বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিধন্য সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুরে প্রতিষ্ঠা করা হয় রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়। ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠা হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষা কার্যক্রম শুরু ২০১৮ সালে। কিন্তু এখনো নিজস্ব ক্যাম্পাস পায়নি দেশের ৪০তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়টি। নিজস্ব ক্যাম্পাস না থাকায় ভাড়া ভবনে চলছে শিক্ষা কার্যক্রম। আবাসিক সুবিধা না থাকায় বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।
সুষ্ঠুভাবে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা এবং নিজস্ব ক্যাম্পাস স্থাপনের উদ্দেশ্যে প্রকল্প প্রস্তাব করা হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। ২০১৮ সালে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হওয়ার পরই নিজস্ব ক্যাম্পাস স্থাপনের উদ্দেশ্যে ‘রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়,
বাংলাদেশ স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু ৭ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই প্রকল্প প্রস্তাবের অনুমোদন মেলেনি। বিশাল বাজেটের প্রকল্প প্রস্তাব অনুমোদন না দিয়ে বারবার ব্যয় কমানোর জন্য সংশোধনের সুপারিশসহ ফেরত পাঠানো হয়েছে।
একবার দুবার নয়, ৮ বার ফেরত পাঠানো হয়েছে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব। এ সময়ের মধ্যে অনুমোদন তো মেলেইনি, প্রকল্পের আকার ও ব্যয় কমানো ছাড়া দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতিও হয়নি। ফলে বারবার পুনর্গঠন আর সংশোধনের গোলকধাঁধায় আটকে আছে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পটি। অবশেষে এ থেকে বেরিয়ে প্রকল্প প্রস্তাবটি সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। গত ৩০ জানুয়ারি পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগে প্রস্তাব পাঠিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
জানা গেছে, নিজস্ব ক্যাম্পাস স্থাপনের জন্য ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে প্রথম প্রকল্প প্রস্তাব করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ৯ হাজার ২৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প প্রস্তাবটি ফেরত দিয়ে ব্যয় এবং আকার কমানোর সুপারিশ করা হয়। পরে আরও ৫ বার প্রস্তাব করা হলেও অনুমোদন না দিয়ে সংশোধনের জন্য একইভাবে ফেরত দেওয়া হয়। এ সময়ের মধ্যে প্রকল্পের আকার ও ব্যয় কমানো ছাড়া দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি।
দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ব্যয় সংকোচন নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গত বছরের ডিসেম্বরে ৭ বারের মতো প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়। এবার ব্যয় আগের থেকে ৮৯ শতাংশ কমিয়ে প্রস্তাব করা হয় ৯৯৫ কোটি ১২ লাখ টাকা। তাতেও সাড়া মেলেনি। প্রস্তাবিত প্রকল্পের ওপর বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) পর্যালোচনা সভায় আবারও ব্যয় কমানোর সুপারিশ করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য প্রকল্পের আওতায় ২২৫ একর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু গত ২৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ইউজিসির সভায় আলোচ্য প্রকল্প প্রস্তাব থেকে ১২৫ একর বাদ দিয়ে ১০০ একর জমি অধিগ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিদ্যুতের সাব-স্টেশন, অভ্যন্তরীণ রাস্তা এবং কম্পিউটার ও আনুষঙ্গিক অঙ্গের পরিমাণ কমানোর পাশাপাশি বেশকিছু খাতে ব্যয় ও পরিমাণ কমানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে প্রাক্কলিত ব্যয় ৯৯৫ কোটি ১২ লাখ টাকা থেকে কমিয়ে অনধিক ৬০০ কোটি টাকার মধ্যে রেখে ডিপিপি পুনর্গঠন করে পাঠানোর সুপারিশ করা হয়।
বারবার সংশোধনের কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, একটি বিশেষায়িত ও গবেষণাধর্মী বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলার জন্য রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর সেখান থেকে সরে গিয়ে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পরিচালনা শুরু হয় এবং বাস্তবতা বিবেচনায় না নিয়ে বিশাল বাজেটের মাস্টারপ্ল্যান করা হয়। সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই অযৌক্তিকভাবে বিভিন্ন বিভাগ, অনুষদ এবং ইনস্টিটিউটের প্রস্তাব করায় আটকে যায় রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পটি।
ইউজিসির সুপারিশ অনুযায়ী সম্প্রতি আবারও ডিপিপি সংশোধন করে প্রস্তাব পাঠিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ৮ বারের মতো প্রস্তাবিত প্রকল্পে মূল ব্যয়ের প্রায় ৯৩ দশমিক ৫০ শতাংশ কমিয়ে ৫৯৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা খরচে প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ প্রস্তাব করা হয়েছে চলতি বছরের মার্চ থেকে ২০২৯ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। গত ২১ জানুয়ারি ৮ বারের মতো পুনর্গঠিত ডিপিপি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠায় ইউজিসি।
পরবর্তী সময়ে গত ২৮ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন শীর্ষক প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত ৩০ জানুয়ারি প্রকল্প প্রস্তাবটি পরিকল্পনা কমিশনে জমা দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক ড. এস এম হাসান তালুকদার। তবে এখনই অনুমোদন হচ্ছে না শিক্ষার্থীদের বহুল আকাঙ্ক্ষিত রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পটি। অপেক্ষা করতে হবে অর্থবিভাগ, পরিকল্পনা কমিশন এবং জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) অনুমোদনের জন্য।
পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, মাত্র প্রস্তাব পাঠিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এখন নিয়ম অনুযায়ী প্রস্তাবিত প্রকল্পটি যাচাই বাছাই করবে পরিকল্পনা কমিশন। তারপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় বিস্তারিত আলোচনা হবে। সেখানে সব ঠিকঠাক থাকলে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য একনেক সভায় উপস্থাপন করা হবে। তারপর অনুমোদন বিষয়টি চূড়ান্ত হবে। এর আগে অবশ্যই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য অর্থবিভাগের অনুমোদন লাগবে।
জানতে চাইলে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এস এম হাসান তালুকদার কালবেলাকে বলেন, অনেকবার সংশোধনের পর অবশেষে প্রকল্প প্রস্তাবটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। এখন অর্থের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের জন্য চিঠি দেওয়া হবে। তিনি বলেন, পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠানো হলেও এখনো অনুমোদনের বিষয়টি নিশ্চিত না। কারণ আরও কয়েকটি ধাপ (স্টেজ) আছে। তারা আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে। এরপর পরিকল্পনা কমিশন এবং একনেকের অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকতে হবে।
পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠাতে এত বছর লাগার কারণ জানতে চাইলে উপাচার্য বলেন, প্রকল্প প্রস্তাবটি এর আগে অনেকবার সংশোধন করা হয়েছে। এর আগে যারা প্রস্তাব করেছিল তারা হয়তো ভালো চিন্তা করেনি; বাস্তবতা বিবেচনা করে অর্থায়নের প্রস্তাব করেনি। এ কারণে বারবার ব্যয় কমানোর কথা বলা হয়েছে। এখন যে অর্থে প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে, সেটা দিয়ে এলেও পরিপূর্ণভাবে সম্ভব না। তবে না পাওয়ার থেকে কিছুটা পাওয়া ভালো। আমরা চাচ্ছি দ্রুত প্রকল্পটি অনুমোদন হোক।
এদিকে প্রতিষ্ঠার আট বছরেও স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় গত ২১ জানুয়ারি থেকে টানা আন্দোলন করেন রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। নিজস্ব ক্যাম্পাসের দাবিতে তারা মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিলের পাশাপাশি ঢাকা-পাবনা মহাসড়ক অবরোধ করেন। তাদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে আন্দোলন করেন স্থানীয় ছাত্র-জনতাও।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানান, একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ধরনের শিক্ষার সুযোগ থাকা দরকার, তার কিছুই নেই রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে। পুঁথিগত পড়াশোনা হলেও ব্যবহারিক শিক্ষা সম্ভব হচ্ছে না। শ্রেণিকক্ষের সংকট তো রয়েছেই, আবাসন সংকটও চরমে। এভাবে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকায় রয়েছে নিরাপত্তা ঝুঁকি। স্থায়ী ক্যাম্পাস থাকলে এসব সমস্যা হতো না। আমাদের এই দাবি সরকার বারবার আশ্বাস দিলেও তা বাস্তবায়ন করছে না। এবার দাবি মানতে ১০ দিনের আলটিমটোম দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষা উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন তারা।
উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রসরমান বিশ্বের সঙ্গে সংগতি রক্ষা, শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে জাতীয় প্রয়োজন পূরণ এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অমর সৃষ্টিকে এদেশের মানুষের স্মৃতিতে চির-অম্লান করে রাখার উদ্দেশ্যে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১৬ সালের ২৬ জুলাই ‘রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ আইন ২০১৬’ জাতীয় সংসদে পাস হয়। ২০১৮ সালে ২০১৭-২০১৮ শিক্ষাবর্ষে দুটি অনুষদের অধীন তিনটি বিভাগে-স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ১১৩ জন ছাত্র নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম আরম্ভ হয়।
রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে চারটি অনুষদের অধীন পাঁচটি বিভাগে পাঠদান চলছে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টির মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১ হাজার। বাংলা, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ম্যানেজমেন্ট এবং সংগীত বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বিভিন্ন শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা পাঠগ্রহণ করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষক রয়েছেন ৩৪ জন, কর্মকর্তা ৪৯ জন এবং কর্মচারীর সংখ্যা ১০৬ জন। শাহজাদপুর উপজেলার তিনটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভবনে অস্থায়ী ক্যাম্পাস স্থাপনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম ও কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার পরিচালিত হচ্ছে।