন সম্ভব।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচিত সরকার ছাড়া সব কিছু সংস্কার করা সম্ভব নয়। সেজন্য অতিপ্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে অন্তর্বর্তী সরকারকে দ্রুত নির্বাচন দেওয়া উচিত। জনগণ ভোটের অপেক্ষায় আছে, তাই যত দ্রুত সম্ভব সংস্কার কাজ সেরে ভোটের আয়োজন করতে হবে।
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার কালবেলাকে বলেন, বিলম্বে হলেও সরকার প্রধান নির্বাচনের প্রাথমিক একটি সম্ভাব্য ধারণা ঘোষণা করেছে এবং আমরা এটিকে সাধুবাদ জানিয়েছি। আমরা মনে করি, সব কিছু সংস্কার করা অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। সেজন্য যৌক্তিক সময়ের মধ্যে অতিপ্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন তারা জাতিকে উপহার দেবে। অন্য কোনো দিকে মনোযোগ না দিয়ে সরকারকে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত। আর যেহেতু সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের প্রতি দেশের আপামর জনগণের সমর্থন রয়েছে, সেহেতু অবাধ, নিরপেক্ষ ও একটি সুন্দর নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন সার্বিক প্রস্তুতিও নিতে পারবে।
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না কালবেলাকে বলেন, নির্বাচনের জন্য এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। তবে নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত নির্বাচনের প্রাথমিক ধারণার মধ্যে অবশ্যই নির্বাচন কমিশনের সার্বিক প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব।