

নানান সমীকরণ এবং হিসাব-নিকাশ শেষে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করারই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাবেক দুই ছাত্র উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। দুজনই মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করলেও শেষ দিন গতকাল সোমবার তা জমা দেননি।
জানা গেছে, তাদের দুজনের কারোরই কাঙ্ক্ষিত আসনে জামায়াতে ইসলামী নেতৃত্বাধীন ১১ দলের নির্বাচনী জোট থেকে ছাড় দেওয়ার সম্মতি জানানো হয়নি। মনোনয়নপত্র দাখিলের একদম শেষ সময়ে এসে জাতীয় নাগরিক পার্টিতে (এনসিপি) যোগ দিয়েছেন আসিফ মাহমুদ। তিনি দলটির মুখপাত্র ও নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধানের দায়িত্ব পেয়েছেন। নির্বাচন না করলেও দুই সাবেক উপদেষ্টা সংসদের উচ্চকক্ষের আলোচনায় ভালোভাবে আছেন বলে জানিয়েছে এনসিপি সূত্র।
মাহফুজ আলম লক্ষ্মীপুর-১ আসনে নির্বাচন করতে চান বলে বিভিন্ন সময় চাউর হয়েছিল। তার ঘনিষ্ঠজনরাও এমনটিই জানিয়েছিলেন। মাহফুজের পক্ষে এই আসনে মনোনয়নপত্রও তোলা হয়েছিল। তবে শেষ মুহূর্তে নির্বাচন থেকে সরে এলেন আলোচিত এই সাবেক উপদেষ্টা। গুঞ্জন আছে এই আসনে জামায়াত নেতৃত্বাধীন জোটের প্রার্থী হচ্ছেন মাহফুজ আলমেরই ভাই মাহবুব আলম।
তবে এটি এখনো চূড়ান্ত নয়। অন্যদিকে ঢাকা-১০ আসন ও কুমিল্লা-৩ আসনের মনোনয়নপত্র নিয়েছিলেন আসিফ মাহমুদ। এ ছাড়া ঢাকা-১২ আসনে গণঅধিকার তাকে মনোনয়ন দিয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত সমীকরণ না মেলায় তিনিও নির্বাচনে না গিয়ে এনসিপিতে যোগ দেন।
দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, জামায়াত যেন আসিফকে ঢাকা-১০ আসন ছেড়ে দেয়; এ জন্য রোববার রাত পর্যন্ত চেষ্টা চালায় এনসিপি। তবে জামায়াতের পক্ষ থেকে সাড়া দেওয়া হয়নি। তাদের ভাষ্য, সাবেক উপদেষ্টাদের প্রার্থী করলে সরকারের মদদপুষ্ট হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পাশপাশি সরকারি শক্তির বিরোধিতার মুখে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে, যা নির্বাচনে তাদের ক্ষতি করবে।
এ ছাড়া দুই সাবেক উপদেষ্টা বিএনপির প্রার্থী হতে পারেন; এমন গুঞ্জনও ছিল। আসিফ ঢাকা-১০ বা কুমিল্লা-৩ থেকে মনোনয়ন পেতে চেয়েছিলেন বলে জানা যায়। তবে বিএনপি সূত্র জানায়, তারাও শেষ পর্যন্ত মাহফুজ-আসিফকে প্রার্থী করতে রাজি হয়নি। এ ছাড়া মনোনয়নপত্র জমার শেষ দিন গণঅধিকার পরিষদের পক্ষ থেকে মনোনয়ন নিয়েছিলেন আসিফ মাহমুদ। শেষ মুহূর্তে সেটি আর জমা দেননি। বরং নির্বাচনই না করার সিদ্ধান্ত নেন।
আগামী সংসদ হবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট। উচ্চকক্ষে সদস্যসংখ্যা হবে ১০০ জন এবং তারা নির্বাচিত হবেন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে (পিআর পদ্ধতি)—এ বিষয়টি নির্ধারিত হবে গণভোটে। কোনো রাজনৈতিক দল ন্যূনতম এক শতাংশ ভোট পেলেই উচ্চকক্ষে আসন পাবে। অর্থাৎ এক শতাংশ ভোট পেলেই উচ্চকক্ষের একশটি আসনের মধ্যে একটি আসন পাবে ওই রাজনৈতিক দল। এক্ষেত্রে, ওই দলটি নিম্নকক্ষে কোনো আসন যদি জিততে ব্যর্থও হয়, তা উচ্চকক্ষে কোনো বাধা তৈরি করবে না।
গণভোটের চারটি প্রশ্নের মধ্যে একটি উচ্চকক্ষ-সংক্রান্ত। প্রশ্নটি হবে সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ সদস্যবিশিষ্ট উচ্চকক্ষ গঠিত হবে এবং সংবিধান সংশোধন করতে হলে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন দরকার হবে। এ বিষয়ে হ্যাঁ/না ভোট দেবেন নাগরিকরা।
এনসিপির নেতারা বলছেন, জোটের আলোচনাসহ বিভিন্ন সমীকরণে শেষ পর্যন্ত তারা নির্বাচন করছেন না। মাহফুজ আলম দলে এখনই আসছেন না, তবে আসিফ মাহমুদ দায়িত্ব নিতে রাজী হয়েছেন। দুজনই উচ্চকক্ষের আসন পাওয়ার আলোচনায় ভালোভাবে রয়েছেন।
জাতীয় নাগরিক পার্টিতে যোগ দিয়ে দলের মুখপাত্রের দায়িত্ব নিয়েছেন আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। পাশাপাশি তাকে দলের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান করা হয়েছে। গতকাল রাজধানীর বাংলামটরে এনসিপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এই ঘোষণা দেন দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।
আসিফ মাহমুদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছেন না জানিয়ে নাহিদ বলেন, ‘এই সংগ্রামী সময়ে এনসিপিকে ধরে রাখার জন্য আসিফ মাহমুদ এবার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছেন না। বরং এনসিপির মনোনীত প্রার্থীরা যাতে নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসতে পারেন এবং তিনি সংসদে গিয়ে গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে বাংলাদেশের মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতে পারেন, সেজন্য তিনি কাজ করবেন। এজন্য তাকে এনসিপির নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।’
নাহিদ আরও বলেন, ‘এনসিপির রাজনৈতিক পর্ষদের জরুরি সভার সিদ্ধান্ত ও গঠনতন্ত্র মোতাবেক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াকে দলের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।’
দায়িত্ব গ্রহণের পর আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘আমি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছি না। আমাদের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সহযোদ্ধাদের সংসদে যেতে যদি অবদান রাখতে পারি, তাহলে এর থেকে বড় সাফল্য আর হতে পারে না। আমরা প্রত্যাশা করি, কোনো ধরনের হানাহানি ছাড়াই এই গণতান্ত্রিক উত্তরণকে বাংলাদেশ অতিক্রম করতে পারবে। আমরা সবাই মিলে গণভোটে হ্যাঁ-এর পক্ষে জোয়ার তুলব। হ্যাঁ ভোট যদি জয়যুক্ত হয় তাহলে দেশ আরও একশ বছর এগিয়ে যাবে বলে আমি মনে করি।’
অন্যদিকে নির্বাচনের বিষয়ে মাহফুজ আলম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি তো শুরু থেকেই বলে আসছি যে, নির্বাচন করব না। এই কারণে আমি সরকার থেকে সরে যেতে চাইনি; কিন্তু সরকার মনে করেছে, ছাত্র প্রতিনিধিরা থাকলে নিরপেক্ষতা নিয়ে নির্বাচনের সময় প্রশ্ন উঠতে পারে। সে কারণে আমি সরে গেছি; কিন্তু নির্বাচন করব না, সেটা আমার আগে থেকেই সিদ্ধান্ত ছিল।’
এর আগে এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে এনসিপির অংশ না হওয়ার কথা জানিয়ে সাবেক এই উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাকে জামায়াত-এনসিপি জোট থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়নি, এটা সত্য নয়; কিন্তু ঢাকার কোনো একটা আসনে জামায়াত-এনসিপি জোটের প্রার্থী হওয়ার চেয়ে আমার লং স্টান্ডিং পজিশন ধরে রাখা অধিক গুরুত্বপূর্ণ।’
মন্তব্য করুন