তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে দেওয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ সংবিধানের পঞ্চম তপশিলে অসম্পূর্ণ ও ভুলভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সংবিধানে সন্নিবেশিত ওই ভাষণের শতাধিক স্থানে ভুল খুঁজে পেয়েছে হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি। এসব ভুল চিহ্নিত করে একটি প্রতিবেদন হাইকোর্টে দাখিলও করা হয়েছে। কিন্তু ওই ভুল আর সংশোধন করা হয়নি। আবার এ-সংক্রান্ত রিট আবেদনটিরও চূড়ান্ত শুনানি হয়নি। ফলে এখনো জাতির পিতার ভাষণ ভুলভাবে রয়েছে দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানে।
জানতে চাইলে রিটের পক্ষের আইনজীবী সুবীর নন্দী দাস কালবেলাকে বলেন, ‘সংবিধানে সন্নিবেশিত ভাষণের শতাধিক স্থানে ভুল রয়েছে বলে প্রতিবেদন দেয় তদন্ত কমিটি। কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পর আর শুনানি হয়নি। সংবিধানের ভুলও সংশোধন হয়নি। এখন মূল মামলাটি শুনানির জন্য আছে। মাঝে মাঝেই মামলাটি চূড়ান্ত শুনানির জন্য আদালতের কার্য তালিকায় আসে। এটা দ্রুত শুনানি হওয়া উচিত।’ তবে এ ব্যাপারে চেষ্টা করেও আইনমন্ত্রীসহ সরকারের সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণের হুবহু সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি—বিষয়টি লক্ষ করে ২০২০ সালের ৬ মার্চ রাজবাড়ীর রায়নগর গ্রামের কাশেদ আলীর পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সুবীর নন্দী দাস একটি রিট করেন। ওই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০২০ সালের ১০ মার্চ সংবিধানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ভুলভাবে সন্নিবেশিত হয়েছে কি না, তা যাচাই করতে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। ৭ মার্চের ভাষণের সময় উপস্থিত থাকা ব্যক্তিসহ বিশিষ্টজনের এ কমিটিতে রাখতে বলা হয়েছিল। এ ছাড়া সংবিধানের পঞ্চম তপশিলে থাকা ভাষণের সঙ্গে এ-সংক্রান্ত সব অডিও-ভিডিও পর্যালোচনা করে একটি প্রতিবেদনও আদালতে দাখিল করতে বলা হয়। পাশাপাশি সংবিধানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সঠিকভাবে (হুবহু) কেন অন্তর্ভুক্ত করা হবে না, তা জানতে চেয়ে চার সপ্তাহের রুল জারি করেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের বিচারপতি তারিক উল হাকিম ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ রুলসহ ওই আদেশ দেন।
পরে ওই আদেশ অনুযায়ী বাংলা একাডেমির সাবেক চেয়ারম্যান প্রয়াত অধ্যাপক শামসুজ্জামান খানকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক সাংবাদিক জাফর ওয়াজেদকে কমিটির সদস্য সচিব করা হয়। ওই কমিটিই ৭ মার্চের ভাষণের বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সংবিধানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের অনেক বাক্য কিংবা শব্দচয়ন যেমন অন্তর্ভুক্ত হয়নি, তেমনি কিছু এসেছে ভুলভাবে। বঙ্গবন্ধু তার ৭ মার্চের ভাষণে ‘ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর’ বলেছিলেন। কিন্তু কমিটি বলছে, সংবিধানে ‘খুলনা’ শব্দটি অন্তর্ভুক্ত হয়নি। পঞ্চম লাইনে ‘তার ন্যায্য অধিকার চায়’ এর স্থলে ‘তার অধিকার চায়’ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সংবিধানে ‘নির্বাচনের পর বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে ও আওয়ামী লীগকে ভোট দেন’—এটা রয়েছে। কিন্তু মূল ভাষণে রয়েছে, ‘আপনারা নির্বাচনে গিয়ে নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে ও আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমরা ভোট পাই।’
মূল ভাষণে, ‘তারপরে পশ্চিম পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামীর নেতা নুরানি সাহেবের সঙ্গে আলাপ হলো, মুফতি মাহমুদ সাহেবের সঙ্গে আলাপ হলো’ থাকলেও সংবিধানে এগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
মূল ভাষণে রয়েছে, ‘ভাইয়েরা আমার, যেভাবে আপনাদের, আপনারা ঠান্ডা হবেন না, ঠান্ডা হয়ে গেলে জালেমরা অন্য কোথাও আক্রমণ করবে, আপনারা হুঁশিয়ার থাকবেন এবং প্রস্তুত থাকবেন। প্রসেশন চলবে কিন্তু মনে রাখবেন ডিসিপ্লিন সোলজার ছাড়া, ডিসিপ্লিন ছাড়া কোনো জাতি জিততে পারে না। আপনারা আমার ওপর বিশ্বাস নিশ্চয় রাখেন, জীবনে আমার রক্তের বিনিময়েও আপনাদের সঙ্গে বেইমানি করি নাই। প্রধানমন্ত্রিত্ব দিয়ে আমাকে নিতে পারে নাই। ফাঁসিকাষ্ঠে আসামি দিয়েও আমাকে নিতে পারে নাই। যে রক্ত দিয়ে আপনারা আমায় একদিন জেল থেকে বাইর কোরে নিয়ে এসেছিলেন, এই রেসকোর্স ময়দানে আমি বলেছিলাম আমার রক্ত দিয়ে আমি রক্তের ঋণ শোধ করবো। মনে আছে? আমি রক্ত দেবার জন্য প্রস্তুত। আমাদের মিটিং এখানেই শেষ। আসসালামু আলাইকুম।’ কিন্তু এই লাইনগুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
এ ছাড়া মূল ভাষণে রয়েছে ‘রিকশা, ঘোড়াগাড়ি চলবে, রেল চলবে।’ অথচ সংবিধানে দেওয়া হয়েছে, ‘রিকশা, গরুর গাড়ি, রেল চলবে।’ এ ছাড়া ভাষণে বলা হয়েছে, ‘জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর’, কিন্তু সংবিধানের তফশিলে লেখা হয়েছে’ জনগণের প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর।’ ভাষণে বলা হয়েছে, ‘শোনেন, মনে রাখবেন শত্রু বাহিনী ঢুকেছে।’ অথচ সংবিধানে লেখা হয়েছে ‘শুনুন, মনে রাখবেন শত্রু বাহিনী ঢুকেছে। মূল ভাষণে ছিল ‘আমরা বললাম’, অথচ লেখা হয়েছে, ‘আমি বললাম’। ‘জনাব ভুট্টো সাহেবের’ জায়গায় লেখা হয়েছে’ ‘ভুট্টো সাহেব’। মূল ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘জনগণ আমাকে ভোট দিয়েছে ছয় দফা, এগারো দফার মাধ্যমে শাসনতন্ত্র করতে, এটার পরিবর্তন-পরিবর্ধন করার ক্ষমতা আমার নাই। আপনারা আসুন, বসুন।’ সংবিধানে এ শব্দচয়ন অন্তর্ভুক্ত হয়নি বলে কমিটি মনে করে। মূল ভাষণে বঙ্গবন্ধু জনগণের উদ্দেশে বলেছেন, ‘হরতাল পালন করেন।’ কিন্তু সংবিধানে তা এসেছে, ‘হরতাল পালন করুন।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ৭ মার্চের মূল ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, প্রত্যেক ইউনিয়নে, প্রত্যেক সাব-ডিভিশনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো।’ কিন্তু সংবিধানে লেখা হয়েছে, ‘প্রত্যেক গ্রাম, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো।’ এ ছাড়া অনেক জায়গায় বক্তব্য অন্তর্ভুক্তই করা হয়নি।