দ্বিতীয় ধাপের উপজেলা নির্বাচনেও দ্বন্দ্ব-কোন্দলে জর্জরিত আওয়ামী লীগের তৃণমূল। প্রায় প্রতিটি উপজেলায় প্রার্থীদের ঘিরে দল ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্য তৈরি হয়েছে চরম বিভক্তি। বিভিন্ন উপজেলায় প্রার্থীদের মধ্যে চলছে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ, কাদা ছোড়াছুড়ি। এর জেরে প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও হচ্ছে সংঘাত। দলীয় সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের স্বজনরা প্রার্থী হওয়ায় অনেক এলাকায় পরিস্থিতি নাজুক হয়ে উঠেছে। এলাকায় প্রভাব বিস্তার ও নেতৃত্ব ধরে রাখতে দলের স্থানীয় নেতারাও স্বজন কিংবা ঘনিষ্ঠ প্রার্থীর পক্ষ নিচ্ছেন প্রকাশ্যে ও গোপনে। সঙ্গে যোগ হয়েছে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীর মধ্যকার পুরোনো বিরোধ।
জানা গেছে, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন ও ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী দেওয়া থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। গত জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে দলের বিভেদ উপজেলা নির্বাচনে আরও বেড়ে যায়। সঙ্গে মন্ত্রী ও স্থানীয় এমপির স্বজন এবং নিকটাত্মীয়দের নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন দলটির সাংগঠনিক শাস্তি না দেওয়ার উদাসীনতা উসকে দিয়েছে কোন্দল। এমনকি নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাবে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন প্রার্থীরা। তাদের ঠেকিয়ে জয় নিশ্চিত করতে সবটুকু উজাড় করে দিচ্ছেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরাও।
প্রতিটি সংসদীয় এলাকার রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু উপজেলা। ফলে নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে উপজেলা পরিষদ দখলে মরিয়া হয়ে উঠেছেন বর্তমান ও সাবেক সংসদ সদস্যরা। বিগত নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়েও যারা পরাজিত হয়েছেন, এই লড়াইয়ে শামিল হয়েছেন তারাও। কোথাও দ্বিমুখী, কোথাও ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব-কোন্দলে উপজেলা নির্বাচন জমে উঠলেও জনমনে ভর করেছে সংঘাতের আশঙ্কা।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক কালবেলাকে বলেন, ‘কেউ যদি পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করে, সেজন্য সেই ব্যক্তি এমপি-মন্ত্রী যেই হোন, তিনিই দায়ী থাকবেন। দল নির্বাচনের সার্বিক বিষয় পর্যবেক্ষণ করছে। এ ব্যাপারে দল খুব কঠোর। দলীয় শৃঙ্খলার ব্যত্যয় ঘটলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এদিকে প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনের ভোটের আগ মুহূর্তে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ নেই জানিয়ে সাংগঠনিক নির্দেশনা দেন। তিনি জানান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ নির্বাচন পরিচালনার কাজে নিয়োজিত প্রশাসনও নিরপেক্ষতা বজায় রাখবে। কেউ কোনো ধরনের অবৈধ হস্তক্ষেপ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
কিন্তু দলীয় নির্দেশনা উপেক্ষা করে প্রথম ধাপে মন্ত্রী-এমপির স্বজনরা নির্বাচনে অনড় থাকেন। কোথাও কোথাও নিজ প্রার্থীর জয় নিশ্চিত করতে দলীয় সংসদ সদস্যদের প্রভাব বিস্তার করতেও দেখা গেছে। দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনেও বিভিন্ন এলাকায় একই পরিস্থিতি দেখা যেতে পারে বলে শঙ্কা তৃণমূল আওয়ামী লীগের।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, আগামী ২১ মে দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে সারা দেশে ১৬১ উপজেলা পরিষদে ইভিএম ও ব্যালট পেপারে ভোট অনুষ্ঠিত হবে। এরই মধ্য ৭ জন চেয়ারম্যানসহ ২১ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলা নির্বাচন কেন্দ্র করে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ ও আদিতমারী উপজেলায় আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্ব এখন চরমে। কালীগঞ্জ উপজেলায় ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের আপন ছোট ভাই জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মাহবুবুজ্জামান আহমেদ ও ছেলে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রাকিবুজ্জামান আহমেদ। গত সংসদ নির্বাচনের সময়ই এই পরিবারের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে। এখন উপজেলা নির্বাচন ঘিরে চাচা-ভাতিজার মধ্য চলছে বাগযুদ্ধ, পাল্টাপাল্টি অভিযোগ, কুৎসা রটানো, একের বিরুদ্ধে অন্যের সংবাদ সম্মেলন। এই উপজেলায় নেতাকর্মীরা দুভাগে বিভক্ত। উত্তেজনা বিরাজ করছে, যে কোনো সময় সংঘর্ষে রূপ নিতে পারে। সংসদ সদস্য নুরুজ্জামানের সঙ্গে বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান মাহবুবুজ্জামানের দ্বন্দ্ব প্রভাব পড়েছে ভোটের পরিবেশেও।
একই অবস্থা পাশের উপজেলা আদিতমারীতেও। সেখানেও সাবেক মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল আলমের সঙ্গে দা-কুমড়া সম্পর্ক বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ইমরুল কায়েস ফারুকের। এই বিভক্তি ঘিরে সংঘাতের আশঙ্কা করেছেন ভোটাররা।
অন্যদিকে চুয়াডাঙ্গায় সদর উপজেলা নির্বাচনে স্থানীয় সংসদ সদস্য সোলায়মান হক জোয়ার্দার সেলুনের ভাতিজা ও জেলা যুবলীগের সভাপতি নঈম হাসান জোয়ার্দার প্রার্থী হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে নির্বাচন করছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আসাদুল হক বিশ্বাস ও জেলা কৃষক লীগের সাবেক সভাপতি আজিজুল হক। এই উপজেলায় প্রায়ই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্য সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে।
নাটোরের লালপুর উপজেলায় আওয়ামী লীগে চলছে চতুর্মুখী দ্বন্দ্ব। স্থানীয় সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদের ঘনিষ্ঠ ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আফতাব আহমেদ ঝুলফু, সাবেক সংসদ সদস্য শহীদুল ইসলাম বকুলের ঘনিষ্ঠ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আমিনুল ইসলাম জয়, সাবেক সংসদ সদস্য মমতাজ উদ্দিন আহমেদের ছেলে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমেদ সাগর ও বর্তমান চেয়ারম্যান এবং বকুলের ভগ্নিপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক আলীকে ঘিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। প্রায়ই প্রার্থী ও সমর্থকদের মধ্য চলছে উত্তেজনা।
অন্যদিকে বাগাতিপাড়া উপজেলায়ও বর্তমান এমপির প্রার্থী শহীদুল বকুলের বড় ভাই শরীফুল ইসলাম শরীফ ও জেলা আওয়ামী লীগের তৃতীয় গ্রুপের প্রার্থী অধ্যক্ষ আবুল হোসেনের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিভক্ত উপজেলা আওয়ামী লীগ। চলছে প্রার্থীদের চরিত্র হনন ও বিষোদ্গার। আশঙ্কা রয়েছে সংঘাতের।
তবে সব আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘কোথাও কোনো ব্যত্যয় ঘটলে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে—দলের পক্ষ থেকে এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন তো রয়েছেই। স্বাধীন নির্বাচন কমিশন তার ভূমিকা পালন করবে—যেন একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোট হয়।’
এদিকে উপজেলা নির্বাচন কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে কোথাও কোথাও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে গতকাল শনিবার হামলা ও গাড়ি ভাঙচুরের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে কয়েকজন আহত হন। চেয়ারম্যান প্রার্থী জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য রণজিৎ চৌধুরী ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার বর্মণের সমর্থকদের মধ্যে ওই ঘটনা ঘটে।
একই দিন মানিকগঞ্জের শিবালয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আব্দুর রহিম খান এবং শিবালয় উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রেজাউর রহমান খান জানু সমর্থকদের মধ্যে পোস্টার লাগানো ঘিরে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। নির্বাচন ঘিরে ককটেল বিস্ফোরণ, মারধর ও গুলির ঘটনা ঘটে।
এর আগে গত শুক্রবার নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থী শিকদার আব্দুল হান্নান রুনুর সমর্থকদের সঙ্গে অপর প্রার্থী এ কে এম ফয়জুল হক রোমের সমর্থকরা ভোট চাওয়াকে কেন্দ্র করে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। সংঘর্ষে ৫ জন আহতসহ একটি মোটরসাইকেল ও দুটি দোকান ভাঙচুর করা হয়।