মো. মাজহারুল পারভেজ
প্রকাশ : ১২ জুন ২০২৪, ০৩:২০ এএম
আপডেট : ১৪ জুন ২০২৪, ০৪:৫৬ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ভাইয়া গ্রুপের প্লট-প্রতারণা

অন্যের জমি দেখানো হয় নিজেদের
ভাইয়া গ্রুপের প্লট-প্রতারণা
ভাইয়া গ্রুপের প্লট-প্রতারণা

জমি ভাড়ায় নিয়ে বসানো হয় রংবেরঙের সাইনবোর্ড। তাতে লেখা থাকে আকর্ষণীয় নানা নাম। এরপর সেসব জমির ছবিসহ প্রচারপত্র (ব্রুশিয়ার) তৈরি করে চালানো হয় প্রচার। আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপনে মুগ্ধ হয়ে ফাঁদে পা দেন সাধারণ মানুষ। সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে প্লট কেনেন তারা; কিন্তু কিছুদিন পর দেখা যায়, সাইনবোর্ড পরিবর্তন করে বদলে ফেলা হয়েছে প্রকল্পের নাম। নতুন করে বিক্রি করা হচ্ছে জমি। এত কিছুর মধ্যে আবার জমির প্রকৃত মালিক কিছুই জানেন না। তিনি যতক্ষণে টের পান, তার আগেই স্থান পরিবর্তন করে অন্যত্র চলে যান তথাকথিত হাউজিং প্রকল্পের উদ্যোক্তারা। এভাবেই নামসর্বস্ব আবাসন কোম্পানির নামে দীর্ঘদিন ধরে ভয়ংকর প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে ‘ভাইয়া গ্রুপ’।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জমি না কিনেই প্রায় ৩ হাজার ২০০ প্লট বিক্রি করে দিয়েছে ভাইয়া গ্রুপ। পাইন সিটি (পূর্বাচল), টিউলিপ ভ্যালি (পূর্বাচল), বীরতারা সিটিসহ (কেরানীগঞ্জ) বিভিন্ন প্রকল্পের নামে অন্যের জমি নিজের দেখিয়ে বিক্রি করছেন তারা। এরই মধ্যে পাইন সিটিতে ১ হাজার ৭০০ ও টিউলিপে প্রায় দেড় হাজার প্লট বিক্রি করা হয়েছে; কিছু প্লট বিক্রি করার পরই প্রজেক্টের নাম পরিবর্তন করা হয়। একই প্রজেক্টের হয়ে যায় একাধিক নাম। কোম্পানির নাম পরিবর্তন করে গ্রাহকদের সঙ্গে এমন প্রতারণা করছে ভাইয়া গ্রুপ।

জানা গেছে, মূলত সাইনবোর্ডসর্বস্ব এই প্রকল্পে বিক্রি করার মতো নিজস্ব সম্পত্তি নেই গ্রুপটির। ভাড়ায় জমি নিয়ে সাইনবোর্ডে লেখা হয়েছে, ‘নিজস্ব সম্পত্তি’। জমির মালিকরা জানেনই না তাদের জমি বিক্রির জন্য বুকিং হয়ে গেছে। অবৈধ প্রকল্প এভাবে প্রতারণা করে গ্রাহকদের হাজার কোটি টাকা লুট করে পকেটে ভরছে এ প্রতিষ্ঠানটি। সাইনবোর্ডসর্বস্ব প্রজেক্টে প্লট ও ফ্ল্যাটে বিনিয়োগ করেই প্রতারণার ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এ চক্রের সঙ্গে কৌশলে সম্পৃক্ত আছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও উঠতি বয়সের যুবকরা।

তবে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ভাইয়া গ্রুপের ডিজিএম সোহেল রানা বলেন, ‘আগে জমি কিনে কেউ এ ব্যবসায় নামে না। আমরা আস্তে আস্তে জমি ক্রয় করছি। গত এক মাসে প্রায় ২১ কোটি টাকার জমি কেনা হয়েছে।’

তবে এ জমি তারা কোথায় কিনেছেন, জানতে চাইলে তা সুনির্দিষ্ট করে আর বলতে পারেননি তিনি।

প্রকল্পের নাম ঘন ঘন পরিবর্তনের কারণ জানতে চাইলেও সদুত্তর দিতে পারেননি এই ডিজিএম।

সরেজমিন দেখা যায়, অনলাইনে পাইন সিটি (পূর্বাচল) নামে বিজ্ঞাপন দিলেও আসলে এটি পূর্বাচলের আশপাশেও নেই। এই প্রজেক্ট গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরী ইউনিয়নের বিরতুল গ্রামে। জমি ভাড়া করে তারা সেখানে একটি সাইট অফিস করেছেন। রাস্তার পাশে সামান্য জমি কিনে দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। ভেতরে বড় বিল। বিলের মধ্যে ভাইয়া গ্রুপের নামে বেশ কয়েকটি সাইনবোর্ড রয়েছে। তবে এতে কোথাও পাইন সিটির নাম লেখা নেই।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৫ লাখ টাকা জামানত দিয়ে মাসে ৭০ হাজার টাকায় ভাড়া নিয়েছেন এই সাইট অফিস। জমির মালিক বীরতুল গ্রামের অ্যাডভোকেট জাকির হোসেন সরকার। অফিসের প্রবেশপথে প্রধান ফটকটি পাকা; কিন্তু সেখানে কোনো সাইনবোর্ড নেই। তবে ভেতরে ঢুকেই বিলের মধ্যে বেশ কয়েকটি সাইনবোর্ড দেখা গেছে। জমি ভাড়া নিয়ে এসব সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা।

অথচ পুরো বিলের প্রায় ৪০০ একর জমি নিজেদের বলে দাবি করছে ভাইয়া গ্রুপ। প্রকল্পের রঙিন প্রচারপত্রে এমন তথ্যই দেওয়া হয়েছে। এতে শপিংমল, স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ক্লিনিক, হসপিটাল, পুলিশ স্টেশন, কবরস্থান, কমিউনিটি সেন্টার, ব্যায়ামাগার, ফায়ার স্টেশন ও স্টেডিয়ামসহ অত্যাধুনিক নাগরিক সুবিধার কথাও বলা হয়েছে। এ প্রচারপত্র দেখে অনেকেই এক খণ্ড জমি কেনার স্বপ্ন দেখতে পারেন। তবে বাস্তবে এখানে ভাইয়া গ্রুপের জমি আছে মাত্র ৪ বিঘা।

বিরতুল গ্রামের আনজত আলী সরকার জানান, এ বিলে আমাদের প্রায় ২শ বিঘা জমি আছে। আমি বা আমার ভাতিজা অ্যাডভোকেট জাকির সরকার কখনো এ জমি বিক্রি করবে না। তারা যে সাইট অফিস করেছে সেটাও আমাদের কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছে।’

আকাশ নামে স্থানীয় এক যুবক বলেন, ‘প্রতিদিনই জমি দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে অনেক মানুষ আসছে এখানে। আসলে তারা কার জমি দেখাচ্ছেন, কার জমি বিক্রি করবেন, কিছুই বুঝতে পারছি না। প্রকৃতপক্ষে এখানে বিক্রি করার মতো তাদের কোনো জমি নেই। এখানে বিনিয়োগ করলে গ্রাহক প্রতারিত হবেন।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক চা দোকানি বলেন, ‘আমাদের এলাকার কিছু ছেলে জোরজবরদস্তি করে অন্যের জমিতে সাইনবোর্ড লাগাতে সহায়তা করছে। ছেলেদের এসব কর্মকাণ্ডে অভিভাবকরা চিন্তিত।’

ভাইয়া গ্রুপের নাম পরিবর্তন হওয়া আরেক প্রকল্পের নাম টিউলিপ ভ্যালি (পূর্বাচল)। ৭ মাস আগেও এখানকার সাইনবোর্ডে বেস্টওয়ে হাউজিং লেখা ছিল। পরে রাতারাতি হয়ে যায় টিউলিপ ভ্যালি। অনলাইনে বিজ্ঞাপনে ৩০০ ফুট রাস্তার পাশে বলা হলেও আসলে এটি নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার গোল্লাকান্দা ইউনিয়নের মাওনা গ্রামে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পূর্ব পাশে। সেখানে টিউলিপ ভ্যালি নামে তাদের কোনো সাইনবোর্ড খুঁজে পাওয়া যায়নি। কাদামাটি পেরিয়ে মহাসড়ক থেকে ২০০ মিটার পূর্বদিকে জলাবদ্ধ মাঠ। এই মাঠে ভাইয়া গ্রুপের বেশ কয়েকটি সাইনবোর্ড রয়েছে।

প্রজেক্টের পাশেই ছোট্ট এক দোকানে কয়েকজন যুবককে বসে থাকতে দেখা গেছে। তাদের কাছে এই প্রকল্প সম্পর্কে জানতে চাইলে একজন বলেন, এটিই তাদের অফিস। সামনে একটি কনটেইনার দেখিয়ে বলেন, আগে ওইটা তাদের অফিস ছিল। এই প্রকল্পের এখনো কোনো প্রচারপত্র তৈরি হয়নি। তবে প্রতিদিনিই জমি কেনার জন্য লোকজন আসছে। আশা করা হচ্ছে, চমৎকার লোকেশনে তারা ভালো ক্রেতা পাবে।’

স্থানীয় সোহেল ভূঞা জানান, তার জমির ওপরেও এখানে কিছু সাইনবোর্ড আছে। তবে এখানকার অধিকাংশ জমি এমদাদ ভূঞার। এসব জমি সিটি ব্যাংকে মর্টগেজ রাখা আছে। আগে বেস্টওয়ে নামে একটি কোম্পানি পাকা সাইনবোর্ড লাগিয়েছিল। তারা সুবিধা করতে না পেরে পরে চলে যায়। এরপর ভাইয়া গ্রুপ এসেছে। এই গ্রুপের আসলে জমি বিক্রি করার কোনো সুযোগ নেই।’

যারা জমি কিনতে আসে, তারা যেন জেনেশুনে আসে এমন সতর্কবার্তাও দেন তিনি।

ভাইয়া গ্রুপের জিএম শামীম রেজা কালবেলাকে জানান, ‘পাইন সিটিতে ইতোমধ্যে ১ হাজার ৭০০-এর বেশি প্লট বিক্রি হয়েছে।’

জমিসহ পাইন সিটির সাইট অফিস অ্যাডভোকেট জাকির সরকারের কাছ থেকে ভাড়া নেওয়ার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমরা জমি ক্রয় করব।’

জমি না কিনেই এত প্লট কীভাবে বিক্রি করছেন— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এই ব্যবসা এভাবেই হয়। এ ব্যবসা সম্পর্কে জেনে পরে প্রশ্ন করবেন।’

কোম্পানির ডিজিএম আজীজুল হাকিম জানান, টিউলিপে এ পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার প্লট বিক্রি হয়েছে।

স্থানীয় এক মুদি দোকানি বলেন, এই জমি কেনাবেচার কোনো সুযোগ নেই। না জেনে না শুনে এখানে বিনিয়োগ করলে একেবারে মাঠে মারা যাবে। স্থানীয় একটি চক্র এই ভূমিদস্যুদের আশকারা দিচ্ছে।

জানা গেছে, শুধু প্লট নয়, বাণিজ্যিক ভবনে প্লট কিনেও ভাইয়া গ্রুপের প্রতারণার শিকার হচ্ছে মানুষ। রাজধানীর রাজারবাগে একটি বাণিজ্যিক ভবন প্রকল্প ২০১৩ সালে ক্রেতাদের বুঝিয়ে দেওয়ার কথা থাকলেও এখনো তা করা হয়নি। ফলে বিপুলসংখ্যক ক্রেতা ছাড়াও বিপাকে পড়েছেন ওই জমির মালিক। বিভিন্ন পর্যায়ে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাভারের অবৈধ প্রকল্প মধুমতি মডেল টাউনের মালিকানায়ও ছিল ভাইয়া গ্রুপ। উচ্চ আদালত মধুমতি মডেল টাউন প্রকল্পকে অবৈধ ঘোষণা করে। প্রকল্পের ৫ হাজার গ্রাহককে প্লটের দামের দ্বিগুণ অর্থ পরিশোধের নির্দেশ প্রদান করে। তবে পূর্বের কর্মকাণ্ড আড়াল করতে নতুন নাম দেওয়া হয় প্রকল্পের। সরেজমিন দেখা যায়, নান্দনিক হাউজিং প্রকল্প নামে এখানে ব্যানার এবং বিজ্ঞাপন লাগানো রয়েছে।

পর্যটন নগরী কক্সবাজারে অস্তিত্বহীন ডেভেলপার কোম্পানি এরিস্টোক্রেট বিল্ডার্সের এক যুগ আগের পরিত্যক্ত ভবনকে ‘ইডেন বে’ নাম দিয়ে নিজেদের নামে চালিয়ে দিচ্ছে ভাইয়া গ্রুপ। এর মধ্য দিয়ে ক্রেতাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে কোটি কোটি টাকা।

তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করে ভাইয়া গ্রুপের ব্যবস্থাপক আজীজুল হাকীম কালবেলাকে বলেন, ‘আমাদের কোম্পানি জমি কিনেই ব্যবসা করছে। ক্রেতাদের যথাসময়ে প্লট বুঝিয়ে দেওয়া হবে।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মোস্তফা জামাল হায়দারের সুস্থতায় দোয়া চাইলেন রাশেদ প্রধান

পুশ-ইন নিয়ে আবার চিঠি দেব দিল্লিকে : পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

কুমিল্লায় জাতীয় পুষ্টি সপ্তাহের পুরস্কার বিতরণ

লাখো ভক্তের সমাগমে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর তিরোধান দিবস পালিত

ভুটানের বিপক্ষে কি দেখা যাবে হামজা-ফাহামিদুলকে?

বগুড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. কুদরত-ই-জাহান

কোটিপতি কমেছে ৭১৯ জন

মামলা থেকে নাম বাদ দিতে ৫ লাখ টাকা চাইলেন এসআই

নৌবাহিনীর উদ্যোগে পটুয়াখালীতে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা প্রদান

ঈদযাত্রার মধ্যে কেমন থাকবে আবহাওয়া

১০

মেট্রোরেলে বড় নিয়োগ, আবেদন ৪ জুনের মধ্যেই

১১

দুই ভাতিজিকে কুপিয়ে মারলেন চাচা

১২

বাজেট নিয়ে নাহিদের প্রতিক্রিয়া

১৩

ওবায়দুল কাদের গ্রেপ্তার দাবিতে প্রচার, যা জানা গেল

১৪

সাংবাদিকদের বসার কষ্ট দেখে দুঃখ প্রকাশ জামাল ভূঁইয়ার

১৫

ধানমন্ডিতে রিকশাচালকদের রেইনকোট বিতরণ

১৬

জনগণের প্রত্যাশা পূরণে সচেষ্ট সরকার : আইন উপদেষ্টা 

১৭

খাদ্য কর্মকর্তা কেজিতে ঘুষ নেন ৭৫ পয়সা

১৮

বাজেটকে ‘পুঁজিবাজারবান্ধব’ উল্লেখ করে স্বাগত জানাল ডিবিএ

১৯

বিমানে করে ঢাকা এলেন সৈয়দপুরের কসাই, আয় চমকে ওঠার মতো

২০
X