তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে বিচারপতি খায়রুল হকসহ চার বিচারপতির দেওয়া রায়কে ‘রং হেডেড জাজমেন্ট’ বলে মন্তব্য করেছেন আপিলকারী পক্ষের আইনজীবী। এ ছাড়া এ রায় সংবিধানের মূল কাঠামোকে (বেসিক স্ট্রাকচারকে) আঘাত করেনি; বরং মূল কাঠামোকে শক্তিশালী করেছে বলেও মন্তব্য করেছেন। এ ব্যবস্থা বাতিল করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে গতকাল মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির বেঞ্চে প্রথম দিনের মতো আপিলের শুনানিতে অংশ নিয়ে আইনজীবী ড. শরীফ ভূঁইয়া এসব মন্তব্য করেন। আজ বুধবার সকালে ফের এ আপিলের ওপর শুনানি শুরু হবে।
এ রায় দিতে গিয়ে সব ক্ষেত্রে আদালত ভুল করেছেন উল্লেখ করে আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া বলেন, উনারা সাংবিধানিক ব্যাখ্যার নিয়মনীতি মেনে রায় দেননি, উনারা দেশের বাস্তবতাও বিবেচনায় নেননি। উনাদের রায়ের ফলে দেশ যে গণতন্ত্রহীন হয়ে পড়বে, দেশে স্বৈরতন্ত্র চালু হবে এবং এক-দেড় হাজার মানুষকে জীবন দিয়ে সরকার পরিবর্তন করতে হবে—এগুলো কোনোটাই তারা বুঝতে পারেননি। একটি সাংবিধানিক আদালত হিসেবে এগুলো বিবেচনায় নিয়ে রায় দেওয়া উচিত ছিল; কিন্তু সেটা বিবেচনায় না নিয়েই ভুল রায় দিয়েছেন। উনারা আইন বুঝতে ও প্রয়োগ করতে ভুল করেছেন এ রায়ের মাধ্যমে।
২০১১ সালের ১০ মে বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল ঘোষণা করা হয়। এ রায়ে চার বিচারপতি এ ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে থাকলেও বেঞ্চের বাকি তিন বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে ছিলেন। এ ছাড়া রায়ের পর্যবেক্ষণে আরও দুটি সংসদ নির্বাচন এ ব্যবস্থার অধীনে হতে পারে বলে মত দেওয়া হয়। কিন্তু সে পর্যবেক্ষণ উপেক্ষা করে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই সংবিধান সংশোধন করে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিলোপ করে। এ ব্যবস্থা বিলোপ করে রাতের ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকে আওয়ামী লীগ। ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর আপিল বিভাগের সেই রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে পৃথক পাঁচটি রিভিউ আবেদন করা হয়। পরে আপিল বিভাগ রিভিউ মঞ্জুর করে বিষয়টি আপিল আকারে শুনানির নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী গতকাল শুনানি হয়।
প্রথম দিনে ড. বদিউল আলম মজুমদারের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া। তাকে সহায়তা করেন ব্যারিস্টার কারিশমা জাহান। আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া শুনানিতে বলেন, ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের বেসিক স্ট্রাকচার আরও সুরক্ষিত করা হয়েছে। সংবিধানের মূল কাঠামো (বেসিক স্ট্রাকচার) হলো জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন। এই বেসিক স্ট্রাকচার সংসদও পরিবর্তন করতে পারে না। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন ছিল জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন। এটা সংবিধানের বেসিক স্ট্রাকচারের অংশ। যেমনভাবে বেসিক স্ট্রাকচারের অংশ হয়েছে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলও। বাহাত্তরের সংবিধানে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল ছিল না। এটি সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে এসেছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হলো বেসিক স্ট্রাকচারের অংশ। আর সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত করে। সেজন্য সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল সংবিধানের বেসিক স্ট্রাকচারের অংশ হয়েছে। একইভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাও বেসিক স্ট্রাকচারের অংশে পরিণত হয়েছে।
শুনানির পর শরীফ ভূঁইয়া সাংবাদিকদের বলেন, ত্রয়োদশ সংশোধনীর শুনানি শুরু হয়েছে। রিভিউটা আপিলে কনভার্ট হয়েছে। রিভিউতে আদালত লিভ দিয়েছেন। মূল শুনানিটা শুরু হলো। শুনানিতে আমরা আদালতকে বলেছি, সাংবিধানিক বিষয় ব্যাখ্যা করার কিছু রীতি-নীতি, পদ্ধতি আছে। বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বে রায়ের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছিল। বাতিল করার ক্ষেত্রে উনারা সেই রীতি-নীতি পদ্ধতিগুলো প্রয়োগ করতে ভুল করেছেন। প্রয়োগ করতে ভুল করা এবং সংবিধান ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে ভুল করার জন্যে ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। ভুল সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে উনারা ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে দিয়েছিলেন। ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। নির্বাচনকালীন সময়ে দায়িত্বে থাকবেন, যাতে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
তিনি বলেন, বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকরা মনে করেছেন যে, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা গণতন্ত্রের পরিপন্থি। কারণ, উনারা অনির্বাচিত। এরকম বলেছেন যে, অনির্বাচিত ব্যক্তি ৩০ দিন ক্ষমতায় থাকলে দেশের গণতান্ত্রিক চরিত্র নষ্ট হয়ে যায়। উনারা যেটা বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে, অনির্বাচিত ব্যক্তি এক দিনও ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না। এই যে ব্যাখ্যা উনারা দিলেন, এর ফলাফল কি হলো? এর ফলাফল যেটা হলো যে, ১০ বছরের ওপরে সময় অনির্বাচিত সরকার দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হওয়ার পর যে নির্বাচনগুলো হয়েছে, জনগণ জানে এগুলো কোনো নির্বাচনই হয়নি। এগুলো এক তরফা নির্বাচন হয়েছে। মূলত নির্বাচন হয়নি, সিলেকশন হয়েছে, কোনো নির্বাচন হয়নি। ৩০ দিন অনির্বাচিত ব্যক্তি থাকতে পারবে না বলার ফল দাঁড়িয়েছে।
আইনটা ব্যাখ্যা করতে ভুল করেছেন উল্লেখ করে শরীফ ভূঁইয়া বলেন, সংবিধানের ব্যাখ্যা করতে হলে দেশের য়ে রাজনৈতিক বাস্তবতা, ব্যাখ্যার ফলাফল কী দাঁড়াবে, এগুলো বিবেচনায় নিতে হয়। ত্রয়োদশ সংশোধনী একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে এটা গৃহীত হয়। ৯৬ সালে যখন এই ব্যবস্থা গৃহীত হয়, তখন এটা দাবি করেছিল আওয়ামী লীগ। আর বিএনপি তা মেনে নিয়েছিল, অন্যান্য রাজনৈতিক দল মেনে নিয়েছিল। সব রাজনৈতিক দল, জনগণ, সিভিল সোসাইটিসহ সচেতন মহলের দাবি ছিল নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করার। এই যে নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করার যে ইতিহাস, সেটা কিন্তু সংবিধান ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় উপাদান, কিন্তু বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন যে বেঞ্চ, এগুলো বিবেচনায় না নিয়েই সেটাকে বাতিল ঘোষণা করেন। এটা বাতিলের ফলাফল কী হবে, এ ব্যবস্থা কীভাবে এসেছিল, সেগুলো বিবেচনায় নেয়নি। আমাদের দেশের যে সুনির্দিষ্ট সমস্যা নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা, সেগুলো বিবেচনায় না নিয়ে অপ্রয়োজনীয়ভাবে সাড়ে সাতশ পৃষ্ঠার রায় লিখেছেন। এ রায়টা আইনগতভাবে, কাঠামোগতভাবে দুর্বল।
বিচারপতি খায়রুল হকের সঙ্গে একমত পোষণকারী আরও তিন বিচারপতি বলেছেন যে, তত্ত্বাবধয়াক ব্যবস্থার মাধ্যমে অনির্বাচিত ব্যক্তিরা ক্ষমতায় থাকেন। অনির্বাচিত সরকার এক দিনও ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। অন্য তিন বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রেখে যে রায় দিয়েছেন, সেখানে এ যুক্তিটা খণ্ডন করে বলা হয়েছে, আমাদের দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াও অনির্বাচিত ব্যক্তিরাও ক্ষমতায় থাকেন। যেমন—টেকনোক্র্যাট কোটার মন্ত্রী। এ প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি একটা দারুণ উদাহরণ দিয়েছেন। গত ১০ বছরে অনেক উপদেষ্টাও মন্ত্রী পদমর্যাদায় ক্ষমতায় থেকেছেন। কাজেই দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে আমরা অনির্বাচিত ব্যক্তিকে মেনে নিচ্ছি। জনগণ যেহেতু মেনে নিচ্ছে, নির্বাচনের ৯০ দিন অনির্বাচিত সরকার জনগণ যদি মেনে নেয়, তাহলে আদালত কেন বলবেন সে ব্যবস্থা ঠিক নয়। জনগণ হলো সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আদালত কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের আন্দোলনের চাপে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী আনে বিএনপি সরকার। ওই বছর ২৭ মার্চ সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির প্রবর্তন ঘটে। এরপর এই পদ্ধতির অধীনে ১৯৯৬ সালে সপ্তম, ২০০১ সালে অষ্টম এবং ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। ২০০৪ সালে বিএনপি-জামায়াতের চার দলীয় জোট সরকারের আমলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অগণতান্ত্রিক ও সংবিধানবহির্ভূত আখ্যা দিয়ে আইনজীবী এম সলিমউল্যাহসহ তিন আইনজীবী হাইকোর্টে একটি রিট করেন। শুনানির পর তিন বিচারপতির বৃহত্তর বেঞ্চ ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট রায় দেন। রায়ে বলা হয়, ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধানসম্মত ও বৈধ। এ সংশোধনী সংবিধানের কোনো মৌলিক কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি।
পরে রিট আবেদনকারীরা হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। ২০১০ সালে আপিলে শুনানি শুরু হয়। সর্বোচ্চ আদালত এ মামলায় অ্যামিকাস কিউরি (আদালতকে সহায়তাকারী) হিসেবে দেশের আটজন সংবিধান বিশেষজ্ঞের বক্তব্য শোনেন। তাদের প্রায় সবাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দেন। এমনকি সে সময়ের অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে মত দেন। তখনকার প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকসহ আপিল বিভাগের সাতজন বিচারপতি শুনানি গ্রহণ করেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে রায় দেন। এ ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে ছিলেন বিচারপতি খায়রুল হকসহ চারজন। আর তিনজন ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে ২০১১ সালের ১০ মে সংখ্যাগরিষ্ঠের দেওয়া রায়ে বলা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অর্থাৎ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী আইন অগণতান্ত্রিক এবং তা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ফলে তা বাতিলযোগ্য। তবে প্রয়োজনের নিরিখে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে। এই রায় ঘোষণার সাত দিন পর অর্থাৎ ১৭ মে অবসরে যান এ বি এম খায়রুল হক। অবসরে যাওয়ার প্রায় ১৬ মাস পর ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়।
তখন সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের বিরুদ্ধে রায় পরিবর্তনের অভিযোগ ওঠে। পূর্ণাঙ্গ রায় থেকে ‘তবে প্রয়োজনের নিরিখে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে’। এই পর্যবেক্ষণ বাদ দেওয়া হয়। পরে এই পূর্ণাঙ্গ রায়কে আশ্রয় করে দলীয় সরকারের অধীনে পরপর তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন করে ক্ষমতায় টিকে থাকেন শেখ হাসিনা। জুলাই অভ্যুত্থানে গত বছর ৫ আগস্ট তার পতন ঘটে।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর ২৭ আগস্ট ওই রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে (রিভিউ) আপিল বিভাগে আবেদন করেন বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ ব্যক্তি। এরপর ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় বাতিল চেয়ে গত ১৭ অক্টোবর আবেদন করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতে ইসলামীও। এ ছাড়া আরও দুটি আবেদন করা হয়। পাঁচবার এ আবেদনগুলোর শুনানি পেছানোর পর মঙ্গলবার প্রথম দিনের শুনানি হয়।
মন্তব্য করুন