প্রভাষক মাহমুদ সাকী
প্রকাশ : ১৭ আগস্ট ২০২৪, ০২:১৭ এএম
আপডেট : ১৭ আগস্ট ২০২৪, ০৮:২৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আমাদের নদীগুলো কি এভাবেই বিলীন হবে

আমাদের নদীগুলো কি এভাবেই বিলীন হবে

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এর অন্য নাম ভাটির দেশ। ভাটি বলতে উজান থেকে আসা অববাহিকাময় ভূমিকে বোঝায়। নদীই বাংলাদেশ ভূখণ্ডের জন্মদাতা ও ভাগ্যনিয়ন্তা; এ ভূখণ্ডে বসবাসরত তাবৎ প্রাণিকুল ও মানুষের জীবনের আশীর্বাদ ও অভিশাপ উভয়ই এই নদী। ভূখণ্ড সৃষ্টি ও মনুষ্যবসতির প্রারম্ভকাল থেকে এ দেশের ভূ-প্রকৃতি, সভ্যতা-সংস্কৃতি ও জীবন-জীবিকার ধারক-বাহক নদী। এ ভূমির জন্ম ইতিহাসের সঙ্গে মানুষ ও নদীর আজন্ম আত্মিক সম্পর্ক। তবে বর্তমানে একপাক্ষিকভাবে মানুষ এ সম্পর্ক ছিন্ন করতে চলেছে। ভুলে যেতে বসেছে নিজেদের এই আত্মিক বন্ধন।

বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে একসময় খাল-বিল আর নদীনালায় ভরপুর ছিল। ছিল শব্দটি বলার কারণ হলো, এখন আর তা আগের মতো নেই, যা আছে তা আগের তুলনায় এক প্রকার না থাকারই মতো। আমাদের ছোটবেলায় সৈয়দ শামসুল হকের ‘আমার পরিচয়’ নামে একটা দারুণ কবিতা পড়েছি স্কুলে। সেই কবিতার একটা লাইন এখনো মনে গেঁথে আছে—‘তেরোশত নদী শুধায় আমাকে, কোথা থেকে তুমি এলে?’ আসলেই তো, আমরা প্রত্যেকেই যদি আমাদের নিজেদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করি, তবে নদীই তো প্রতিউত্তর করে। নদীই তো আমাদের বলে, তোমাদের জন্ম আমার গর্বে। আমার অস্তিত্ব জুড়ে।

আমাদের পরিচয় নদীই। বাঙালির জন্ম এই নদীর অববাহিকার পলিমাটিতেই। এর বাইরে আমাদের আর কী পরিচয় আছে! আর কী পরিচয়ইবা থাকার দরকার আছে! কবিগুরুর ছোট নদী থেকে জীবনানন্দের ধানসিঁড়ি, মাইকেলের কপোতাক্ষ থেকে হেমাঙ্গের পদ্মা ও সুরমার জল, কত কত লেখাই না আছে এই নদী নিয়ে আমাদের বাংলা সাহিত্যের ভুবনজুড়ে। পৃথিবীর আর কোনো সাহিত্যে নদী কেন্দ্র করে এত সাহিত্য লেখা আছে কি না, আমার জানা নেই।

পদ্মা নদীর মাঝি, তিতাস একটি নদীর নাম, ময়ূরাক্ষী কিংবা ইছামতী কতশত উপন্যাস আর ছোটগল্পের উপজীব্য আমাদের এ নদীগুলো। এখানে লালন যেমন মেঘনার জল পিপাসায় কাতর হয়েছেন, তেমনি হাছন রাজা হয়েছেন সুরমার জলের জন্য। উকিল মুন্সির হৃদয়জুড়ে বেজেছে ধনু ও নিতাই নদীর সুর। আব্বাসউদ্দীন গেয়েছেন—উজান গাঙ্গের নাইয়া।

নদীকে বিবেচনা করা হয় একটি জীবন্ত সত্তা হিসেবে। এর জন্মস্থান থেকে পতিত হওয়া পর্যন্ত সর্বত্র সঠিক প্রবাহ থাকাই নদীর জীবন। প্রবাহ না থাকলে স্বাভাবিকভাবেই নদীর জীবন নেই। আমাদের দেশের বর্তমান নদীগুলোর অল্পসংখ্যকেরই প্রবাহ রয়েছে। তাও এগুলো কোনোরকম সামান্য প্রবাহ নিয়েই জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। বাকিগুলোকে মৃতই বলা যায়। এই মৃত নদীগুলোও একসময় প্রবল স্রোতধারাসম্পন্ন ছিল। এখন ভূ-রাজনৈতিক, ভূ-প্রাকৃতিক ও সর্বোপরি মানুষের নির্দয় আচরণের কারণে তাদের অস্তিত্ব আজ বিলীন হওয়ার পথে। এর কোনোটি স্রোতহীন জলাধার, আবার কোনটি জলহীন ফসলি জমিতে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চলে এসব নদীর দৃষ্টান্ত প্রচুর।

ময়মনসিংহ শহরের পাশ ঘেঁষে চলা বাংলাদেশের অন্যতম একটি বৃহৎ নদী ব্রহ্মপুত্র। এটি পৃথিবীর দীর্ঘতম পথ পাড়ি দেওয়া নদীগুলোরও অন্যতম। গত শুষ্ক মৌসুমে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, এ সুবিশাল নদীটি শুকিয়ে আজ মৃতপ্রায়। প্রবাহ তো নেই, উল্টো কোনো কোনো অংশে চাষাবাদ পর্যন্ত হচ্ছে। একই অবস্থা জেলার সুতিয়া, বানার ও নেত্রকোনা অঞ্চলের সোমেশ্বরী, গুমাই, ধলাই-বিসনাই, মগড়া, সিনাই, কংস, ধনু ও নিতাই নদীর।

রাজশাহী অঞ্চলের প্রধান নদী পদ্মা। রাজশাহী শহরের পাশ দিয়ে চলা এ নদীটি ভারতের ফারাক্কা বাঁধের ফলে আজ মরতে বসেছে প্রায়। একই সঙ্গে পদ্মার পাশাপাশি মরছে এর ওপর নির্ভরশীল আরও অন্তত শখানেক ছোট-বড় নদী। অঞ্চলের মহানন্দা, আত্রাই, বরাল, নারদ, সন্ধ্যা, স্বরমঙ্গলা, দয়া, বারাহী, হোজা, নবগঙ্গা, নন্দকুজা, চিনার কূপ ও মুসাখান ইত্যাদি ছাড়াও আরও বহু নদী আজ বিলীন হওয়ার পথে। এসব নদীর প্রধান পানির উৎস ভারতের গঙ্গা নদী। অঞ্চলটি যেহেতু ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী, স্বাভাবিকভাবেই ফারাক্কার সম্পূর্ণ প্রভাব এগুলোর ওপর পড়েছে। অচিরেই যদি রাজনৈতিক সমঝোতা নিশ্চিত করা না যায়, তবে এসব নদী খুব দ্রুতই হারিয়ে যাবে আমাদের মানচিত্র থেকে।

চট্টগ্রাম-সিলেটের অবস্থাও প্রায় একই। টিপাইমুখ বাঁধের ফলে সিলেট অঞ্চলের নদীগুলো তো প্রায় বিলীন হতে চলছেই, সঙ্গে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের নদীগুলোর অবস্থাও করুণ। চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়া উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ইছামতী নদীটি বিগত কয়েক বছর ধরেই শুষ্ক মৌসুমে পানিশূন্য হয়ে পড়ে। অথচ ভারতের ত্রিপুরায় জন্ম নেওয়া এ নদীটি চার দশক আগেও ছিল উত্তাল ও যৌবনোদ্দীপ্ত। কিন্তু আজ তা বিগতযৌবনা। এ অঞ্চলের অন্যতম দুটি প্রধান নদী হলো হালদা ও কর্ণফুলী। এ নদী দুটিতে যদিও অঞ্চলের অন্যান্য নদীর তুলনায় পানির প্রবাহ সামান্য পরিমাণে থাকে কিন্তু তাতে শিল্পবর্জ্যের অবাধ নিঃসরণের দরুন নদী দুটির জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির মুখে। এ ছাড়া সাঙ্গু, মাতামুহুরী, বাঁকখালী, কাসালং, নাফ, মাইনী, চেঙ্গী, ধুরং, শুভলং, রেখিয়াং ও থেগাসহ অন্যান্য আরও বহু ছোট-বড় নদী জলাভাবে আজ বিলীন হওয়ার পথে।

ভারতের নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তৎকালীন সরকারপ্রধান গত ২২ জুন বাংলাদেশ-ভারতবিষয়ক ১০টি যৌথ অংশীদারত্ব চুক্তি সমঝোতা স্বাক্ষর করে। কিন্তু এই দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে যৌথ রেল যোগাযোগ, ভারত কর্তৃক মোংলা বন্দর ব্যবহার, দুই দেশের শিক্ষা ও সমন্বিত রূপকল্পের অংশীদারত্বসহ নানা ইস্যু চুক্তিতে থাকলেও তিস্তাসহ অন্যান্য অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন নিয়ে কোনো চুক্তিই স্বাক্ষরিত হয়নি। উভয় দেশের এই দুই প্রধানের এ বৈঠককে কেন্দ্র করে বিশেষ করে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ আশা করেছিল অন্তত পানিবণ্টন বিষয়টি হয়তো নতুন করে গুরুত্ব পাবে। কিন্তু তা না হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই মানুষ আশাহত হয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান ভৌগোলিক বাস্তবতার নিরিখে চিন্তা করলে স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায় তিস্তাসহ অন্যান্য অভিন্ন নদীর পানির একটি কার্যকরী চুক্তি এই মুহূর্তে ঠিক কতটা প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদিকে ২০২৬ সাল নাগাদ আগের ৩০ বছরমেয়াদি গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তিটির মেয়াদ শেষ হতে চলেছে। যদিও আগের এ চুক্তি কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থেকে এসেছে এতদিন। ভারত এ চুক্তির কোনো ধারাই সম্পূর্ণরূপ পালন করেনি। একদিকে যখন পানির প্রয়োজন হয় শুষ্ক মৌসুমে, তখন তারা পর্যাপ্ত পানি না দিয়ে আমাদের ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করে আবার অন্যদিকে বর্ষাকালে বাঁধ ছেড়ে দিয়ে আমাদের বন্যায় ডুবিয়ে দেয়। ফলে আমাদের উত্তরাঞ্চলের ফসলাদির যে ক্ষতি তা সারা বছরই সাধন হয়। এক মৌসুমে হয় পানির অভাবে খরা হয়ে, আরেক মৌসুমে হয় কৃত্রিম বন্যার কবলে পড়ে। এরই মধ্যে শোনা যাচ্ছে, বরেন্দ্র অঞ্চলসহ গোটা উত্তরবঙ্গজুড়েই ভূগর্ভস্থ পানির অভাব দেখা দিয়েছে। দুই দশক আগেও যেখানে ৫০-৬০ ফুট নিচে গেলে পানি পাওয়া যেত সেখানে এখন পানির স্তর এতটাই নেমে গেছে যে, দুইশ-তিনশ ফুটেও পানির নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব তো পড়ছেই, সেইসঙ্গে উষ্ণতা বৃদ্ধি ও প্রয়োজনীয় সুপেয় পানির অভাবে অঞ্চলটিতে বসবাস করা এখন দুরূহ হয়ে পড়েছে। জীবন-জীবিকা আজ প্রচণ্ড রকম হুমকির মুখে।

সর্বোপরি বলতে গেলে নদীমাতৃক এ দেশটির প্রাকৃতিক অবস্থা সত্যিকার অর্থেই আশঙ্কাজনক। আমরা যদি অচিরেই আমাদের নদীর জীবন ও সুরক্ষা নিয়ে যত্নবান না হই, যত্রতত্র শিল্পবর্জ্য নিক্ষেপের রাশ টেনে না ধরি, সুপরিকল্পিতভাবে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদী শাসন করাসহ অভিন্ন নদীগুলোর ন্যায্য পানিবণ্টনবিষয়ক আলোচনার অগ্রগতি না করি, তবে নানান প্রতিকূল পরিবেশে পড়া ছাড়া আমাদের আর কোনো গত্যন্তর নেই। একদিকে যেমন দক্ষিণাঞ্চলে সাগর জলের উচ্চতা বৃদ্ধি আমাদের চোখ রাঙাচ্ছে, অন্যদিকে উত্তরাঞ্চলের জলাভাব ভূমিকে পরিণত করছে মরূদ্যানে। মধ্যভাগের নদীগুলোর ওপর তো শিল্পের দূষিত বর্জ্য রয়েছেই। ফলে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে এক ভয়ানক সংকট। ঊর্ধ্বতন মহলের কাছে অনুরোধ থাকবে, এই দেশের স্বাভাবিক জীবনধারা ও ভূ-ভাগটাকে টিকিয়ে রাখার নিমিত্তে অচিরেই আমাদের নদীগুলোকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করুন।

লেখক: শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী

ইতিহাস ও সভ্যতা ডিসিপ্লিন

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

এক বলের আঘাতেই অনিশ্চিত তিনটি ক্লাবের ভবিষ্যৎ

মহররমে নিরাপত্তায় পাকিস্তানে সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত

মেয়াদোত্তীর্ণ ভিসাধারীদের খুশির খবর দিল সৌদি আরব

পঙ্গুত্বের অন্ধকারে পুলিশ সদস্য আলাউদ্দিন, পেশাদারিত্ব নিয়ে প্রশ্ন

কাশ্মীর ইস্যুতে সই করেনি ভারত

ঝুঁকি নিয়ে চলাচল, বাড়ছে দুর্ঘটনা

সীমান্তঘেঁষা নদী থেকে নারীর লাশ উদ্ধার

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ালেন উমামা ফাতেমা

খামেনির সঙ্গে অশোভন আচরণ বন্ধ করুন, ট্রাম্পকে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী

নিজ বাড়িতে ইউপি সদস্য ও ভাবিকে কুপিয়ে হত্যা

১০

ঢাকার আকাশ আজ কেমন থাকবে

১১

ইরানকে আবার হুঁশিয়ারি ট্রাম্পের

১২

টিভিতে আজকের খেলা

১৩

দুপুরের মধ্যে ৭ জেলায় ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের শঙ্কা

১৪

১২ পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে পারে ইরান : আইএইএ

১৫

ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে ট্রাম্প সত্যিই আগ্রহী: পুতিন

১৬

শনিবার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

১৭

মুন্সীগঞ্জে বাস-ট্রাক সংঘর্ষে নিহত ৪

১৮

২৮ জুন : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৯

ভারতে আরও এস-৪০০ সরবরাহ নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা

২০
X