বিশাল ভারতবর্ষ শাসনকারী মোগল স্রমাটদের অন্যতম আওরঙ্গজেব আলগমীর (১৬১৮-১৭০৭ খ্রিষ্টাব্দ)। তিনি প্রায় অর্ধশতাব্দী ভারতবর্ষ শাসন করেন। ভারতবর্ষে মোগল শাসকরা নতুন নতুন অট্টালিকা-প্রাসাদ ও মসজিদ নির্মাণ করে পৃথিবীকে তাকে লাগিয়ে দেন। আজও আগ্রার তাজমহল আর দিল্লির লালকেল্লা ভারতের ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে দুনিয়াব্যাপী আলোচিত। দিল্লির জামে মসজিদ আজও পর্যটকদের পদভারে মুখরিত। মোগল শাসকরা ভারতবর্ষে শিল্প-সাহিত্য, স্থাপত্য, সংগীত, জ্ঞানচর্চা ইত্যাদি সবক্ষেত্রে বিস্ময়কর অবদান রেখেছেন। এমন একটি অমর অবদান হচ্ছে আইনশাস্ত্রের গ্রন্থ ‘ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী’। এটি সম্রাট আওরঙ্গজেব আলমগীরের অমর কীর্তি। মোগল সম্রাটদের ভেতর তিনি ছিলেন সবচেয়ে ধর্মপরায়ণ শাসক। সম্রাট আলমগীর ও তার পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী নিয়ে প্রখ্যাত আরব সাহিত্যিক ও স্কলার শায়খ আলি তানতাভি বলেছেন, ‘তিনিই প্রথম সম্রাট, যিনি একই কিতাবে ইসলামী শরিয়তের বিধিবিধান সংকলনের কাজ করেছেন, যা পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রের সংবিধান হিসেবে গৃহীত হয়। তারই নির্দেশ ও তত্ত্বাবধানে একটি ফাতাওয়ার কিতাব লেখা হয়, যাকে তার নামের দিকে সম্পৃক্ত করে ‘ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী’ বলা হয়। পরবর্তী সময়ে এটি ‘ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া’ নামে প্রসিদ্ধ হয়, যা আহকামবিষয়ক ইসলামী ফিকহের এক অনবদ্য এবং অত্যন্ত সুবিন্যস্ত গ্রন্থ।’ (রিজালুম মিনাত তারিখ, পৃষ্ঠা: ২৩৬)
আবুল ফজল মুরাদি (রহ.) বাদশাহ আলমগীর ও ফাতাওয়া আলমগীরীর ব্যাপারে বলেন, “তিনি তার দেশের হানাফি আলেমদের নির্দেশ দিলেন, যেন তার নামে শরিয়তের বিধিবিধান সম্পর্কিত বিষয়ে হানাফি মাজহাবের অধিক গ্রহণযোগ্য (রাজেহ) ফাতাওয়া গ্রন্থ সংকলন করা হয়। অতঃপর তারা তা বহু খণ্ডে সংকলন করার পর নাম দিলেন ‘ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী’। তা হিজাজ, মিশর, সিরিয়া ও রোমের বিভিন্ন অঞ্চলে সমাদৃত হলো এবং এর দ্বারা উম্মতরা ব্যাপক উপকৃত হলো। এই কিতাব (বিভিন্ন দেশের) মুফতিদের প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হলো।” (সিলকুদ দুরার ফি আয়ানিল করনিস সানি আশার, আবুল ফজল মুরাদি: ৪/১১৩)
ফাতাওয়া আলমগীরী বা ফাতাওয়া হিন্দিয়া মূলত ইসলামী শরিয়তের বিভিন্ন বিধিবিধানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হানাফি মাজহাবের জাহির’র রিওয়াইয়া (প্রকাশ্য মত) এবং রাজেহ (অধিক সমর্থনপ্রাপ্ত) মত গ্রহণ করেছে। হানাফি মাজহাবের প্রখ্যাত ফিকহি কিতাব ‘হিদায়া’র বিন্যাসের আলোকে বিন্যস্ত করা হয়েছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে নাদের তথা বিরল ও বিচ্ছিন্ন মতও উল্লেখ করা হয়েছে। এ কিতাব সংকলনের কাজ করেন প্রায় দুই হাজার আলেম। (আস সাকাফাতুল ইসলামিয়া ফিল হিন্দ, শায়খ আবদুল হাই আল হাসানি, পৃষ্ঠা: ১১০-১১১)
ফাতাওয়া হিন্দিয়ার ভূমিকায় বলা হয়েছে, আওরঙ্গজেব (রহ.) ৫০০ ফকিহ আলেমকে নিয়োগ দেন। তাদের মধ্যে ৩০০ জন দক্ষিণ এশিয়া, ১০০ জন ইরাক এবং ১০০ জন হিজাজ থেকে আসা। দিল্লি ও লাহোরে সংকলনকর্মে শেখ নিজাম বোরহানপুরী (রহ.) দলের নেতৃত্ব দেন। তাদের আট বছরব্যাপী পরিশ্রমের মাধ্যমে ফাতাওয়া আলমগীরী প্রণীত হয়। এ গ্রন্থে বিভিন্ন সম্ভাব্য পরিস্থিতির সাপেক্ষে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, দাস, যুদ্ধ, সম্পদ, আন্তঃধর্মীয় সম্পর্ক, বিনিময়, কর, অর্থনীতি ও অন্যান্য আইন এবং আইনি নির্দেশনা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া: ১/৩)।
লেখক: মাদ্রাসা শিক্ষক
মন্তব্য করুন