জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা জোবায়েদ হোসেনকে হত্যার পরিকল্পনা এক মাস আগেই করা হয়। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কেনা হয় ছুরি। এরপর গত রোববার সেই ছুরি দিয়ে হত্যা করা হয় জোবায়েদকে।
জোবায়েদ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনের দাবিতে করা সংবাদ সম্মেলনে গতকাল এসব কথা বলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এস এন মো. নজরুল ইসলাম ও ডিএমপির লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মল্লিক আহসান উদ্দিন সামী। তারা জানান, এই হত্যাকাণ্ডের কোনো রাজনৈতিক মোটিভ নেই। বরং ‘ত্রিভূজ প্রেমের’ কারণে হত্যাকাণ্ডটি ঘটানো হয়েছে।
গত রোববার পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় বর্ষা যে ভবনে থাকে, সেই ভবনের সিঁড়ি থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল নেতা জোবায়েদের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। চাঞ্চল্যকর এই ঘটনায় জোবায়েদের ছাত্রী বর্ষা, তার প্রেমিক মাহীর ও প্রেমিকের বন্ধু ফারদীন আহম্মেদ আয়লানকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তারের পর তাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাতে ডিসি মল্লিক আহসান উদ্দিন সামী জানান, কথা কাটাকাটি ও ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে বাসার নিচেই জোবায়েদের গলায় ছুরি চালিয়ে দেয় মাহীর আহমেদ। রক্তমাখা শরীর নিয়েই সেখান থেকে সিঁড়ি বেয়ে বাসার উপরে উঠতে উঠতে অনেকের ফ্ল্যাটের দরজায় কড়া নেড়ে সহায়তা চান জোবায়েদ। তবে কেউই দরজা খোলেনি। একতলা, দোতলা পেরিয়ে তিন তলার সিঁড়ির মাঝামাঝি পৌঁছে দেখেন, সেখানে দাঁড়িয়ে ছাত্রী বার্জিস শাবনাম বর্ষা। হত্যাকাণ্ডের পুরো সময় মেয়েটি সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। তার কাছে জোবায়েদ আকুতি জানিয়ে বলেন, ‘আমাকে বাঁচাও।’ জবাবে বর্ষা বলে, ‘তুমি না সরলে আমি আমার প্রেমিকের হবো না।’ জোবায়েদ এর পরই লুটিয়ে পড়েন এবং একপর্যায়ে নিস্তেজ হয়ে যান।
এক প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত কমিশনার নজরুল বলেন, ‘মেয়েটি দুই দিকেই সম্পর্ক বজায় রেখেছে। হয়তো সে ডিসিশন নিতে পারছিল না। ছোট মানুষ, তার আগের প্রেমিক ব্যাপারটা জানার পর হয়তো চাপ দিয়েছে। এরপর ২৬ সেপ্টেম্বর থেকেই মেয়েটি ও তার আগের প্রেমিক মিলে জোবায়েদকে হত্যার পরিকল্পনা করে।’
এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তিনজনের নাম উল্লেখ এবং আরও কয়েকজনকে অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করে গতকাল সকালে বংশাল থানায় মামলা করেন জোবায়েদের ভাই এনায়েত হোসেন। জোবায়েদ হত্যায় জড়িত তিনজনকে গ্রেপ্তারের তথ্য দিতে গতকাল দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসে অতিরিক্ত কমিশনার নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এই ঘটনার সঙ্গে বরগুনার রিফাত হত্যায় তার স্ত্রী মিন্নির জড়িত থাকার ঘটনার সামঞ্জস্য পাওয়া গেছে। এটা মিন্নির ঘটনার সঙ্গে মোটামুটি সিমিলার।’ তিনি আরও বলেন, ‘পাশাপাশি বাড়িতে ওই মেয়েটি (বর্ষা) ও তার প্রেমিকের (মাহীর) বেড়ে ওঠা ছোটবেলা থেকে। তাদের প্রেমের সম্পর্ক ছিল দেড় বছরের মতো। আর জোবায়েদ মেয়েটিকে তার বাড়িতে গিয়ে পড়াতেন প্রায় এক বছর ধরে। প্রায় এক মাস আগে পুরোনো প্রেমিক জানতে পারে, জোবায়েদের সঙ্গে মেয়েটির প্রেমের সম্পর্ক আছে। বিষয়টি মেনে নিতে না পারায় তাদের মধ্যে ঝগড়া হয়। মেয়েটি তখন তার পুরোনো প্রেমিককে বলে, ‘জোবায়েদকে না সরাতে পারলে তোমার হতে পারব না।’
ডিসি মল্লিক আহসান উদ্দিন সামী জানান, জোবায়েদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কের বিষয়ে গত ২৬ সেপ্টেম্বর মাহীর চাপ প্রয়োগ করে বর্ষার ওপর। সেদিনই তারা গৃহশিক্ষক জোবায়েদকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী মাহীর ও তার বন্ধু আয়লান চাকু কিনে গত রোববার ওই মেয়ের বাসার নিচে অবস্থান নেয়। আর মেয়েটি তার গৃহশিক্ষক জোবায়েদকে ডেকে আনে। এরপরই মেয়েটির বাসার সিঁড়িঘরে মাহীর জোবায়েদকে বলে বর্ষাকে ভুলে যেতে। জবাবে জোবায়েদ বলে, ‘সে তো আমাকে পছন্দ করে।’ এ সময় তাদের মধ্যে তর্কাতর্কির একপর্যায়ে ছুরি দিয় জোবায়েদের গলায় পোঁচ দেয় মাহীর।
ঘটনার রাতেই পুলিশ বর্ষাকে হেফাজতে নিয়েছে জানিয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার নজরুল ইসলাম বলেন, পরদিন বাকি দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। জানা গেছে, মেয়েটি পড়াশোনা করে ঢাকা মহানগর মহিলা কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে। আর মাহীর পুরান ঢাকার শেখ বোরহান উদ্দীন কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকের প্রথম বর্ষের ছাত্র। জোবায়েদ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন। এ ছাড়া কুমিল্লা জেলা ছাত্র কল্যাণ সংসদের সভাপতির দায়িত্বও পালন করছিলেন তিনি।
এদিকে, গ্রেপ্তার তিনজনকে গতকাল আদালতে তোলা হলে তারা জোবায়েদ হোসেন হত্যা মামলায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে রাজি হয়।
মন্তব্য করুন