যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং ২০২৪ সালের রিপাবলিকান নমিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করে আহত করার ঘটনায় আরও একবার প্রমাণ হলো, রাজনীতিতে যখন দুটি দলের মধ্যে মতভেদ চরমে পৌঁছে, তখন সহিংসতা আশ্রয় হয়ে ওঠে এবং কেউ কেউ এতটাই সহিংস হয়ে ওঠে যে, নিজের জীবনকেও তোয়াক্কা করে না। শুধু তৃতীয় বিশ্বেই নয়, ধনী ও গণতন্ত্র চর্চায় সর্বোচ্চ প্রস্তুত ও গণতন্ত্রের প্রবক্তা দেশগুলোর ক্ষেত্রেও একই রকম দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেট দলের মধ্যে বিতর্ক, মতভেদ, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নতুন কিছু নয়। কিন্তু ইতিহাস থেকে দেখা গেছে, ব্যবধান যখন চরমে পৌঁছে তখন তা সহিংসতায় রূপ নেয়, অস্ত্রের নল থেকে বেরিয়ে আসে বুলেট। আমেরিকার রাজনীতিতে এমন রাজনৈতিক পরিবেশের ওঠানামা দেখা গেছে বহুবার, বহুভাবে। দেখা গেছে, ক্ষুব্ধ কেউ প্রেসিডেন্টকে হত্যা করতে উদ্ধত হয়ে উঠেছে। সে আলোচনায় যাওয়ার আগে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রেসিডেন্টকে হত্যা এবং হত্যাচেষ্টার কিছু ঘটনাবলী সংক্ষেপে একটু আলোচনা করে নেওয়া উচিত।
আধুনিক আমেরিকার ইতিহাসে প্রথম ১৮৩৫ সালে প্রেসিডেন্টকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। অবশ্য সে হত্যা প্রচেষ্টা রাজনৈতিক ছিল না। রিচার্ড লরেন্স নামে একজন কর্মহীন রংমিস্ত্রি প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রিউ জ্যাকসনকে হত্যার উদ্দেশ্যে ওয়াশিংটনের একটি শেষকৃত্যানুষ্ঠানে অপেক্ষা করতে থাকেন দুই হাতে দুই পিস্তল লুকিয়ে। প্রেসিডেন্ট সামনে আসেতই তিনি গুলি করেন, কিন্তু তখনকার আমলের পিস্তল তো, দুটি গুলিই মিস হয়। লরেন্স ছিলেন বদ্ধ মানসিক রোগী। লরেন্স বিশ্বাস করতেন, তিনি হচ্ছেন ব্রিটিশ রাজা তৃতীয় রিচার্ড। ব্রিটেনের দুটি রাজ্যের মালিক। বিশ্বাস করতেন আমেরিকার ব্যাংক তার কাছে অনেক দেনা এবং তিনি টাকাটা পাচ্ছেন না এই প্রেসিডেন্ট জ্যাকসনের কারণে। প্রেসিডেন্ট মারা গেলেই ভাইস প্রেসিডেন্ট তাকে টাকা দিয়ে দেবেন। তবে জ্যাকসন মানসিক রোগীর হাত থেকে বেঁচে গেলেও বাঁচতে পারেননি যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন। এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল ১৮৬৫ সালে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পর। লিঙ্কন ওয়াশিংটনে একটি মঞ্চে ‘আওয়ার আমেরিকান কাজিন’ নামে একটি নাটক দেখছিলেন। অতর্কিতে জন উইলকিস বুথ নামে একজন নাট্যাভিনেতা তাকে কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করেন। জন বুথ ছিলেন দাসপ্রথা বিলুপ্তির বিরুদ্ধে। ১৪ এপ্রিল আব্রাহাম লিঙ্কন নিহত হন। জন উইলকিস পালিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু ১২ দিন পর ধরা পড়েন এবং সার্জেন্ট বোস্টন করবেট তাকে গুলি করে হত্যা করেন। এর ১৬ বছর পর ১৮৮১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেমস এ গারফিল্ডকে ওয়াশিংটনে একটি রেলস্টেশনে চার্লস জে গিতি নামে এক রাজনৈতিক কর্মী গুলি করেন। গারফিল্ড আহত হন এবং দুই মাস পর ক্ষত থেকে ইনফেকশনে মারা যান। চার্লস জে গিতিকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল।
এর ঠিক ২০ বছর পর ১৯০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ২৫তম প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম ম্যাককিনলিকে কাছ থেকে পেটের ওপর গুলি করে হত্যা করেন লিওন এফ চোলগোশ নামে এক এনার্কিংজমে বিশ্বাসী মেধাবী ব্যক্তি। প্রচলিত শাসনব্যবস্থায় তার বিশ্বাস ছিল না। তাকে যখন ফাঁসির হুকুম দেওয়া হয় এবং আপিল করার সুযোগ দেওয়া হয়, চোলগোশ আপিল করতে অস্বীকার করেন। ফাঁসির আগে যাজকরা তাকে ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা চাইতে অনুরোধ করেন। প্রায় এক ঘণ্টা। তিনি তাদের দিকে ফিরেও তাকান না। অবশেষে তার ভাই যখন প্রবেশ করে অনুরোধ জানান, তখন তিনি বলেন, ‘এসব আজেবাজে ধর্মব্যবসায়ীরা যেন আমার কাছে না আসে।’ ১৯৬৩ সালে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডিকে খোলা জিপে স্ত্রীকে নিয়ে যাওয়ার সময় গুলি করেন লি হারভি অসোয়াল্ড। একটি ভবনের ছয়তলা থেকে তিনটি গুলি করলে কেনেডির মাথায় দুটি গুলি লাগে এবং তিনি নিহত হন। এ ছাড়া ১৯১২ সালে প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্টকে, ১৯৩৩ সালে ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টকে, ১৯৫০ সালে হ্যারি এস. ট্রুম্যানকে, ১৯৭৫ সালে জেরাল্ড ফোর্ডকে এবং ১৯৮১ সালে রোনাল্ড রিগ্যানকে হত্যাচেষ্টা করা হয়। কিন্তু অনেকটা কাকতালীয়ভাবেই তারা বেঁচে যান।
বলছিলাম যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে শান্ত সময় ও উত্তপ্ত হয়ে ওঠার সময় নিয়ে। বর্তমান সময়ের দিকে তাকালেই ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। ২০০৮ সালে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন অ্যারিজোনার রিপাবলিকান দলের সিনেটর জন ম্যাককেইন এবং ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিসেবে ইলনয়ের সিনেটর বারাক ওবামা। ম্যাককেইন অত্যন্ত সজ্জন মানুষ ছিলেন। উল্লেখ্য, তার সাত সন্তানের মধ্যে একজন পালিত। মেয়েটিকে তিন মাস বয়সে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যান তিনি। ম্যাককেইন তার এ মেয়ে ব্রিজিতকে সবচেয়ে বেশি ভালো বাসতেন। যাই হোক, সে নির্বাচনে ওবামা জয়লাভ করেন। বলা যায় ওবামার ক্যারিশমার কাছে হেরে যান ম্যাককেইন। আবার ২০১২ সালে বারাক ওবামার বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট পদে রিপাবলিকান দল থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের গভর্নর মিট রমনি। সেটা ছিল এক দেখার মতো গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতা! যখন প্রেসিডেন্সিয়াল ডিবেট হয়, তখন কেউ কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা তো দূরের কথা, সাধারণ ভদ্রতাতেও কারও কোনো কার্পণ্য ছিল না। একে অন্যের সঙ্গে করমর্দন করা, একের কথার সময় অন্যজন মন দিয়ে শোনা এবং কখনো কখনো একজন আরেকজনকে সম্মতি জানানো ছিল তাদের পরিবেশ। তাদের বিতর্কের বিষয় ছিল আমেরিকার অর্থনীতি, আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি এসব। কিন্তু এ ধারা যুক্তরাষ্ট্রে অনেক দিন পর প্রথম নষ্ট করেন হিলারি ক্লিনটন এবং সেটা শুরু হয় ডেমোক্রেট দলের নমিনেশনের প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়েই। তিনি বারাক ওবামাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ শুরু করেন। বারাক ওবামার জন্ম নিয়েও কটাক্ষ করা ছাড়েননি। পরিণত মাথার রাজনীতিবিদ ওবামা এই হিলারিকে তার প্রথম দফা নির্বাচনে জয়ের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী বানিয়েছিলেন। এরপর ২০১৬ সালে যখন হিলারি ডেমোক্র্যাট মনোনয়ন নিয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, তখন থেকেই আমেরিকার রাজনীতির বিভক্তি আবার বাড়তে থাকে, মান আরও কমতে থাকে। দুই প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর অসহিষ্ণুতা জনগণকেও প্রভাবিত করে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুখরা বলে পরিচিতি আছে। কিন্তু হিলারিও কম যান না। যখন একটি বিতর্কে দুই প্রার্থীকে অনুরোধ করা হয় পরস্পর সম্পর্কে ইতিবাচক কিছু বলতে, তখন হিলারি আগেভাগে মাইক নিয়ে বলেছিলেন, তার (ট্রাম্পের) ছেলেপেলেদের আমি প্রশংসা করি। কিন্তু ট্রাম্প বলেছিলেন, আমি হিলারির ফাইটিং স্পিরিটের প্রশংসা করি, তিনি দমে যান না। ২০১৬ সালের নির্বাচনে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হন এবং সেইসঙ্গে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের মধ্যে ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি বৈরিতা শুরু হয়ে যায়। তারপর তো আমরা অনেক কিছুই দেখলাম। ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি জো বাইডেন জয়লাভের পর নির্বাচনী ফল পাল্টে দেওয়ার জন্য বিখ্যাত ক্যাপিটল হিল আক্রমণের ঘটনা ঘটল। এখন আগামী নভেম্বরের নির্বাচনে দুই দলই মরিয়া, যে করেই হোক জিততে হবে। কারণ এ নির্বাচনের ওপর শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, ইউরোপের ভাগ্যও সরাসরি জড়িয়ে গেছে। বাইডেন হেরে গেলে ন্যাটো শুধু দুর্বল হয়েই পড়বে না, এমনকি ইউক্রেনের চরম পরাজয় মেনে নিতে হবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সন্দেহ করছে, ট্রাম্প ন্যাটো থেকে বেরিয়ে যেতে পারেন। ট্রাম্প নিজেই বলেছেন, ন্যাটো সদস্য দেশগুলোকে তাদের যথাযথ ব্যয় বহন করতে হবে। এদিকে ডেমোক্রেট দলে চরম সংকট চলছে বাইডেনের প্রেসিডেন্ট হওয়ার উপযুক্ততা নিয়ে। বেশিরভাগ ডেমোক্র্যাট বাইডেনকে সরে দাঁড়াতে বলছেন সুস্পষ্ট উচ্চারণে। কিন্তু বাইডেন প্রেসিডেন্ট দৌড় থেকে সরে না দাঁড়াতে মরিয়া। যুক্তরাষ্ট্রে এমন একটি আবহ তৈরি হয়েছে যে, বাইডেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে নিশ্চিত ট্রাম্প নির্বাচিত হয়ে যাবেন। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের বিশাল একটি অংশ মনে করে, রিপাবলিকানরা ক্ষমতায় এলে আপত্তি নেই, কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প যেন কোনোক্রমেই নির্বাচিত না হন।
এমন একটি অবস্থায় ১৩ জুলাই স্থানীয় সময় সন্ধ্যায় পেলসিলভানিয়ায় একটি জনসমাবেশে ট্রাম্পকে লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়ল ২০ বছর বয়সী থমাস ম্যাথিউ ক্রুকস নামে একটি ছেলে। সে নাকি রিপাবলিকান দলের সদস্যও। ট্রাম্প কাকতালীয়ভাবে বেঁচে গেছেন, আমরা যাকে বলি আল্লাহ বা ভগবান বা ঈশ্বর বাঁচিয়েছেন। ২০০ মিটার দূরে একটি টিনের ছাদের ওপর থেকে এআর স্টাইল সেমি-অটোমেটিক রাইফেল দিয়ে গুলি করা হলো। একটি গুলি ট্রাম্পের কানে লেগে বেরিয়ে গেল। কয়েক সেন্টিমিটার এদিক-ওদিক হলেই ট্রাম্প নিহত হতেন। যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনী সঙ্গে সঙ্গেই ছেলেটিকে মেরে ফেলেছে। রহস্যের কোনো ক্লু নেই, কিন্তু রহস্যের গন্ধ পাই। হয়তো আমার নাকটাই খারাপ। কেন এবং কীভাবে ছেলেটি ট্রাম্পকে হত্যায় প্ররোচিত হলো, তা আর কোনোদিনও হয়তো জানা যাবে না। ঘটনার জন্য একমাত্র দায়ী, একমাত্র স্বীকারোক্তি দেওয়ার মতো মানুষটি এখন চিরকালের জন্য স্তব্ধ!
লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক