মানবতার মুক্তিদূত হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন আদর্শের প্রতীক। মহান আল্লাহর ইবাদত আর মানুষকে দ্বীনের প্রতি আহ্বানই ছিল তার দৈনন্দিন কাজ। নবীজি (সা.) নিজে আমল করার মধ্য দিয়ে সাহাবিদের শিখিয়েছেন কীভাবে আমল করলে আল্লাহকে পাওয়া যাবে, পরকালে চির শান্তির ঠিকানা জান্নাত পাওয়া যাবে। এখানে নবীজি (সা.)-এর যাপিত জীবনের ছোট একটি চিত্র তুলে ধরা হলো।
মধ্যরাতে ঘুম থেকে ওঠা: রাসুলুল্লাহ (সা.) মধ্যরাতে ঘুম থেকে উঠতেন। ঘুম থেকে উঠে, ‘আলহামদুলিল্লাহিল্লাজি আহয়ানা বা’দামা আমাতানা ও ইলাইহিন নুশুর’ এ দোয়া পড়তেন। তিনি কোনো স্বপ্ন দেখলে সাহাবায়ে কেরামকে তা শোনাতেন। সাহাবায়ে কেরামের স্বপ্নও শুনতেন।’ (বোখারি: ১১২১)।
প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণ: প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণে জুতা পরিধান করে তিনি বাথরুমে যেতেন। তখন মাথা ঢেকে রাখতেন। বাম পা দিয়ে প্রবেশ করতেন। প্রবেশের আগে এই দোয়া পাঠ করতেন, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল খুবুসি ওয়াল খাবায়িস।’ (বোখারি: ৯৩৬)।
শেষ রাতে তাহাজ্জুদ আদায়: শেষ রাতে প্রথমে ওজু করতেন। তখন এই দোয়া বারবার পড়তেন, ‘আল্লাহুম্মাগফিরলি জাম্বি ওয়া ওয়াসসিলি ফি দারি ওয়া বারিকলি ফি রিজকি; অর্থাৎ, হে আল্লাহ! তুমি আমার গুনাহ মাফ করে দাও ও আমার রিজিকে বরকত দাও এবং আমার বাসস্থান প্রশস্ত করে দাও। ওজু শেষে আকাশের দিকে তাকিয়ে কালিমা পড়তেন। এরপর তিনি তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করতেন। ৪, ৬, ৮ বা কখনো ১২ রাকাত আদায় করতেন। হজরত বেলাল (রা.) ফজরের আজান দিলে দুই রাকাত সুন্নত ঘরে আদায় করতেন। ফজরের নামাজ মসজিদে আদায় করতেন।’ (বোখারি: ১১৪৭)
ঘরোয়া কাজে অংশগ্রহণ: ইচ্ছা ও আগ্রহ নিয়ে তিনি ঘরের কাজকর্মে অংশগ্রহণ করতেন। ঘর পরিষ্কার করতেন, গৃহপালিত পশু-পাখিদের খাবার দিতেন। নিজ হাতে বকরির দুধ দোহন করতেন। কাপড়, জুতা সেলাই করতেন। বাজার করতেন। এক কথায় ঘরোয়া কাজে তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে সহযোগিতা করতেন। (বোখারি: ৫২১৬)
রুচিসম্মত পোশাক পরিধান: রাসুলুল্লাহ (সা.) লম্বা জামা পরিধান করতেন। তার জামার হাতাও কবজি পর্যন্ত লম্বা থাকত। জামা পরিধানের সময় ডানদিক থেকে এবং খোলার সময় বাঁ দিক থেকে শুরু করতেন। তিনি জুমার দিন নতুন পোশাক পরিধান করতেন। সাদা পোশাক বেশি পরিধান করতেন। সাদা ছাড়া অন্য রঙের কাপড়ও পরতেন। পাগড়ি পরতেন। পাগড়ির নিচে টুপিও পরতেন আবার কখনো শুধু টুপি পরতেন। (বোখারি: ৫৮১৩)
দোয়া পড়ে খাবার খেতেন: রাসুলুল্লাহ (সা.) ঠান্ডা ও মিষ্টিপানীয় পছন্দ করতেন। গ্লাস ডান হাতে ধরতেন। বিসমিল্লাহ বলে বসে বসে পান করতেন। অল্প অল্প করে দুই-তিনবারে পান করতেন। হাত ধুয়ে মাটিতে বসে দস্তরখানায় খাবার খেতেন। বিসমিল্লাহ বলে সামনের দিক থেকে খাবার নিতেন। খাবার শেষ হলে আঙুল চেটে খেতেন এবং কোনো খাবার পাত্রে অবশিষ্ট রাখতেন না। নিজ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বসে একত্রে খাবার খেতেন। খাওয়া শেষে এই দোয়া পড়তেন, ‘আলহামদুলিল্লাহিল্লাজি আতয়ামানা ওয়াসাকানা ওয়াজাআলানা মিনাল মুসলিমিন, অর্থাৎ সব প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাদের খাবার খাইয়েছেন, পানি পান করিয়েছেন এবং মুসলমান বানিয়ে জন্ম দিয়েছেন।’ (আবু দাউদ: ৩৮৫১)
সুগন্ধি ও তেল ব্যবহার: রাসুলুল্লাহ (সা.) রায়হান মেশক এবং উদের খুশবু পছন্দ করতেন। গোসলের পর ও রাতে সুগন্ধি ব্যবহার করতেন। মাথায় ও দাড়িতে তেল ব্যবহার করে তা চিরুনি দিয়ে আঁচড়াতেন। (নাসায়ি: ৫০২৭)
ডান পথে হাঁটতেন: সবসময় ডান পথ ধরে হাঁটতেন। কোথাও গমনকালে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে রওনা করতেন। উঁচু স্থানে আরোহণে ‘আল্লাহু আকবার’ এবং নিচে নামার সময় ‘সুবাহানআল্লাহ’ বলতেন। তিনি হাঁচির পর ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলতেন এবং হাঁচির জবাব দিতেন। (মুসলিম: ২৩৩০)
রোগীর সেবা করতেন: নিজ এলাকায় কেউ অসুস্থ হলে তিনি হেঁটে তার বাড়ি যেতেন। অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করে রোগীর সেবাযত্ন করতেন এবং কপালে হাত রাখতেন। সান্ত্বনা দিয়ে তার আরোগ্যের জন্য দোয়া করতেন। অমুসলিম রোগীদেরও সেবা করতেন। (মুসলিম: ২১৬২)
নবীজির হাস্য-রসিকতা: রাসুলুল্লাহ (সা.) মাঝেমধ্যে বাস্তবতার নিরিখে কৌতুক করতেন। তিনি একদা এক সাহাবিকে বললেন, ‘ওহে দুই কানওয়ালা।’ তিনি জনৈক বৃদ্ধা মহিলাকে বললেন, ‘কোনো বৃদ্ধা মহিলা জান্নাতে যাবে না।’ এ কথা শুনে বৃদ্ধা কাঁদতে শুরু করল। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘বৃদ্ধারা যুবতী হয়েই জান্নাতে যাবে।’ (বোখারি: ১৯১৪)
পরিচ্ছন্নতায় গুরুত্বারোপ: পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকে ইমানের অঙ্গ বলেছেন নবীজি (সা.)। তিনি নিয়মিত গোসল করতেন এবং সাহাবিদের পরিচ্ছন্নতার প্রতি গুরুত্বারোপ করতেন। তিনি নাক পরিষ্কার করতেন বাঁ হাতে। প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণের পর বাম হাতে পানি খরচ করতেন। (মুসলিম: ৫৫৬)
লেখক : মাদ্রাসা শিক্ষক
মন্তব্য করুন