২০০৭ সাল। ভোররাতে ধানমন্ডির ‘সুধা সদন’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঘেরাও করল। উদ্দেশ্য, শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার। তিনি তখন বিরোধীদলীয় নেতা। ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নিয়েছে ড. ইয়াজউদ্দিনের ব্যর্থ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছ থেকে।
যেটি আসলে বিএনপি সরকারেরই অন্যরূপ। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনাকে প্রথমে গ্রেপ্তার করার কারণ কেউ বুঝতে পারেনি। কারণ অতীত অভিজ্ঞতা হলো, নতুন সরকার এসে সদ্য বিদায়ী সরকারের বিরুদ্ধে নানা অভিযান পরিচালনা করে। সে ক্ষেত্রে বিরোধী দলের নেতাকে গ্রেপ্তার বিস্ময়কর! এ থেকেই বোঝা যায়, শেখ হাসিনা গণতন্ত্রের প্রশ্নে আপসহীন ছিলেন। এজন্য তিনিই হন অগণতান্ত্রিক শক্তির প্রধান লক্ষ্য। তারা শেখ হাসিনাকেই সবচেয়ে বেশি ভয় পেয়েছিল।
গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ধানমন্ডির ‘সুধা সদনে’ একদিন তিনি তোফায়েল আহমেদকে বললেন, এখনই যদি আমরা এই অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতায় থাকা সরকারকে বাধা না দিই তাহলে পরবর্তীকালে খুবই অসুবিধা হবে। আমার এখনো মনে আছে, তখন তোফায়েল আহমেদ উত্তরে বললেন, ‘তাদের আরও কিছুদিন সময় দেওয়া প্রয়োজন।’ এতে আওয়ামী লীগ সভাপতি খুব অসন্তুষ্ট হলেন। তিনি সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন। নামার পথে তিনি বললেন, ‘না, তাদের কোনো সময় দেওয়া যাবে না।’ তিনি বললেন, এখনই যদি তাদের প্রতিহত না করা যায় এবং তাদের যদি গ্রহণ করা হয় তাহলে তারা ‘সিন্দাবাদের ভূতের’ মতো ঘাড়ে চেপে বসবে।
বঙ্গবন্ধুকন্যা ১৯৮১ সাল থেকে বাংলাদেশের রাজনীতির যে একটি মৌলিক পরিবর্তন করেছেন, যা জনগণের চোখ এড়ায়নি। গণতন্ত্রের জন্য নিরন্তন সংগ্রাম করেছেন। ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তিনিই প্রধান যোদ্ধা। এ লড়াই তাকে দিয়েছে অনন্য অবস্থান। শেখ হাসিনাই একটা ‘ইনস্টিটিউশন’। সুতরাং এখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর তখনকার শেখ হাসিনার মধ্যে আমি কোনো পার্থক্য দেখি না। তখন তার কথায় লোকে যেমন বিশ্বাস করত, এখনো মানুষ তা করে। এজন্যই তিনি সেনা সমর্থিত সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়েছিলেন।
কয়েক দিন পর শেখ হাসিনা আমাকে ফোনে বললেন, ‘আমি চোখ পরীক্ষার জন্য যাব।’ আর এ সময় তিনি আমাকে বললেন, তিনি কোনো গণমাধ্যমের মুখোমুখি হবেন না। কিন্তু আমি ওই সময় ফোন করে সব মূলধারার গণমাধ্যমকে জানিয়ে দিলাম, আওয়ামী লীগ সভাপতি আসবেন। এরপর শেখ হাসিনা আমার চেম্বার থেকে বের হওয়ার সময় সাংবাদিকরা তাকে ঘিরে ধরেন। তিনি তখন বললেন, ‘আমার ফুপু অসুস্থ অথচ আমার ফুপাতো ভাই শেখ সেলিম জেলে বন্দি।’ এভাবে তার যেসব নেতা কারান্তরীণ, তাদের কথা বললেন এবং অসাংবিধানিক সরকারকে তিনি যে স্বীকার করেন না, তাদের অবিলম্বে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া উচিত—এ নিয়ে জোর গলায় বললেন। দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন দাবি করলেন শেখ হাসিনা। এর দুদিন পর তিনি ‘ল্যাবএইড’-এ গেলেন ক্যান্সার আক্রান্ত বিখ্যাত সংগীতশিল্পী সাবিনা ইয়াসমীনকে দেখতে। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে তিনি সাংবাদিকদের দেশের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বললেন। ড. ফখরুদ্দীনের নেতৃত্বাধীন সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কঠোর সমালোচনা করলেন।
সুতরাং এ দুটি ঘটনা থেকেই বোঝা যায়, অসাংবিধানিক সরকার তাকে টার্গেট করবে। এরপরই তার বাড়ি ঘেরাও করা হয়। গ্রেপ্তার হওয়ার পর তিনি কয়েকজনকে ফোন করেন, তাদের মধ্যে একজন প্রয়াত অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন। ফোন পেয়েই তিনি ‘সুধা সদনে’ হাজির হন। এ ছাড়া নেতাকর্মীরাও আসে। আমার ধারণা, যদি নেতাকর্মীরা শেখ হাসিনার গ্রেপ্তারের বিষয়ে আগে থেকে জানত তাহলে শেষ পর্যন্ত তারা রাস্তা ঘেরাও করত এবং শেখ হাসিনাকে কোর্ট পর্যন্ত নিয়ে যেতে দিত না।
শেখ হাসিনাকে নিয়ে পার্লামেন্ট ভবনের একটি স্যাঁতসেঁতে রুমে রাখা হলো। সেখানে তাকে জাতীয় অধ্যাপক শাহলা খাতুন এবং প্রাণ গোপাল দত্ত দেখতে গিয়েছিলেন। পরে তার সহকারী একজন জানালেন, শেখ হাসিনা চান আমি যেন তার সঙ্গে দেখা করি। এরপর আমি একটি আর্টিকেল লিখি এবং ওই আর্টিকেলটি ড্রাফট করার জন্য আমি নাঈমুল ইসলাম খানের কাছে গেলাম। তিনি ঠিক করে দেওয়ার পর আমি সৈয়দ বোরহান কবীরের কাছে গেলাম এবং তিনি আমাকে ড্রাফট ঠিক করে দিলেন, যা আমি পত্রিকায় দিলাম। সেই ড্রাফটির মূল কথাটি ছিল এরকম—‘আমি শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক। কিন্তু তার সঙ্গে আমাকে দেখা করতে দেওয়া হচ্ছে না।’ সেই লেখাটি পরের দিন ‘আমাদের সময়’ এবং ‘মানবজমিন’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এরপর কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েই জেলখানায় শেখ হাসিনার সঙ্গে আমার দেখা করার ব্যবস্থা করে। আমি শেখ হাসিনার শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে তাকে বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য সুপারিশ করি। কিন্তু আওয়ামী লীগেরই অনেক নেতা এতে আপত্তি তোলেন। তারা বলেন যে, শেখ হাসিনা যদি চিকিৎসার জন্য বাইরে যান তাহলে তাকে আর দেশে আসতে দেওয়া হবে না। তখনকার আওয়ামী লীগের মূল যেসব নেতা মাঠে ছিলেন যেমন—প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, ড. হাছান মাহমুদ, সাহারা খাতুন অনেকেই আমাকে বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন। এরপর আমি সংবাদ সম্মেলন করি। সেখানে আমি দাবি করি, শেখ হাসিনা গুরুতর অসুস্থ। উন্নতর চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশ নেওয়া প্রয়োজন। এরপর আওয়ামী লীগের সবাই শেখ হাসিনার চিকিৎসার প্রশ্নে সোচ্চার হন।
সংবাদ সম্মেলনে আমার সঙ্গে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবিএম আব্দুল্লাহ। এ ছাড়া ছিলেন প্রাণ গোপাল দত্ত এবং শাহলা খাতুন। আমরা এই কজন এসংক্রান্ত একটি বিবৃতি তৈরি করি এবং তা পত্রিকায় পাঠাই।
২০০৭ সালের ১৬ জুলাই যখন শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করা হয়, তখন যারা অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে সাহারা আপা এখন আমাদের মধ্যে নেই। অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম তখন শেখ হাসিনার আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ যিনি পরে আইনমন্ত্রী হয়েছেন, তিনিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সেই সময় ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। এ ছাড়া মোহাম্মদ আলী নামে একজন আয়কর সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে নেত্রীর সঙ্গে জেলে দেখা করেছেন এবং খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
কিন্তু আজকে কেবিনেট মেম্বার অনেকেরই সেই সময় কোনো ভূমিকা ছিল না। অথচ তারাই আজ প্রধানমন্ত্রীর আশপাশে ঘিরে আছে। এমনকি যেসব আমলা সেই সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, তারা আজ প্রধানমন্ত্রীর কাছে নেই। নতুনদের ভিড়ে পুরোনোরা চাপা পড়ে গেছেন। কিন্তু নতুনদের মধ্যে ছদ্মবেশে যদি হাইব্রিডরা আসে এবং যারা প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষতি করতে পারে তারা যদি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পায় তখন আমি শঙ্কিত হই, ব্যথিত হই।
আজকে এতদিন পর যখন ১৬ জুলাই এলো, তখন এ কথাটি মনে পড়ছে, সেই সময় শেখ হাসিনার পাশে কারা ছিল আর এখন নেত্রীর পাশে কারা আছে। আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তখন জেলে, ড. হাছান মাহমুদ, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, সাহারা খাতুনরা সেদিন যা করেছেন, তা প্রশংসনীয়। তা ছাড়া প্রয়াত ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক আওয়ামী লীগের লোক না হয়েও শেখ হাসিনার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। অন্যদিকে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামরা শেখ হাসিনাকে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেওয়ার মতো দায়িত্বহীন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। আজ এতদিন পর এসে আমি বলছি, বর্তমানে বঙ্গবন্ধুর দল এবং তার দলের সরকার নতুনভাবে সাজানো দরকার। যোগ্য, আদর্শবান এবং পরীক্ষিতদের শেখ হাসিনার চারপাশে বড্ড প্রয়োজন।
লেখক: সভাপতি, কমিউনিটি ক্লিনিক
স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট