গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকার ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম চূড়ান্ত হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও তিন বাহিনী (সেনা, নৌ ও বিমান) প্রধানের সঙ্গে আলোচনায় ড. ইউনূসের নাম চূড়ান্ত হয়। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম প্রস্তাব করা হয়। সেই প্রস্তাবে সায় দেন শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. ইউনূস। এ বিষয়ে তিনি বলেছেন, ‘যে শিক্ষার্থীরা এত ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তারা যখন এ কঠিন সময়ে আমাকে এগিয়ে আসার অনুরোধ করেন, তাহলে আমি কীভাবে তা প্রত্যাখ্যান করি?’
ড. মুহাম্মদ ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা এবং ক্ষুদ্রঋণ ধারণার প্রবর্তক। তিনি এবং তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। তিনি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এ পুরস্কার লাভ করেন। ড. ইউনূস বিশ্ব খাদ্য পুরস্কারসহ আরও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের পক্ষে বিদেশে জনমত গড়ে তোলা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা প্রদানের জন্য সাংগঠনিক কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি অধ্যাপক পদে উন্নীত হন এবং ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত এ পদে কর্মরত ছিলেন।
ড. ইউনূস দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম শুরু করেন ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত দুর্ভিক্ষের সময়। তিনি বুঝতে পারেন স্বল্প পরিমাণে ঋণ দরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নয়নে অত্যন্ত কার্যকরী হতে পারে। সেই সময়ে তিনি গবেষণার লক্ষ্যে গ্রামীণ অর্থনৈতিক প্রকল্প চালু করেন। ১৯৭৪ সালে তেভাগা খামার প্রতিষ্ঠা করেন, যা সরকার প্যাকেজ প্রোগ্রামের আওতায় অধিগ্রহণ করে।
মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৭৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন গরিব বাংলাদেশিদের মধ্যে ঋণ দেওয়ার জন্য। তখন থেকে গ্রামীণ ব্যাংক ৫ দশমিক ৩ মিলিয়ন ঋণগ্রহীতার মধ্যে ৫ দশমিক ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ প্রদান করে। ঋণের টাকা ফেরত নিশ্চিত করার জন্য গ্রামীণ ব্যাংক ‘সংহতি দল’ পদ্ধতি ব্যবহার করে।
দেশ ও জাতির প্রয়োজনে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২০০৭ সালে একবার রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। ওই বছর ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি দেশের মানুষের উদ্দেশে খোলা চিঠি দিয়েছিলেন। সে চিঠিতে তিনি নিজের রাজনীতি সম্পর্কে পরামর্শ ও সহযোগিতা কামনা করেন। সে চিঠিতে তিনি বলেন, নতুন রাজনীতি সৃষ্টির জন্য প্রচণ্ড উদ্যোগ নিতে হবে। এটি করতে না পারলে পুরোনো রাজনীতি থেকে পরিষ্কারভাবে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে না।
খোলা চিঠিতে তিনি আরও উল্লেখ করেছিলেন, ‘আল্লাহর অসীম রহমতে আমি এক অতিশয় ভাগ্যবান মানুষ। আমার পাওয়ার আর কিছু অবশিষ্ট নেই। আমি জানি, রাজনীতিতে জড়িত হওয়া মানে বিতর্কিত হওয়া। আপনার যদি মনে করেন, আমার রাজনীতিতে আসাটা দেশে নতুন রাজনৈতিক পরিমণ্ডল রচনায় সহায়ক হবে, তবে আমি তার জন্য এ ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত আছি।’ পরে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে তিনি তার অবস্থান পরিবর্তন করেছিলেন। দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণে সম্মতি জ্ঞাপন করায় সারা দেশের মানুষের মতো আমরাও ড. ইউনূসকে স্বাগত জানাই। আমরা বিশ্বাস করি, তার যোগ্য নেতৃত্বে দেশ ও দেশের মানুষ বর্তমান দুরবস্থা থেকে মুক্তি পাবে।