বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকী ঘিরে এবারও রাষ্ট্রীয় কিংবা দলীয় আয়োজনের অতিশয্য ছিল না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে গত বছরের ১৫ আগস্ট ঘিরে গেল দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে চলে আসা মাত্রাতিরিক্ত উন্মাদনার ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি। এবারও পরিস্থিতি ছিল অনেকটা গত বছরের মতোই। কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকায় দলীয়ভাবে কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার সুযোগ না থাকলেও বিভিন্নভাবে দিবসটি পালনের চেষ্টা ছিল আওয়ামী লীগের। তবে প্রশাসনের কঠোরতা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের তৎপরতায় সে চেষ্টা খুব একটা সফল হয়নি।
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ৫০তম বার্ষিকী ঘিরে গতকাল শুক্রবার ধানমন্ডির ৩২ নম্বরজুড়ে দিনভর ছিল নিরপত্তার কড়া বেষ্টনী। সেই বেষ্টনী পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এসে বেশ কয়েকজন মারধর এবং হেনস্তার শিকারও হয়েছেন। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে বড় পর্দায় গান-বাজনার সঙ্গে নাচানাচি করেছেন কিছু মানুষ; বেজেছে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ফাঁসির আসামি মেজর ডালিমের ভাষণও।
বৃহস্পতিবার রাতেই সেখানে ট্রাকে করে বড় স্পিকার আনা হয়। ট্রাকে বসানো হয় বড় পর্দা। কিছু সময় পরপর সেখানে দেখানো হয় ‘জুলাই গণহত্যার’ প্রামাণ্যচিত্র। স্পিকার ও মনিটরে গান বাজিয়ে নাচতে দেখা যায় কিছু লোকজনকে। শুক্রবার সকাল থেকেই ৩২ নম্বরে সাধারণ মানুষের ঢোকা বন্ধ করে দেয় পুলিশ। তবে আগের দিন এনে রাখা সেই ট্রাকেই বাজানো হয় বঙ্গবন্ধুর খুনি হিসেবে দণ্ডপ্রাপ্ত মেজর ডালিমের ভাষণ। ভাষণের সময় স্ক্রিনে মেজর ডালিমের ছবি ভাসছিল আর লেখা ছিল, ‘মেজর ডালিমের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ’।
গতকাল সকালে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, মিরপুর রোড থেকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের প্রবেশ মুখে বাস দিয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা। এই প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে ভেতরে সাধারণ মানুষ যেতে পারছে না। সড়কের দুই পাশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কয়েকজন নেতাকর্মী রয়েছেন। তারা গণমাধ্যমের সামনে বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন। এ ছাড়া শেখ মুজিবুর রহমানের ভাঙা বাড়ির সামনে কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে পাহারা দিতে দেখা যায়।
দুপুর সোয়া ১২টার দিকে ৩২ নম্বর সড়কের পূর্ব পাশে ফুল নিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন আজিজুর রহমান নামে এক রিকশাচালক। তার রিকশার সামনে রাখা ছিল ফুলের তোড়াটি। ওই ফুলের তোড়ার ওপর লেখা ছিল, ‘১৫ই আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫১তম মৃত্যুবার্ষিকীতে সাধারণ রিকশাওয়ালা হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে শ্রদ্ধা জানাতে নিজের সৎ উপার্জনের টাকা দিয়ে ফুল কিনে এসেছি। আমি কোনো দল করি না। শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ভালোবাসি।’ আজিজুর রহমান ৩২ নম্বরে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে গণমাধ্যমকর্মীরা তাকে ঘিরে ধরেন। তখন তিনি বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনাকে ফেরাতে আসিনি। আমি বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসি। তাই আমার হালাল টাকা দিয়ে কেনা ফুল নিয়ে এসেছি।’
এ সময় তার রিকশাটি রাস্তার পাশে উল্টে ফেলে রাখা হয়। পরে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে ঘটনাস্থল থেকে চলে যেতে সহায়তা করে। সকাল থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত এ রকম বেশকিছু ঘটনা ঘটে ৩২ নম্বর সড়কের পূর্ব ও পশ্চিম পাশে।
সকাল সোয়া ৯টায় ৩২ নম্বরের সড়কের পশ্চিম পাশে তিন সন্তানসহ শ্রদ্ধা জানাতে আসেন এক দম্পতি। তখন তারা স্থানীয় বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীদের রোষানলে পড়েন। বাগবিতণ্ডার এক পর্যায়ে পুলিশ তাদের সেখান থেকে সরিয়ে দেয়। তারা পিরোজপুর থেকে এক মাস আগে ঢাকায় এসেছেন বলে দাবি করেন। সকাল ১০টার দিকে এক নারী শেরেবাংলা নগর থেকে ফুল দিতে আসেন। এ সময় তাকেও হেনস্তা করা হয়। হালিমা নামে ওই নারী বলেন, ‘শেখ মুজিবের পরিবারের সদস্যদের শ্রদ্ধা জানাতে এসেছি। আমি আওয়ামী লীগ করি। এ সময় পুলিশ তাকে রিকশায় করে পাঠিয়ে দেয়।’ ঘটনাস্থলে থাকা একটি রাজনৈতিক দলের কর্মী পরিচয় দেওয়া তানজীব নামে এক যুবককে গণমাধ্যমে বলতে শোনা যায়, ‘ধানমন্ডিতে মানুষ যাতে শান্তিতে থাকতে পারে এবং আওয়ামী লীগের লোকজন যাতে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে না পারে, সেজন্য পুলিশের পাশাপাশি আমরা এখানে আছি। দু-একজন আওয়ামী লীগের লোক এসেছিল, আমরা তাদের সরিয়ে দিয়েছি।’
মিরপুর রোড থেকে ৩২ নম্বর সড়কে ঢুকে একটু সামনে এগোলে লেকের ব্রিজ ঘেঁষা ফাঁকা জায়গায় একটি বড় পর্দা দেখা যায়। সেই পর্দার পাশে বিশালাকার সাউন্ডবক্সে শোনা গেছে, ‘৩৬ জুলাই নাকি ৩৬ জুলাই’সহ নানা দেশের গান। পাশে থাকা কয়েকজনকে বলতে শোনা যায়, ‘আজ সারারাত এখানে ডিজে গান বাজানো হবে।’ এ পথেই সড়কের ডান পাশ ঘিরে রাখা হয়েছে একটি আর্মড পার্সোনেল ক্যারিয়ার ও জল কামানের গাড়ি।
গতকাল সকালে ঘটনাস্থলে সাদা পোশাকে থাকা ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ক্যশৈন্যু মারমা গণমাধ্যমে বলেন, ‘৩২ নম্বরে নাশকতার পরিকল্পনার কোনো গোয়েন্দা তথ্য নেই। সরকারিভাবে যেহেতু তাদের (আওয়ামী লীগ) কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে, আমরা সেই নির্দেশনা ফলো করব।’ প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমের দেওয়া ‘নির্দেশনা’ পুলিশ অনুসরণ করছে দাবি করে ওসি বলেন, ‘আপনারা হয়তো লক্ষ করে থাকবেন, কিছুদিন আগে আমাদের যে প্রেস সচিব, তিনি কিছু ইন্সট্রাকশন্স দিয়েছিলেন। সেই ইন্সট্রাকশন্স মোতাবেক আমরা কাজ করব।’
তবে পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়ার বিষয়টি নাকচ করেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। গতকাল পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়ার প্রসঙ্গে যে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে, সেটির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি গণমাধ্যমে বলেন, ‘না, পুলিশ তো ইন্সট্রাকশন পায় তাদের চিফের কাছ থেকে। আমরা তো আমাদের তরফ থেকে কোনো ইন্সট্রাকশন দিই না। পুলিশ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার মতো করে কাজ করে।’
গত কয়েক দিন আগের একটি সংবাদ সম্মেলনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি আরও বলেন, ‘আমাকে কয়দিন আগে সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, আওয়ামী লীগ যদি ১৫ আগস্টে কর্মসূচি পালন করে, সেক্ষেত্রে আপনারা কী করবেন। আমরা বলেছি যে, আওয়ামী লীগের অ্যাক্টিভিটিজ ব্যান। ফলে আওয়ামী লীগ ১৫ আগস্ট বা যে কোনো সময় যদি মিটিং-মিছিল করে, তাহলে অবশ্যই সেটা ব্যান অর্গানাইজেশনের অ্যাগেইনস্টে যে বিধি, সে অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেটা ১৫ আগস্টেও যে রকম, সেটা অন্যান্য দিনেও সেরকম।’ প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবের বক্তব্য ধরে পরে গতকাল বিকেলে ধানমন্ডি থানার ওসির কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি ‘ভুল’ করে প্রেস সচিবের প্রসঙ্গটি টেনেছেন।
মন্তব্য করুন