ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) এবারের নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন ৪৭১ জন শিক্ষার্থী। হল সংসদ নির্বাচনসহ সে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫০৬ জনে। ডাকসুর ইতিহাসে এত বেশি প্রার্থী আর কখনোই প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাঠে নামেননি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা, বিশেষ করে ভিপি পদে। কেন্দ্রীয় সংসদের পদগুলোর মধ্যে আবার সবচেয়ে বেশি প্রার্থী সহসভাপতি (ভিপি) পদে ৪৫ জন, যা নিয়ে ক্যাম্পাস ও ক্যাম্পাসের বাইরে চলছে নানা আলোচনা। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রার্থী হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কোনো মানদণ্ড না থাকায় যে কোনো শিক্ষার্থী চাইলেই মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারছেন। অনেকেই শুধু প্রচারের আলোয় আসতে বা পরিচিতি পেতে ডাকসুর শীর্ষ এ পদে প্রার্থী হয়েছেন বলে মন্তব্য তাদের।
ডাকসু নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকার ৪৭১ জনের মধ্যে ভিপি পদে সর্বোচ্চ ৪৫ জন, জিএস পদে ১৯ এবং এজিএস পদে লড়ছেন ২৫ জন। ভিপি পদে ৪৫ জনের মধ্যে রয়েছেন পাঁচ নারী শিক্ষার্থী। সর্বশেষ ২০১৯ সালের নির্বাচনে ডাকসুর ২৫টি পদের বিপরীতে লড়েন ২২৯ প্রার্থী। যার মধ্যে ভিপি পদে ছিলেন ২১ জন।
কালবেলার সঙ্গে কথা হওয়া এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীর অনেকে জানিয়েছেন, ভিপি পদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই তাদের কাছে অচেনা।
অনেকের নামই তারা প্রথমবার শুনছেন। দেশজুড়ে আলোচনায় থাকা এ নির্বাচনের ভোটাররা মনে করছেন, কেউ কেউ ভিপি পদে নির্বাচন করছেন শুধু শখের বশে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী সৈয়দ আব্দুর রহীম কালবেলাকে বলেন, ‘চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পর দেখা যাচ্ছে ৪৫ জন ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তাদের মধ্যে মাত্র ১০ থেকে ১২ জনের নাম আগে থেকে কিছুটা পরিচিত, অন্যদের অধিকাংশের নাম প্রথমবারের মতোই শুনছি বলা যায়। অনেকেই কেবল শখের বশে প্রার্থী হয়েছেন, আবার কেউ কেউ কেবল ক্যাম্পাসে পরিচিতি লাভের উদ্দেশ্যে মনোনয়নপত্র তুলেছেন বলেই মনে হচ্ছে।’
প্রায় একই ধরনের তথ্য জানান বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী আদনান আলম। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘এবার অনেক বেশি প্রার্থী হয়েছেন। ভিপি পদের প্রার্থী তালিকা দেখে নিজেই অবাক হয়েছি। দেখলাম এদের মধ্যে অল্প কিছু প্রার্থীকে চিনি। তাদের মধ্যে ক্যাম্পাসের খুব পরিচিত মুখ হাতেগোনা রয়েছে। এ ছাড়া এত এত ভিপি প্রার্থীর অনেককেই সেভাবে প্রচার-প্রচারণায় আসতেও দেখিনি। শুধু অনলাইনেই দেখেছি কাউকে কাউকে।’
ভিপি প্রার্থীদের মধ্যে সরাসরি প্রচারে সক্রিয় হাতেগোনা কয়েকজন। বাদবাকিরা ভোট চাইতে সশরীরে শিক্ষার্থীদের কাছে যাচ্ছেনই না। কিছুসংখ্যক প্রার্থীকে অনলাইনে প্রচার চালাতে দেখা যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ নিজের সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত করতেও নামকাওয়াস্তে ডাকসু নির্বাচনকে বেছে নিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে।
শিক্ষার্থীদের কাছে তুলনামূলক কম পরিচিত এক ভিপি প্রার্থীর সঙ্গে কথা হয় কালবেলার। তিনি জানান, সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই ভিপি পদে নির্বাচন করছেন। পূর্ণাঙ্গ প্যানেল দিতে চাইলেও তেমন প্রার্থী খুঁজে না পাওয়ায় তা দিতে পারেননি তারা। তিনি বলেন, ‘সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমি দাঁড়িয়েছি। ক্যাম্পাসে খুব পরিচিত না হওয়ায় এর মাধ্যমে নিজেকেও জানান দেওয়া হবে। জয়ের ব্যাপারে তেমন চিন্তা করছি না, তবে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পরিচিত হতে চাই।’
এবারের ডাকসু নির্বাচনে এজিএস প্রার্থী ফাতেহা শারমিন এ্যানী বলেন, ‘এবার অনেক বেশি প্রার্থী। অনেকে হয়তো সিভি ভারী করার জন্যই দাঁড়িয়েছেন। তবে আমি বিশ্বাস করি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যোগ্য প্রার্থীকেই ভোট দিয়ে জয়ী করবেন।’
এবারের নির্বাচনে ভিপি পদে প্রার্থী আবু তৈয়ব হাবিলদার। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০১-০২ সেশনের এবং বর্তমানে চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। বিগত সময়ে নির্যাতনের শিকার হওয়ায় ঢাবির নিয়মানুযায়ী ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে পুনঃভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থীরা তাকে চেনেনই না। তবে তিনি নিজেই জানিয়েছেন, ইতিহাসের অংশ হতেই ভিপি পদে লড়ছেন।
নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে কেন তিনি নির্বাচনে ভিপি পদে লড়বেন তার বর্ণনা দিতে গিয়ে আবু তৈয়ব বলেন, ‘গণতন্ত্রের বিকাশে অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। তাই ভোটে দাঁড়িয়েছি, সেটা আমার অধিকার বটে। ছাত্রছাত্রীরা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে। আমাকে তাদের ভোট দিতে হবে কেন? তাদের কাছ থেকে আমাকে ভোট চাইতে হবেই বা কেন? আমি তাদের কাছে কোনো ভোট চাই না, বড় ভাই হিসেবে ভালোবাসা চাই।’
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও ঢাবির সাবেক শিক্ষার্থী মামুন আহমেদ কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা ডাকসুর ইতিহাসে এত বেশি ভিপি প্রার্থী দেখিনি। আগে দেখতাম যারা ক্যাম্পাসে অধিক পরিচিত, তারাই এ পদে প্রার্থিতা করতেন। এবার পরিচিতির বাইরেও প্রচুর প্রার্থীকে অংশগ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে। মনে হলো অনেকে শুধু নিজে ডাকসুতে ভিপি পদে প্রার্থী হয়েছেন, এ পরিচিতি ব্যবহারের জন্যই দাঁড়িয়েছেন। তবে শীর্ষ এ পদে ভালো ক্যান্ডিডেটরা থাকলেই মানসম্মত হতো।’
ভিপি পদেসহ মোট প্রার্থী সংখ্যাকে অস্বাভাবিক বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আহমেদ নয়ন। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘ডাকসুতে এবার প্রার্থী আর প্রার্থী। ভিপি পদেই ৪৫ জন! শোনামাত্রই মনে হয়, এ যেন ভিপি নির্বাচনের বদলে ভিআইপি লটারির টিকিট। ডাকসুর ভিপি প্রার্থী ছিলাম, বলতেই যেন কত বড় শোনা যায়। নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা ভালো, তাতে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু প্রতিযোগিতা কোথায়, কখন করা উচিত, সেটা বোঝাও খুব জরুরি।’
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আইনুল ইসলাম বলেন, ‘এটা ঠিক যে, এবার ডাকসু নির্বাচনে অনেক বেশি প্রার্থী হয়েছেন। ভিপি পদেও সংখ্যাটা অনেক বেশি। এটা সত্য, অনেকেই হুজুগে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন। অথবা পরিচিতি পাওয়ার জন্য ইলেকশন করছেন। ভোট হয়তো বেশি পাবেন না, কিন্তু তিনি ইলেকশন করছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখানে আবার আমরা গণতান্ত্রিক ধারা যদি মেনে চলি, তাহলে কাউকে বাধা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আবার এমনও না যে, ২০০ ভোটারের ভোট নিয়ে আসতে হবে, এরকম কোনো বিধানও নেই। তারপর এখানে কোনো ফিন্যান্সিয়াল রুলসও নেই। মানে কত টাকা খরচ করতে পারবে। এ ধরনের কোনো রুলসও আমরা এখানে দিইনি। এমনকি আমরা যখন মনোনয়নপত্র জমা নিয়েছি, তখন তাদের কোনো সাপ্লিমেন্টারি ডকুমেন্টস আমরা নিইনি। শুধু শিক্ষার্থী হলেই নির্বাচনে অংশ নিতে পারছেন। তবে এ জিনিসগুলো পরে চেঞ্জ করতে হবে। কারণ, কিছু জিনিস লাগবে, কিছু ডকুমেন্টেশন হলে তখন প্রার্থীর সংখ্যা হয়তো কমে আসত। বর্তমানে যদি কোনো শিক্ষার্থী প্রার্থী হতে আগ্রহী হয়, তাহলে আমরা তো তাকে আসলে সরাতে পারব না। গণঅভ্যুত্থানের পর শিক্ষার্থীরা কোনো বাধা ছাড়া স্বতঃস্ফূর্তভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারছে, প্রার্থী বেশি হওয়ার এটাও একটা কারণ। কিন্তু এটা ঠিক যে, সংখ্যাটা অতিরিক্ত হয়ে গেছে।’
মন্তব্য করুন