ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলের দখলদারি, অবৈধ বসতি স্থাপন এবং এ ধরনের অপতৎপরতা পর্যালোচনা করতে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ছয় দিনের শুনানি শুরু হয়। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের আহ্বানে ডাকা এ শুনানিতে বাংলাদেশসহ ৫২টি দেশ ও তিনটি সংগঠন অংশ নেয়। শুনানিতে যুক্তরাষ্ট্র বাদে প্রায় সব দেশই ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলের দখলদারি অবসানের দাবি জানায়। একই সঙ্গে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই যে ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা লাঘবের অন্যতম উপায়, সে বিষয়ে যুক্তি তুলে ধরেন দেশগুলোর প্রতিনিধিরা। ইসরায়েলের এ দখলদারিকে অবৈধ ঘোষণা এবং দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড ছেড়ে যাওয়ার বিষয়ে আইসিজের রুল জারি করা উচিত বলেও মত দেন তারা। শুনানি শেষ হলেও এ বিষয়ে অবশ্য মতামত ও নির্দেশনা দিতে ছয় মাসের মতো সময় লাগতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্বমোড়ল যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা সমর্থন পেয়ে যাওয়া ইসরায়েলের ওপর আইসিজের এ শুনানি ও সম্ভাব্য নির্দেশনা আদৌ কোনো প্রভাব ফেলবে কি? গ্রন্থনা : ওয়াহেদুজ্জামান সরকার
বসতি স্থাপনকারী কারা
ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরে তাদের জমিতে অধিকৃত পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেমে বসবাস করা ইসরায়েলি নাগরিকরাই বসতি স্থাপনকারী। তাদের আবাসনগুলো ফিলিস্তিনিদের জমিতে নির্মাণ করা হয়েছে। সাত লাখ বসতি স্থাপনকারী থাকেন ফিলিস্তিনে, যা ইসরায়েলের মোট জনসংখ্যার (৭০ লাখ) ১০ শতাংশ। অধিকৃত পশ্চিম তীরে ১৫০টি এবং পূর্ব জেরুজালেমে ১২৮টি এমন অঞ্চল রয়েছে। ফিলিস্তিনের অনুমোদন না থাকলেও ইসরায়েলি সরকার এসব বাড়ি করার অনুমোদন দেয়। একেকটি অঞ্চলে ইসরায়েলিদের ছোট ছোট দল থেকে ৪০০ জনের দলও বসবাস করে। কেউ কেউ এখানে আসেন ধর্মীয় কারণে। আবার অনেকেই আসেন সরকারের দেওয়া অর্থের লোভ ও তুলনামূলকভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় কম হওয়ার কারণে। এলাকাগুলোতে এক-তৃতীয়াংশের বেশি নাগরিক আল্ট্রাঅর্থোডক্স ইহুদি। পিউ রিসার্চ সেন্টারের মতে, পশ্চিম তীরে বসবাসকারী ইসরায়েলি ইহুদিরা এসব বসতির মাধ্যমে দেশের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করে। তাদের যুক্তি, এ বসতির নাগরিকরা নিরাপত্তা দেয়াল হিসেবে কাজ করেন।
সরকারের সমর্থনে বসতি স্থাপন
পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে ইহুদিদের বসবাসের জন্য বসতি নির্মাণে প্রকাশ্যে অর্থায়ন করছে ইসরায়েল সরকার। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনকারী ইহুদিদের প্রতি বছর প্রায় ২০ মিলিয়ন শেকেল (পাঁচ মিলিয়ন ডলার) দেয়। ওই অর্থ ফিলিস্তিনিদের ওপর নজরদারি প্রতিবেদন প্রস্তুত, ড্রোন, স্যাটেলাইট পরিচালনা, যানবাহনসহ নানা কাজে ব্যবহার হয়। গত বছর ৪ এপ্রিল, ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্রীয় বাজেটে সেই অর্থের পরিমাণ দ্বিগুণ করে ৪০ মিলিয়ন শেকেল (১০ মিলিয়ন ডলার) করতে বলে। বসতি স্থাপনকারীদের ফোনকল ও তাদের নিয়মিত তথ্য জানতে গত কয়েক বছর ধরে ‘ওয়ার রুম সি’ নামে একটি হটলাইন পরিচালনা করছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী।
নেতানিয়াহু আসার পর সম্প্রসারণ বাড়ে
১৯৯৩ সালে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) সঙ্গে অসলো চুক্তি সইয়ের পর ইসরায়েলি সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন বসতি নির্মাণ বন্ধ করে দেয়। তবে যেসব বসতি এরই মধ্যে ছিল, সেগুলোর আকার ঠিকই বড় হতে থাকে। বাড়তে থাকে জনসংখ্যাও। ১৯৯৬ সালে প্রথম ক্ষমতায় আসার পর থেকে ইসরায়েলের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বসতি সম্প্রসারণকে আরও জোরদার করেন। এ ছাড়া ভূমি আইনের ফাঁকফোকর ব্যবহার করে ফিলিস্তিনিদের তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করতে কাজ করে ইসরায়েলি এমন বেসরকারি সংস্থা রয়েছে। ইসরায়েলের ইস্যু করা বিল্ডিং পারমিট ও জমির নথির অভাব দেখিয়ে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষও নিয়মিতভাবে ফিলিস্তিনি সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত ও ধ্বংস করে। নেতানিয়াহু সরকার ক্ষমতায় আসার পর বসতি সম্প্রসারণ এভাবে চরম আকার ধারণ করে।
আন্তর্জাতিক আইন যা বলে
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, এসব বসতি সম্পূর্ণ অবৈধ। চতুর্থ জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী, ‘দখল করা এলাকায় দখলকারী শক্তির জনসংখ্যা স্থানান্তর করা নিষিদ্ধ। ফলে সব বসতি স্থাপন আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে অবৈধ।’ মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, বসতিগুলো ইসরায়েলি ছিটমহলের মতো কাজ করছে। এগুলোর কারণে অধিকৃত পশ্চিম তীর খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে পড়েছে। ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠলেও এ অঞ্চলগুলো ছাড়া সেটি হবে ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। আর যদি এ অঞ্চল থাকেও তবে এটিকে ছোট ছোট দ্বীপের মতো নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বসতি স্থাপনকে একাধিক প্রস্তাব ও ভোটের মাধ্যমে নিন্দা করেছে জাতিসংঘ। ২০১৬ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের একটি প্রস্তাবে বলা হয়, এ বসতির কোনো আইনি বৈধতা নেই।
ইসরায়েল যেভাবে পশ্চিম তীর নিয়ন্ত্রণ করে
পশ্চিম তীরের মধ্য দিয়ে ৭০০ কিলোমিটার প্রাচীর তৈরি করেছে ইসরায়েল। তাদের দাবি, এ দেয়াল নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে। অধিকৃত পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেমের তিন মিলিয়ন বাসিন্দাও এ দেয়ালের ভেতরে থাকে। নিজের জমিতে ঢুকতে ফিলিস্তিনি কৃষকদের ইসরায়েলের অনুমতির জন্য আবেদন করতে হয়। নিয়মিত বিরতিতে এ আবেদন করতে হয়। আবার কর্তৃপক্ষ চাইলে কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই অনুমতি না দেওয়া বা অনুমতি প্রত্যাহার করতে পারে। যেমন বেথলেহেমের নিকটবর্তী ওয়াদি ফুকিনে ফিলিস্তিনি গ্রামের ২৯১ হেক্টর জমির ২৭০ হেক্টরই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে ইসরায়েল। ওই অঞ্চলকে ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রিত (সি) হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। অধিকৃত পশ্চিম তীরের প্রায় ৬০ শতাংশ এলাকা সি-এর অধীনে পড়ে। সীমানা প্রাচীর ছাড়াও ১৪০টি চেকপোস্টসহ পশ্চিম তীরে ৭০০টির বেশি সড়ক ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। ৭০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে প্রতিদিন ইসরায়েলি ওয়ার্ক পারমিটসহ ওই সড়কে যাতায়াত করতে হয়। অধিকৃত পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম এবং গাজার মধ্যে ফিলিস্তিনিরা অবাধে চলাফেরা করতে পারে না। এর জন্য অনুমতির প্রয়োজন হয়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং বি সেলেমের মতো মানবাধিকার গোষ্ঠীর মতে, ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর আধিপত্য বাস্তবায়নে ইসরায়েলি নীতি ও আইনগুলো আসলে বর্ণবাদ।
প্রথম বসতি কখন নির্মিত হয়েছিল?
১৯৬৭ সালের জুনে ছয় দিনের যুদ্ধে পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম এবং গাজা উপত্যকা দখল করার পরই বসতি স্থাপন শুরু করে ইসরায়েল। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে পশ্চিম তীরে হেব্রনে নির্মিত প্রথম বসতির নাম দেওয়া হয় ইটিজিয়ন ব্লক। ওই বসতিতে এখন ৪০ হাজার ইসরায়েলি বাস করে। প্রাচীনতম বসতির মধ্যে একটি কাফার জিওন। যেখানে এক হাজারের মতো নাগরিক বাস করে। এ ছাড়া বৃহত্তম মোদি ইন ইলিট বসতিতে প্রায় ৮২ হাজার বসতি স্থাপনকারী রয়েছে, যাদের বেশিরভাগই উগ্র অর্থোডক্স ইহুদি। যুদ্ধ-পরবর্তী ইসরায়েলের সরকার এ নীতিতে অটল ছিল। ফলে অধিকৃত অঞ্চলে বসতি স্থাপনকারী জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। দখলকৃত পশ্চিম তীরের প্রায় ৪০ শতাংশ জমি এখন বসতির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত। এ বসতিগুলোতে থাকা চেকপয়েন্ট ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলিদের নজরদারির সুযোগ করে দেয়। এমনকি পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনের একটি অংশকে আরেকটির সঙ্গে বড় দূরত্ব তৈরি করে এ বসতিগুলো। একই দেশ হয়েও তারা ভিনদেশিদের মতো থাকতে বাধ্য হয়।