প্রাচীন পারস্য সভ্যতার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আধুনিক ইরানের রাজধানী তেহরান। হাজার হাজার বছরের ইতিহাসে যুদ্ধ ও নির্মাণের ধারাবাহিকতায় আজও মুখোমুখি হয়েছে যুদ্ধের ধ্বংস এবং বীরত্বের। জনপদ হিসেবে তেহরান অনেক পুরোনো হলেও রাজধানী হিসেবে তেহরানের বয়স প্রায় ৩০০ বছর। ১৭৮৬ সালে কাজার সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে যাত্রা শুরু হয় তেহরানের। ককেশাস অঞ্চলে ইরানি ভূখণ্ডের কাছাকাছি বলে তেহরানকে রাজধানী নগরী হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন কাজার সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম শাসক আগা মুহাম্মদ খান। মতান্তরে, তেহরান ১৭৯৬ সালে কাজার রাজবংশের আমলে রাজধানী হয়। ঐতিহাসিক স্থাপত্য এবং তেলের ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে এটি গুরুত্বপূর্ণ।
ইতিহাসবিদরা তেহরানকে নবম শতাব্দীকালের একটি ছোট গ্রাম বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু গ্রামটি কালক্রমে তার পার্শ্ববর্তী আলবুর্জ পাহাড়ের দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকণ্ঠের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহরের সঙ্গে একীভূত হয়ে পড়ে। মোঙ্গল শাসকদের ব্যাপক ভাঙাগড়ার মধ্যে তেহরান ক্রমেই সমৃদ্ধ হতে থাকে। তাদের হত্যাযজ্ঞ থেকে যেসব লোক বেঁচে যেতে সক্ষম হয় তারা তেহরানে চলে আসে। প্রকারান্তরে বহু বছর ধরেই তেহরান একটি প্রাদেশিক শহর হিসেবে পরিগণিত হতে থাকে।
মধ্যযুগের প্রসিদ্ধ ইতিহাসবিদ ইয়াকুত হামারি তার ‘মুজামুল বুলদান’ গ্রন্থে ইরানের রাজধানী সম্পর্কে বেশ কিছু মজার কথা লিখেছেন। তিনি জানিয়েছেন, তেহরান ছিল একটি বৃহৎ গ্রাম, যার কাঠামো নির্মিত হয়েছে ভূগর্ভে এবং বাসিন্দারা অনুমতি না দিলে কেউ ওই গ্রামে প্রবেশ করতে পারত না। তেহরান কীভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করল এবং ধীরে ধীরে আজকের এ বড় শহরে রূপ নিল? জানা গেছে, ওই অঞ্চলের তদানীন্তন শাসক শাহ ইসমাইলের পুত্র শাহ তাহমাসব সাফাভি যখন সিংহাসনে আরোহণ করেন তখন তার বয়স ছিল মাত্র দশ বছর। তিনি প্রায়ই সাফাভি রাজবংশের শাসকদের প্রথম রাজধানী কাজভিন বেড়াতে যেতেন। এ ছাড়া তার প্রপিতামহ মরহুম সাইয়্যেদ হামজার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রে শহরে শাহ আবদুল আজিমে যেতেন। ফেরার পথে তিনি তেহরান হয়ে যেতেন এবং শিকার করতেন। ধীর ধীরে তিনি সে স্থানটির বিশেষ অনুরাগী হয়ে ওঠেন এবং ওই শহরের চারদিকে দুর্গ প্রাচীরের মতো বেষ্টনী গড়ে তোলেন। দুর্গ প্রাচীরটির পরিধি ছিল ১৫ হাজার ফুট।
বাদশাহর ধর্মবিশ্বাস ছিল প্রবল। তিনি পবিত্র কোরআনের সুরা সংখ্যার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নগরীর চারদিকে ১১৪টি টাওয়ার নির্মাণের আদেশ দেন। নির্মিত প্রতিটি টাওয়ারে পবিত্র কোরআনের এক-একটি সুরা লিপিবদ্ধ করা হয় যাতে ওই শহর এবং শহরের বাসিন্দারা দৈব-দুর্বিপাক থেকে রক্ষা পায়। এ ছাড়া নির্মাণ করা হয় দুটি তোরণ এবং দুর্গ প্রাচীরের অভ্যন্তরে দুটি জায়গা থেকে মাটি সরিয়ে দুটি গহ্বর সৃষ্টি করা হয়। গহ্বর দুটির একটির নাম দেওয়া হয় ‘চালে ময়দান’ (চত্বর গহ্বর) এবং অন্যটির নাম দেওয়া হয় ‘চালে হেসার’ (দুর্গ গহ্বর)। বর্তমানে ওই গহ্বর দুটি ভরাট হয়ে গেলেও ওই জায়গাগুলোর নাম আগের মতোই রয়ে গেছে। তাহমাসব প্রাচীর ধ্বংস এবং শহরটি বেড়ে উঠলে পর কাজার শাহিবংশের প্রতিষ্ঠাতা আগা মুহাম্মদ খান নগরীর চারদিকে একটি নতুন দেয়াল নির্মাণ করেন। তিনি তার অভিষেকের দিন ১৭৮৩ সালের ২১ মার্চ তেহরানকে রাজধানী ঘোষণা করেন। তখন তেহরানের লোকসংখ্যা ছিল মাত্র দশ থেকে বিশ হাজার।
১৯২৫ সালে রেজা শাহ ক্ষমতায় আরোহণ করে তেহরানকেই দেশের রাজধানী হিসেবে বহাল রাখেন এবং শহরটিকে আধুনিকায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৪৫ সাল থেকে তেহরান শহর উত্তরদিকে সম্প্রসারিত হতে থাকে। আলবুর্জ পাহাড়ের পাদদেশে তেহরান ও শেমিরানের মধ্যবর্তী সমস্ত মরু এলাকায় নতুন নতুন উপশহর সৃষ্টি হতে থাকে। বর্তমানে তেহরান পৃথিবীর অন্যতম শক্তিধর রাজধানী। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, আধুনিক সমরাস্ত্র ইত্যাদি সব দিক থেকেই স্বয়ংসম্পূর্ণ। ১৯৭৯ সালে পাহলভি সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়ে ইসলামী শিয়া বিপ্লবের মাধ্যমে উত্থান ঘটে ধর্মীয় শাসনের। দেশের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ইসলামী বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লা খামেনির হাতে। বর্তমানে দেশের ধর্মীয় গুরুত্ব হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ১৯৭৯ সালের বিপ্লবী আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। পরমাণু অস্ত্রের অভিযোগে রাজধানী তেহরান এখন ইসরায়েলের তেল আবিবের হামলার লক্ষ্যবস্তু।
মন্তব্য করুন