উত্তর এশিয়া ও পূর্ব ইউরোপজুড়ে বিস্তৃত বিশ্বের বৃহত্তম দেশ রাশিয়া। বহু জাতি-ধর্মের এ দেশ ইহুদি-খ্রিষ্টান অধ্যুষিত হলেও ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়ে ইসলামের প্রথম যুগেই। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ইন্তেকালের মাত্র ২২ বছর পর রাশিয়ার মাটিতে ইসলামের আলো পৌঁছে যায়। বর্তমান রাশিয়ার দাগিস্তান অঞ্চল সর্বপ্রথম মুসলিম শাসনাধীন হয়। এরপর ইতিহাসের নানা পর্যায়ে উমাইয়া, আব্বাসীয়, উসমানীয় ও সেলজুক শাসকরা বর্তমান রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল বিজয় করেন। ১৫৭১ খ্রিষ্টাব্দে ক্রিমিয়ান ও তুর্কি বাহিনী রাশিয়ার রাজধানী মস্কো পর্যন্ত পৌঁছে যায়। কিন্তু খেলাফত তথা কেন্দ্রীয় মুসলিম শাসনব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যাওয়ার পর রুশ অঞ্চলে একাধিক স্বাধীন মুসলিম রাজ্য গড়ে ওঠে। আঠারো শতকের শুরু থেকে রুশ সাম্রাজ্য প্রতিবেশী এসব রাজ্য দখল করে নেয়। রাশিয়ার কোন অঞ্চলে কখন ইসলাম প্রতিষ্ঠা পায়, সংক্ষেপে তুলে ধরছি:
ইঙ্গোশেটিয়া: ইঙ্গোশেটিয়ার প্রাতিষ্ঠানিক নাম ‘ইঙ্গোশেটিয়া প্রজাতন্ত্র’। এটি রাশিয়ার একটি স্বায়ত্তশাসিত কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক অঞ্চল। ৩ হাজার ৬২৮ বর্গকিলোমিটারের ছোট্ট ইঙ্গোশেটিয়ার ৯৬ শতাংশ অধিবাসী মুসলিম। মাগাস তার রাজধানী। ইঙ্গোশ মুসলিম শাফেয়ি মাজহাব ও সুন্নি মতবাদের অনুসারী। বেশিরভাগ মানুষ ইঙ্গোশ ভাষা ব্যবহার করে। উনিশ শতকে এটি রুশ সাম্রাজ্যের অধীন হয়। ১৯৩৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ইঙ্গোশেটিয়াকে চেচনিয়ার সঙ্গে যুক্ত করে ‘দ্য চেচেন-ইঙ্গোশ অটোনমাস রিপাবলিক’ ঘোষণা করে। ১৯৯১ সালে চেচনিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করলে ইঙ্গোশেটিয়া নবগঠিত রুশ ফেডারেশনে যোগদান করে। প্রচুর খনিজ সম্পদের অধিকারী হলেও এটি অন্যতম দারিদ্র্য অঞ্চল। বর্তমানে ইঙ্গোশেটিয়ায় চারশর বেশি মসজিদ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
চেচনিয়া: চেচনিয়া প্রজাতন্ত্রও রাশিয়ার একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। চেচনিয়ার ৯৫ শতাংশ নাগরিক মুসলিম। ১৭ হাজার ৩০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের চেচনিয়ার রাজধানী শহর গ্রোজনি। ধারণা করা হয়, ৬৩৯ খ্রিষ্টাব্দে চেচনিয়ায় ইসলামের আগমন হয়। তবে ইসলামী শাসন স্থিতিশীল হয় ৭৩০ খ্রিষ্টাব্দের পর। ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে চেচনিয়ায় রুশ আগ্রাসন শুরু হয়। এরপর তিন শতাব্দীকালেও শেষ হয়নি চেচেন মুসলিমদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। নিকট-অতীতেও চেচনিয়া দুটি ভয়াবহ যুদ্ধের মুখোমুখি হয়। ১৯৯৪-৯৬ প্রথম রুশ-চেচেন যুদ্ধ এবং ১৯৯৯-২০০০ দ্বিতীয় রুশ-চেচেন যুদ্ধ। ২০০১ সালে রাশিয়া ও চেচনিয়ার মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং ২০০৩ সালে রাশিয়া চেচনিয়ার জন্য নতুন সংবিধান রচনা হলে চেচনিয়ায় শান্তি ফিরতে শুরু করে।
দাগিস্তান: ২০ হিজরিতে ওমর (রা.)-এর শাসনামলে সাসানিদের পরাজিত দাগিস্তানের ‘বাবুল আবওয়াব’ শহর জয় করেন সাহাবি সুরাকা ইবনে আমর (রা.)। এরপর থেকে দাগিস্তান ওই অঞ্চলে ইসলামের দুর্গ হিসেবেই ভূমিকা পালন করে আসছে। ‘দাগিস্তান প্রজাতন্ত্রে’ জন্মগ্রহণ করেন কিংবদন্তি স্বাধীনতাসংগ্রামী ইমাম শামিল। রুশ বিপ্লবের পর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে দাগিস্তানকে সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত করা হয় এবং রুশ ফেডারেশন গঠিত হওয়ার পর স্বায়ত্তশাসন অক্ষুণ্ন রাখা হয়। তবে স্থানীয় মুসলিমরা কখনোই রুশ আগ্রাসন মেনে নেয়নি। ১৯৯৯ সালে দাগিস্তান স্বাধীনতা ঘোষণা করে। দাগিস্তানের আয়তন ৫০ হাজার ৩০০ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যার ৮২.৬০ শতাংশ মুসলিম। রাজধানী শহর মাকাসকালা। রুশ বিপ্লবের আগে দাগিস্তানে ১ হাজার ৭০০ মসজিদ ও ৭৬৬ মাদ্রাসা ছিল, যা পরিচালনা করতেন আড়াই হাজার আলেম ও কাজি। সোভিয়েত সরকার তা বন্ধ করে দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর দাগিস্তানে মুসলিম জাগরণ হয়। সেপ্টেম্বর ২০০৩-এর পরিসংখ্যান অনুসারে, বর্তমানে দাগিস্তানে ৫৫৭টি সাধারণ মসজিদ, ১ হাজার ৯১টি নামাজ কক্ষ, ১৬টি ইসলামী কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়, ১৪১টি মাদ্রাসা এবং ৩২৪টি মসজিদভিত্তিক মক্তব রয়েছে।
কারচে-চের্কেসিয়া: হিজরি দ্বিতীয় শতকে মুসলিমরা আর্মেনিয়া জয় করার পর ওই অঞ্চল মুসলিম শাসনাধীন হয়। খ্রিষ্টীয় সপ্তদশ শতক থেকে চের্কেসিয়ায় রুশ আগ্রাসন শুরু হয়। কারচে-চের্কেসিয়ার আয়তন ১৪ হাজার ২৭৭ বর্গকিলোমিটার। চের্কেসিয়ার জনসংখ্যার ৬৪.২ শতাংশ মুসলিম। ১৯২২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত হয় এবং ১৯২৮ সালে স্বায়ত্তশাসন লাভ করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার চের্কেস নেতারা রুশ ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত হয়।
বাশকোরতুস্তান: রুশ সংবিধান অনুযায়ী, এটি রুশ ফেডারেশনের অধীন একটি সার্বভৌমত্বহীন স্বাধীন রাষ্ট্র। আয়তন ১ লাখ ৪৩ হাজার ৬০০ বর্গকিলোমিটার। রাজধানী উফা। এটি রাশিয়ার সবচেয়ে জনবহুল ও খনিজসমৃদ্ধ এলাকা। বাশকোরতুস্তানকে সংক্ষেপে বাশখিরও বলা হয়। বাশখিরের জনসংখ্যার ৫৮.৬২ শতাংশ মুসলিম। ধারণা করা হয়, খ্রিষ্টীয় দশম শতকে এখানে ইসলামের আগমন হয় এবং মোগল মুসলিমদের মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠা পায়। তবে ষষ্ঠদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে রুশ আগ্রাসনে তারা স্বাধীনতা হারায়। বাশখির সোভিয়েত রাশিয়ার প্রথম গঠিত প্রজাতন্ত্র। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর ১১ অক্টোবর ১৯৯০ স্বাধীনতা ঘোষণা করে। তবে রহস্যজনক কারণে তা প্রত্যাহার করে বাশখির নেতারা রুশ ফেডারেশনে যোগদান করে।
কাবার্ডিনো-বালকারিয়া: কাবার্ডিনো-বালকারিয়া অঞ্চলে ইসলামের আগমন ঘটে খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকে। মুসলিমরা খাজার রাজ্য জয় করার পর সেখানে ইসলামের অগ্রযাত্রা শুরু হয় এবং তা অব্যাহত থাকে ১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত, যখন রুশ সাম্রাজ্যের কাছে অত্র অঞ্চল স্বাধীনতা হারায়। কাবার্ডিনো-বালকারিয়ার মোট আয়তন ১২ হাজার ৫০০ বর্গকিলোমিটার। রাজধানী শহর নলচিক। ইউরোপের সর্বোচ্চ পর্বত মাউন্ট এলব্রাস এখানে অবস্থিত। কাবার্ডিনো-বালকারিয়ার জনসংখ্যার ৫৫.৪ শতাংশ মুসলিম।
তাতারস্তান: রাশিয়ার একটি স্বায়ত্তশাসিত কেন্দ্রীয় অঞ্চল। খ্রিষ্টীয় দশম শতকে এখানে ইসলামের বিস্তার ঘটে এবং দ্বাদশ শতকে ব্যাপক প্রসার লাভ করে। ১৪৩৮ খ্রিষ্টাব্দে চেঙ্গিস খানের একজন বংশধর কাজানকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে, যা ১৫৫২ খ্রিষ্টাব্দে রুশ সাম্রাজ্যের কাছে স্বাধীনতা হারায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার পরও তাতার মুসলিমরা স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর ১৯৯৪ সালে তাতার জনগণ গণভোটে স্বাধীনতার পক্ষে রায় দেয়। কিন্তু তাতার নেতারা ১৯৯৪ সালে সম্পাদিত এক চুক্তির অধীনে রুশ ফেডারেশনে যোগদান করে। তাতারস্তানের আয়তন ৬৮ হাজার বর্গকিলোমিটার। রাজধানী শহর কাজান। জনসংখ্যার ৫৩.৮ শতাংশ মুসলিম।
লেখক: মাদ্রাসা শিক্ষক
মন্তব্য করুন