পশ্চিম ধানমন্ডির বাসিন্দা সোনিয়া। প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে এসেছেন ধানমন্ডির ল্যাবএইড হাসপাতালে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, চিকিৎসকদের আন্দোলনের কারণে প্রাইভেট চেম্বার বন্ধ। তবে জরুরি সেবা চালু রয়েছে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সোনিয়ার ভাই রকিব কালবেলাকে বলেন, রোগীদের জিম্মি করে চিকিৎসকদের কীসের আন্দোলন। চিকিৎসার মতো জরুরি সেবা বন্ধ করা ছাড়াও দাবি আদায় করা যায়। চিকিৎসকদের এসব আচরণে সাধারণ মানুষের আস্থা নষ্ট হবে। একই চিত্র আলোচিত সেন্ট্রাল হসপিটালেও। চিকিৎসকদের আন্দোলনের কারণে সেখানেও সব ধরনের প্রাইভেট চেম্বার ও অপারেশন বন্ধ রয়েছে। অবস্ট্রাকট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী গতকাল সোমবার প্রাইভেট চেম্বার ও অপারেশন থিয়েটার বন্ধ রাখেন চিকিৎসকরা। সেন্ট্রাল হসপিটালে আঁখি ও তার নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনায় ডা. শাহজাদী ও ডা. মুনা সাহাকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে আজ মঙ্গলবারও এ কর্মসূচি চলবে। গতকাল সরেজমিন রাজধানীর চানখাঁরপুল, মিটফোর্ড, ধানমন্ডি, মহাখালী, যাত্রাবাড়ী ও খিলগাঁও এলাকার বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ হাসপাতাল এবং ক্লিনিকে প্রাইভেট চেম্বার ও অপারেশন বন্ধ রয়েছে। শুধু রাজধানী নয়, দেশের প্রতিটি জেলায় চিকিৎসকদের প্রাইভেট চেম্বার ও অপারেশন থিয়েটার বন্ধ রয়েছে। রাজশাহীতে কোনো প্রাইভেট চেম্বারে চিকিৎসাসেবা দেননি চিকিৎসকরা। রাজশাহী পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চিকিৎসা নিতে আসা কয়েকজন রোগীর অভিভাবক জানান, আমরা ফোনে সিরিয়াল দিয়ে চিকিৎসার জন্য এসেছিলাম। কিন্তু এসে দেখি সব ডাক্তারেরই চেম্বার বন্ধ। সিরিয়াল নেওয়ার আগে রোগীদের জানিয়ে দিলেই আর এরকম হয়রানিতে পড়তে হতো না। পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রাজশাহী শাখার সিনিয়র অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার হোসেন আলী বলেন, চেম্বার না করার সিদ্ধান্ত চিকিৎসকদের। এখানে আমাদের করার কিছু নেই। একই কথা বলেছেন ল্যাবএইডের রাজশাহী শাখার ম্যানেজার রেজাউল করিম। তিনি জানান, জরুরি অপারেশনও বন্ধ রয়েছে। সোসাইটি অব সার্জন অব বাংলাদেশ রাজশাহী শাখার সাধারণ সম্পাদক ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. নওশাদ আলী বলেন, পেশাদার চিকিৎসকদের সাতটি সোসাইটি আছে। সবাই মিলেই প্রাইভেট প্র্যাক্টিস বন্ধ রেখেছি। কারণ এভাবে চিকিৎসকদের জেলে ঢুকিয়ে রাখা অন্যায়। কোনো ডাক্তারই রোগী মারতে চান না। বাঁচানোর চেষ্টা করেন। কাজেই এ ধরনের নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদ। আমরা কর্মস্থলে নিরাপদ পরিবেশ চাই। সিলেটের ডাক্তারপাড়া খ্যাত রিকাবীবাজারের স্টেডিয়াম মার্কেটে চিকিৎসকদের সব প্রাইভেট চেম্বার বন্ধ ছিল। ওজিএসবি সিলেট শাখার সদস্য ডা. সুরাইয়া আফরোজ জানান, কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দেশনা পেয়ে আমরা এই প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করছি। আমাদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে অন্য চিকিৎসকরাও প্রাইভেট চেম্বার বন্ধ রেখেছেন। ওজিএসবি বগুড়া শাখার সাধারণ সম্পাদক ডা. আক্তারী হোসেন চৌধুরী নিপা বলেন, কেন্দ্রীয় কর্মসূচির সঙ্গে বগুড়ার সব চিকিৎসক একাত্মতা ঘোষণা করে চিকিৎসাসেবা বন্ধ রেখেছেন। আমরা অনেক সময় মুমূর্ষু রোগীকে নিয়ে কাজ করি। অনেক সময় সংকট হয়। আমরা চেষ্টা করি রোগী বাঁচানোর। আমরা তো জীবন দিতে পারি না। গ্রেপ্তারের ভয় নিয়ে কীভাবে রোগী দেখব। বিনা তদন্তে গ্রেপ্তার বন্ধ করা হোক। বগুড়া জেলার সিভিল সার্জন ডা. শফিউল আজম বলেন, চিকিৎসকরা বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে থাকেন। এ নিয়ে আমাদের কোনো করণীয় নেই। তবে সরকারি হাসপাতালগুলো সাধারণ মানুষের সেবা দিতে প্রস্তুত আছে। এদিকে, চিকিৎসকদের এমন আন্দোলনে বিব্রত বেসরকারি হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরাও। রাজধানীর একটি প্রথম সারির হাসপাতালের পরিচালক কালবেলাকে বলেন, আন্দোলন ও দাবি আদায়ের অনেক পন্থা রয়েছে। চিকিৎসকদের এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত মোটেও ইতিবাচক নয়। তবে আমাদের কিছুই করার নেই। সরকার চাইলে চিকিৎসকদের চেম্বারে ফেরাতে পারবে। ওজিএসবির সারা দেশে প্রাইভেট চেম্বার ও প্রাইভেট অপারেশন বন্ধের কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে চিকিৎসকদের বেশ কয়েকটি সংগঠন। তবে এ কর্মসূচির সঙ্গে সমর্থন থাকলেও প্রাইভেট চেম্বার ও অপারেশন থিয়েটার বন্ধ রাখার সঙ্গে একমত নয় দেশের চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ)। গত রোববার বিএমএ মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক দুলাল বলেন, চিকিৎসকদের কর্মবিরতির ঘোষণায় একটি বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে। আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, এসব কর্মসূচি বিএমএর নয়। কর্মসূচি গ্রহণের ক্ষেত্রে বিএমএর কিছু নিয়মনীতি রয়েছে, তা মেনে করতে হয়। আমাদের পুরো কার্যকরী কমিটি বসে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে কর্মসূচি নির্ধারণ করে। বিএমএ কখনো কোনো হঠকারী কর্মসূচি বা সিদ্ধান্ত নেয়নি, ভবিষ্যতেও নেবে না। যারা হঠকারী সিদ্ধান্ত নেবে তারা তাদের দায়িত্ব পালন করবে। বিএমএ কার্যালয়ে সিদ্ধান্ত জানানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অবস্ট্রাকট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি), সোসাইটি অব মেডিসিনসহ অন্য সোসাইটিগুলো আমাদের কার্যালয়ে বৈঠক করে তাদের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যে কোনো চিকিৎসক ও সোসাইটি আমাদের কার্যালয়ে আসতে পারেন। তারা সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ যে কারও সঙ্গে কথা বলতে পারেন। ওইদিন আমাদের সঙ্গে তাদের মতবিনিময় হয়েছে। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনে মতবিনিময়ের পর তারা কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। তবে স্পষ্টভাবে বলছি, বিএমএ এমন সিদ্ধান্ত নেয়নি, ভবিষ্যতেও নেবে না। এটা সোসাইটিগুলোর কর্মসূচি। শুধু অভিযোগে ভিত্তিতে চিকিৎসকদের গ্রেপ্তার না করার আহ্বান : এদিকে গতকাল সোমবার রাতে ভার্চুয়াল এক সংবাদ সম্মেলনে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ উঠলেই তদন্ত ছাড়া চিকিৎসকদের গ্রেপ্তার না করার আহ্বান জানিয়েছে ফেডারেশন অব অল সোসাইটি বাংলাদেশ। একই সঙ্গে সেন্ট্রাল হসপিটালের ঘটনায় গ্রেপ্তার দুই চিকিৎসককে অনতিবিলম্বে জামিন দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। এ সময় লিখিত বক্তব্য দেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ও সোসাইটি অব মেডিসিনের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির। এ সময় ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও সোসাইটি অব সার্জনসের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম ও স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও সোসাইটি অব মেডিসিনের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. মো. টিটু মিঞা। লিখিত বক্তব্যে আহমেদুল কবির বলেন, যে কোনো সভ্য দেশে চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট কারণে রোগীর মৃত্যু হলে অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে চিকিৎসক, রোগীর নিকট আত্মীয় ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে একটি রিপোর্ট তৈরি করা হয়। সেই রিপোর্ট যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়। সেখানে শুধু অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত ব্যতিরেকে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয় না। তদন্ত ছাড়া চিকিৎসককে পুলিশ কতৃর্ক হয়রানি বা গ্রেপ্তার হলে মুমূর্ষু রোগীকে চিকিৎসা দিতে চিকিৎসকরা সাহস হারিয়ে ফেলবেন। এতে করে সামগ্রিক চিকিৎসাব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান মিলন কালবেলাকে বলেন, কোনো চিকিৎসক রোগীকে হত্যা করেন না। এভাবে হত্যার অভিযোগ দায়ের করে চিকিৎসকদের জেলে পাঠালে চিকিৎসক তো ইমার্জেন্সি রোগী সামলাতে এগিয়ে আসবেন না। সেন্ট্রাল হসপিটালে সেদিন ডা. সংযুক্তা সাহার অনুপস্থিতিতে ডা. মিলি, মুনা ও শাহজাদী এগিয়ে গিয়েছিলেন রোগীকে বাঁচাতে। এখন তারাই বিপদে পড়ে গেছেন। তবে প্রাইভেট চেম্বার ও অপারেশন থিয়েটার বন্ধ রেখে আন্দোলন করা একটি কঠিন পদক্ষেপ হয়ে যায়। চিকিৎসকরা কী করবে? আমরা তো অসহায় হয়ে গেছি। আর কোনো উপায় ছিল না। তিনি বলেন, রোগী ও চিকিৎসকদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি ও উভয়ের সুরক্ষায় স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইন দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি। নয়তো চিকিৎসকদের নিরাপত্তা বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে সেবা বন্ধ থাকলেও সরকারি হাসপাতালগুলো সচল আছে। সেগুলোতে কোনো সমস্যা নেই। রোগীদের কথা চিন্তা করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেই তো উদ্যোগী হওয়া উচিত। আমরা তো বসে নেই। ভেতরে আমরা কাজ করছি। সময়টুকু আমাদের দিতে হবে। আমি মনে করি তাদের এখান থেকে দ্রুত ফেরা উচিত। এটা তো মানবিক না। একজন চিকিৎসককে মানবিক হতে হবে। প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন রাজশাহী ব্যুরোর শফিকুল ইসলাম, সিলেট ব্যুরোর লিয়াকত শাহ ফরিদী, বগুড়া ব্যুরোর প্রদীপ মোহন্ত, রাঙামাটির মো. আনোয়ার হোসেন এবং অনলাইন প্রতিবেদক তৌহিদুল ইসলাম তারেক।
মন্তব্য করুন