কার্গো ভিলেজ এলাকায় আগুন লাগার পর বিমানববন্দরের কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে প্রথমে ধোঁয়া দেখা যায়। এরপরই সেখান থেকে বিষয়টি সিভিল এভিয়েশন অথরিটির (বেবিচক) নিজস্ব ফায়ার ইউনিটকে জানানো হয়। মাত্র ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই ফায়ার ইউনিট সাড়া দেয়। তবে কার্গো ভিলেজের অ্যাপ্রোন এলাকায় (কার্গো পণ্য রাখার বিশেষ স্থান) আমদানি পণ্য স্তূপ আকারে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখায় আগুনের উৎপত্তিস্থলে পৌঁছে তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। এতে দ্রুতই আগুন ছড়িয়ে পড়ে, যা ভয়াবহ রূপ নিয়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। বেবিচক, প্রত্যক্ষদর্শী সিঅ্যান্ডএফ, কুরিয়ার সার্ভিসকর্মী ও বিমানবন্দরে দায়িত্বরত ফায়ার ইউনিটের সূত্রে এসব তথ্য মিলেছে।
গত শনিবার দুপুরে দেশের প্রধান বিমানবন্দর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ এলাকায় আগুন লাগার পর তা নেভাতে ২৭ ঘণ্টা সময় লাগে। ততক্ষণে আমদানি কমপ্লেক্স এলাকায় রাখা আমদানি করা প্রায় সব মালপত্র পুড়ে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়। এমন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় আগুন লাগলেও তা দ্রুত কেন নিয়ন্ত্রণ করা গেল না, বেবিচকের অত্যাধুনিক ফায়ার ইউনিটের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।
বেবিচক সূত্র জানায়, আমদানি করা পণ্য ২১ দিনের মধ্যে সরিয়ে নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তা না হলে এসব অ্যাপ্রোন এলাকা থেকে সরিয়ে নেওয়ার কথা। কিন্তু কাস্টমস কার্যক্রমের ধীরগতি ও গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কর্মীদের গাফিলতির কারণে তা অ্যাপ্রোন এলাকায় ফেলে রাখা হয়। বিমানবন্দরে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব পালন করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আগুন লাগার খবর পাওয়ার ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে বেবিচকের ফায়ার ইউনিট ঘটনাস্থলে আসে। তবে অ্যাপ্রোন এলাকায় মালপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকায় আগুনের উৎসস্থলে পানির গাড়ি পৌঁছাতে পারেনি। এর ১০ মিনিটের মধ্যে রানওয়ের অন্য পাশ থেকে বিমানবাহিনীর এ কে খন্দকার ঘাঁটি ও ২০ মিনিটের তেজগাঁও থেকে বাশার ঘাঁটি বিমানবাহিনীর ফায়ার ইউনিট ঘটনাস্থলে এসে কার্যক্রম শুরু করে। তবে অ্যাপ্রোন এলাকায় স্তূপ করে রাখা পণ্যের কারণে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। এরপর ফায়ার সার্ভিসের ইউনিটগুলো এলেও ততক্ষণে আগুন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
গতকাল মঙ্গলবার বেবিচক সদর দপ্তরে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সংস্থাটির চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মোস্তফা মাহমুদ সিদ্দিক বলেন, আগুনের সূত্রপাত কোনো আমদানি কুরিয়ার সার্ভিস থেকে হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। রানওয়ের অ্যাপ্রোনে পণ্যসামগ্রী স্তূপ করে রাখা হয়েছিল। এর কারণে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশে সমস্যা হয়। এর দায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স (গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং প্রতিষ্ঠান), ঢাকা কাস্টম হাউস ও সিঅ্যান্ডএফ (ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং) এজেন্টদের। নিয়ম অনুযায়ী ২১ দিনের মধ্যে পণ্য অপসারণের কথা। কিন্তু সেখানে বছর ধরে পণ্য পড়ে থাকে। তবে তিনি তদন্তের স্বার্থে কোনো সংস্থার ওপর দায় দিতে চান না।
আমদানিকারকদের হয়ে পণ্য ছাড় করার দায়িত্বে থাকা সিঅ্যান্ডএফের একাধিক কর্মকর্তা জানান, হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে আমদানি পণ্য রাখতে অত্যাধুনিক কার্গো ভবন তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু বছরের পর বছর সেটি ব্যবহার না করে অ্যাপ্রোন এলাকায় মূল্যবান মালামাল রাখা হচ্ছিল। ঠিকাদারের সঙ্গে বেবিচকের বিল সংক্রান্ত ঝামেলার জন্য সেই ভবন ব্যবহার হচ্ছে না।
ঠিকাদারের সঙ্গে টাকার দ্বন্দ্বে আটকে অত্যাধুনিক কার্গো কমপ্লেক্স: বিমানবন্দরে অত্যাধুনিক নতুন কার্গো ভবন তৈরি হলেও তা বছরের পর বছর ধরে ব্যবহার হচ্ছে না। তবে আগুন লাগার পর ভবনটি নিয়ে সক্রিয় হয়েছে বেবিচক। এরই মধ্যে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিয়ে ভবনটি বুঝিয়ে দিতে বলা হয়েছে। তবে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ‘বকেয়া টাকা’ না পাওয়ায় ভবনটি বুঝিয়ে দিচ্ছে না বলে জানা গেছে।
গতকাল রাজধানীর কুর্মিটোলায় বেবিচক সদর দপ্তরে প্রেস ব্রিফিংয়ে সংস্থাটির চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মোস্তফা মাহমুদ সিদ্দিক জানিয়েছেন, নতুন যে অত্যাধুনিক ইমপোর্ট কার্গো ভবন নির্মাণ করা হয়েছে, সেটি এখনো চালু হয়নি অর্থনৈতিক জটিলতার কারণে। এই ভবন চালু হলে আগুন লাগলে আমরা বাসা থেকেও মনিটর করতে পারতাম। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আর্থিক গ্যাপ রয়ে গেছে—হাজার কোটি টাকার বেশি। আমরা সেই গ্যাপ পূরণে দুই পক্ষের মধ্যে সমন্বয়ের চেষ্টা করছি।
চেয়ারম্যান জানান, বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে একটি যৌথ বোর্ড গঠন করা হয়েছে। সরকারি টাকা ও ঠিকাদারি দাবি-দাওয়ার মধ্যে পার্থক্য মিটলেই নতুন কার্গো ভবনটি হস্তান্তর ও চালু করা হবে।
আন্তর্জাতিকভাবে সমস্যায় পড়তে হবে না বলে আশা বেবিচকের: ভয়াবহ আগুনের কারণে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বা কার্গো ভিলেজের রেটিং কমবে কি না বা আন্তর্জাতিকভাবে এর প্রভাব পড়বে কি না, সে আলোচনা শুরু হয়েছে। তবে বেবিচক চেয়ারম্যান জোর দিয়ে বলেছেন, এতে আন্তর্জাতিকভাবে কোনো প্রভাব পড়বে না। কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, শাহজালালসহ প্রতিটি বিমানবন্দর বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা (আইকাও) নির্ধারিত মানদণ্ড মেনে পরিচালিত হয়। আগুনের মতো একটি দুর্ঘটনা ঘটেছে, যেটা দুঃখজনক। তবে এরপর আমাদের কার্যক্রমগুলো দেখতে হবে। আইকাও প্রটোকল মেনেই আমরা সবকিছু করেছি। এতে আমরা যেখানে আগুন লেগেছিল, আমদানি কার্গো এলাকাতেই সেটা রাখা গেছে। প্রচেষ্টার কারণে কোনো এয়ারক্রাফট বা বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবনে আগুন ছড়াতে পারেনি।
তিনি জানান, যে এলাকায় আগুন লেগেছিল, আইকাও নিয়ম মেনে সেখানে ১৪০টি ফায়ার এক্সটিংগুইসার স্থাপন করা ছিল। গত জুন মাসেও ইমপোর্ট কার্গো এলাকায় ২০০ কর্মীকে অগ্নিনির্বাপণ ও জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বিভিন্ন শাখায় এই প্রশিক্ষণ প্রতি সপ্তাহেই হয়ে থাকে এবং প্রতিদিন অগ্নিনিরাপত্তা সচেতনতা কার্যক্রম চালানো হয়। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে এক দিনের জন্যও পণ্য খালাস বন্ধ হয়নি।
তালিকা থেকে অক্ষত পণ্য খুঁজছেন আমদানিকারকরা: কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডের পরও যে মালপত্র অক্ষত ছিল, তাদের তালিকা প্রকাশ করেছে কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্বে থাকা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। গতকাল বিমানবন্দরের ৮ নম্বর গেটের পাশের দেয়ালে প্রায় ৫০০টি অক্ষত মালপত্রের তালিকা টানিয়ে দেয় সংস্থাটি। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা এখন সে তালিকা ধরে নিজেদের পণ্য খুঁজে ফিরছেন। তবে টানানো তালিকা শুধু বিজিএমইএ সংশ্লিষ্ট গার্মেন্টস সামগ্রী।
গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রকাশিত তালিকায় মূলত বিজিএমইএ সংশ্লিষ্ট পণ্যের নাম রয়েছে। অগ্নিকাণ্ডে তাদের বেশিরভাগ মালপত্র অক্ষত আছে। পাঁচ শতাধিক মালপত্রের বিস্তারিত তথ্য তালিকায় উল্লেখ করা হয়েছে।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং বিভাগের কর্মী খন্দকার নাহিদ হোসেন জানান, অগ্নিকাণ্ডের সময় বিজিএমইএর মালপত্রগুলো ছিল অ্যাপ্রোন এলাকায়। সেগুলোর ক্ষতি খুব একটা হয়নি। মালিকরা ব্যাংকে নির্দিষ্ট ফি জমা দিয়ে এনবিআরের মাধ্যমে মালপত্র নিতে পারবেন। এরই মধ্যে কিছু পণ্য হস্তান্তর শুরু হয়েছে।
মন্তব্য করুন