গত মাসের মাঝামাঝিতে লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের পর দেশে রাজনীতির চিত্র অনেকটা বদলে গেছে। বিশেষ করে ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়সীমা ‘নির্ধারণ’ হওয়ায় বিএনপিসহ মিত্ররা সন্তুষ্ট। ওই বৈঠকের পরই মূলত নির্বাচনের প্রস্তুতিতে নেমেছে বিএনপিসহ দলগুলো। দেশজুড়ে বইছে নির্বাচনী হাওয়া। বিএনপির কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে পুরোদমে বিরাজ করছে নির্বাচনী আমেজ। বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা নিজ নিজ আসনে ব্যস্ত সময় পার করছেন। সেবামূলক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দলের হাইকমান্ডের নজর কাড়তে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এরই মধ্যে প্রার্থী নির্ধারণে তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ব্যক্তির সমন্বয়ে একাধিক টিম মাঠ পর্যায়ে জরিপ শুরু করেছে। অবশ্য নির্বাচনের আগে সারা দেশে দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষায় সংশ্লিষ্টদের প্রতি কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারেক রহমান। গত মাসে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পরপরই তিনি স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে আলাপ করে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেন। তার সিদ্ধান্ত না মানলে যত বড় নেতাই হোন না কেন, তারা মনোনয়ন ঝুঁকিতে পড়বেন বলে জানান। গত বছরের ৫ আগস্টের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব নেতা বা তার অনুসারীরা অনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিল বা রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কথা জানান তারেক রহমান। বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা ও সংশ্লিষ্ট সূত্র কালবেলাকে এসব তথ্য জানিয়েছে।
এরই মধ্যে লন্ডনে মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠক সম্পর্কে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের মিত্রদের অবহিত করছে বিএনপি। গত বৃহস্পতিবারও কয়েকটি দল ও জোটের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক সম্পর্কে আমরা আন্দোলনের সহযোদ্ধাদের অবহিত করেছি। মূলত লন্ডন বৈঠকের পর আমরা একটা নির্বাচনী টানেলে প্রবেশ করেছি। এটাকে আমরা কীভাবে সবাই মিলে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাব, এগুলোই মূলত আলোচনা হয়েছে। সবাই লন্ডন বৈঠক নিয়ে সন্তুষ্ট।
এদিকে, নির্বাচনের বিভিন্ন প্রস্তুতি নিতে দফায় দফায় বৈঠক করছেন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সদস্যরা। ইসি সূত্র জানায়, তারা ফেব্রুয়ারিকে ডেডলাইন ধরে পুরোদমে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এরই মধ্যে সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালার সংশোধনী, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র স্থাপন এবং ব্যবস্থাপনা নীতিমালা, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ নীতিমালা এবং নির্বাচনী সংবাদ সংগ্রহে দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংবাদিক/গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য নীতিমালার সংশোধনী ওয়েবসাইটে প্রকাশের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি। দ্রুত সময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রধান আইন আরপিও সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচন বন্ধে নির্বাচন কমিশন এবং প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের ক্ষমতা পুনর্বহালের উদ্যোগ নিতে ইসি সচিবালয়কে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন এবং সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ কাজও দ্রুত এগিয়ে নিতে চায় ইসি। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ কর্মপরিকল্পনা ইসিতে উপস্থাপন করতে বলা হয়েছে।
জানা যায়, গত ১৩ জুন লন্ডনে তারেক রহমান ও ড. ইউনূসের বৈঠকের পর ফেব্রুয়ারিতেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন মাথায় রেখে প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি। সেই হিসাবে সময় আছে মাত্র আট মাস। আগামী রমজান মাস শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহে (ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে) নির্বাচন আয়োজন করতে হলে চলতি বছরের ডিসেম্বরের শেষ দিকে নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করতে হবে। সুতরাং চলতি বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ, চলতি জুনের মধ্যে ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করা, জুলাই-আগস্টের মধ্যে নতুন দলের নিবন্ধন গেজেট প্রকাশ করতে হবে ইসিকে।
অবশ্য ভোটের সময়সূচি নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীন বলেছেন, ফেব্রুয়ারি বা এপ্রিলের যে সময়েই নির্বাচন হোক না কেন, প্রস্তুতি রয়েছে নির্বাচন কমিশনের। যেদিন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়, তার মাস দুয়েক আগে তপশিল হয়। ভোটের সম্ভাব্য সময় নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে ধারণা পাওয়ার পরই সিদ্ধান্ত নেবে ইসি।
সিদ্ধান্ত না মানলে মনোনয়ন ঝুঁকি
জানা গেছে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর অবস্থানে তারেক রহমান। ভালো কাজের মাধ্যমে মানুষের মন জয়ের ব্যাপারে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন তিনি। জনগণের অপছন্দ—এমন কর্মকাণ্ড কেউ করলে তার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করার কথা জানিয়েছেন তিনি। কেন্দ্রীয় নেতাদের তারেক রহমান স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, কমিটি গঠন কিংবা আধিপত্য বিস্তার, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকে পুনর্বাসনসহ যে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা বরদাশত করা হবে না। যত বড় ত্যাগী নেতাই হোন না কেন, যতই মামলা কিংবা জেল-জুলুমের শিকার হোন না কেন, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকলে সাংগঠনিক ব্যবস্থার পাশাপাশি প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া হবে। তারেক রহমান গত ১৩ জুন লন্ডনে ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকের পর ব্যক্তিগতভাবে বিএনপি মহাসচিব ও স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে কথা বলে নির্বাচন সামনে রেখে কিছু নির্দেশনার কথা বলেছেন। এ ছাড়া গত ১৬ জুন রাতে রাজধানীর গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক কর্মশালায় লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে দলীয় এমন কঠোর অবস্থানের কথা জানান তারেক রহমান। ওই কর্মশালায় টকশো আলোচক, বিএনপি নেতা এবং বিএনপিপন্থি পেশাজীবী নেতাদের নিয়ে মিডিয়া সেল কর্মশালার আয়োজন করে।
নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীদের জন্য তারেক রহমানের এই বার্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোনো মনোনয়নপ্রত্যাশী কিংবা তার অনুসারী কেউ দলীয় শৃঙ্খলা ভাঙলে তিনি মনোনয়ন ঝুঁকিতে পড়বেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিএনপি আগামীতে জনগণের ভোটে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে আওয়ামী লীগ আমলে সংঘটিত গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করবে। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ আমলে দুর্নীতি, লুটপাট, টাকা পাচার, ভোট ডাকাতি, গুম-খুনের প্রতিটি ঘটনার বিচার হবে। ফলে আওয়ামী লীগের মতো বিএনপির কেউ অনৈতিক কর্মকাণ্ড করলে তা কঠোরভাবে দমন করা হবে।
অবশ্য দেশের বিভিন্ন স্থানে দলের কিছু নেতাকর্মীর অনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিব্রত বিএনপির হাইকমান্ড। গত ১৫ জুন নরসিংদীর পলাশে বিএনপি ও ছাত্রদলের মধ্যে সংঘর্ষে এক ছাত্রদলকর্মী গুলিবিদ্ধসহ উভয়পক্ষের তিনজন আহত হন। একই দিন গাজীপুরের কালিয়াকৈরে কমিটি নিয়ে বিএনপির দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে ১০ জন আহত হন। তা ছাড়া গত ২০ জুন নেত্রকোনায় বিএনপি নেতা খোকন আহমেদের গুদাম থেকে ৩০৪ বস্তা সরকারি চাল উদ্ধারের ঘটনা ঘটে। এতে দলের নীতিনির্ধারকরা চরম ক্ষুব্ধ হয়েছেন।
মাঠ জরিপ করছে একাধিক টিম
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ব্যক্তির সমন্বয়ে একাধিক টিম সম্ভাব্য দলীয় এমপি প্রার্থী বাছাইয়ে জরিপ করছেন। যারা বিভিন্ন মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে একটি তালিকা তৈরি করছেন। এরই মধ্যে কয়েকটি বিভাগের তথ্য সংগ্রহ প্রায় শেষ পর্যায়ে। সব আসনের তথ্য সংগ্রহ শেষ হলে একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে পাঠানো হবে। এরপর আরও যাচাই-বাছাই শেষে প্রার্থী মনোনয়ন চূড়ান্ত করবে বিএনপির পার্লামেন্টারি বোর্ড। এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত কয়েকজন এসব তথ্য জানান।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস কালবেলাকে বলেন, বিএনপি একাধিকবার সরকার পরিচালনাকারী দল। নির্বাচনের প্রস্তুতি সবসময়ই থাকে। এই সরকার যখন নির্বাচনের ঘোষণা দেবে, তখন আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু করব। তবে অনেকেই নিজ নিজ এলাকায় বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখনো প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়নি, এটা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং দলের পার্লামেন্টারি বোর্ড সিদ্ধান্ত নেবে। যারা বিগত আন্দোলন সংগ্রামে ভূমিকা রেখেছেন, হামলা-মামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, আগামী নির্বাচনে তারা মূল্যায়িত হবেন, এটাই স্বাভাবিক।
মন্তব্য করুন