আজ ৯ আগস্ট। ১৯৪৫ সালের আজকের দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। এদিন জাপানের নাগাসাকি শহরে ‘ফ্যাট ম্যান’ নামে পরিচিত দ্বিতীয় পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করা হয়।
১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত চলমান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সংঘটিত করে হিটলারের নাৎসি বাহিনী তথা জার্মানি ১৯৪৫ সালের ৮ মে তারিখে মিত্রশক্তির কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। তবে মিত্রদের বিপক্ষে লড়াই করা অক্ষশক্তির অন্য দেশ জাপান যে কোনো মূল্যে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে ছিল বদ্ধপরিকর। শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে জাপানিরা নিজ ভূখণ্ডে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয় এবং যে কোনো বহিঃশত্রু আক্রমণের কড়া জবাব দেওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। এর বিপরীতে জাপানকে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে মিত্রবাহিনীর অন্যতম শক্তি আমেরিকা ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট জাপানের হিরোশিমা শহরে লিটল বয় নামের পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করে ও বিস্ফোরণ ঘটায়। এতেও দমেনি জাপানিরা। এরপর মিত্রশক্তির পরবর্তী টার্গেট নির্ধারিত হয় জাপানের নাগাসাকি শহর।
১৯৪৫ সালে নাগাসাকি ছিল জাপানের দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় সমুদ্র বন্দর ও শিল্পাঞ্চল। এ নাগাসাকিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্র, গোলাবারুদ, যুদ্ধ সরঞ্জাম, যুদ্ধজাহাজ ইত্যাদি সামগ্রী প্রস্তুত করা হতো। যুদ্ধকালে রাতের বেলা নাগাসাকির আলো নিভিয়ে রাখা হতো। এর ফলে মিত্রবাহিনীর রাডার রাতের বেলায় নাগাসাকির স্থাপনাগুলোর সঠিক অবস্থান নির্ণয়ে সমস্যার সম্মুখীন হতো। এ কারণে মিত্রবাহিনীর পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের প্রাথমিক লক্ষ্যবস্তু নির্বাচনে নাগাসাকির নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল না। পরে সামরিক গুরুত্বের বিষয় বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত হয় যে, কোনো কারণে অন্য কোনো লক্ষ্য বস্তুকে বোমাবর্ষণ সম্ভব না হলে বিকল্প লক্ষ্যবস্তু হিসেবে নাগাসাকিতেই সাংকেতিক ‘ফ্যাট ম্যান’ নামে পরিচিত দ্বিতীয় পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করা হবে। ১০ আগস্ট, ১৯৪৫ তারিখ থেকে টানা পাঁচ-ছয় দিন আবহাওয়া প্রতিকূলে থাকার পূর্বাভাস জারি করে স্থানীয় আবহাওয়া কর্তৃপক্ষ। ফলে ৯ আগস্টে এ বোমা নিক্ষেপ ও বিস্ফোরণ ঘটানোর উপযুক্ত সময় গণ্য করা হয়।
মিত্রশক্তির অধিকৃত টানিয়ান দ্বীপের বিমান ঘাঁটি থেকে ৮ আগস্ট মধ্যরাতেই যাত্রা করে ‘বক্স কার’ ছদ্মনামধারী বি-২৯ বোমারু বিমান। পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন মার্কিন বোমারু বিমানচালক মেজর চার্লস উইলিয়াম শুয়েইনি। বিমানটির এ যুদ্ধ মিশনের প্রাথমিক বা মূল লক্ষ্যবস্তু ছিল জাপানের কাকুরা শহর। তবে আধা ঘণ্টা আকাশে চক্কর দেওয়ার পরও মেঘ এবং আগের দিন পার্শ্ববর্তী ইয়াহাটা শহরে বোমাবর্ষণের কারণে সৃষ্ট আগুনের ধোঁয়ায় কাকুরা শহরটিকে ঠিকমতো দেখা যাচ্ছিল না। এদিকে বোমারু বিমান বক্স কারের জ্বালানি তেলও দ্রুত ফুরিয়ে আসছিল। জাপানিদের বিমান বিধ্বংসী কামানগুলোও এ সময় ঘন ঘন গর্জে ওঠে। এমনি একমুহূর্তে দ্বিতীয় লক্ষ্যবস্তু নাগাসাকি শহরে পারমাণবিক বোমা ফ্যাট ম্যান নিক্ষেপের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
নাগাসাকিতে তখন স্থানীয় সময় সকাল ১১টা। আকাশে মিত্রবাহিনীর যুদ্ধবিমান দেখলেও নাগাসাকির নাগরিকরা অতীতের মতো পর্যবেক্ষণের জন্যই এভাবে আকাশে বিমান উড়ছে বলে ভেবেছিল। তাই যার যার কাজে ব্যস্ত ছিল তারা। এক মিনিটের মধ্যে বিমানের পাইলট মেঘের মাঝ দিয়ে নিচে নাগাসাকি শহর দেখতে পান এবং বিমানের সঙ্গে সংযুক্ত পারমাণবিক বোমা ফ্যাট ম্যানকে অবমুক্ত বা নিক্ষেপের ব্যবস্থা করেন। মাত্র ৫৭ সেকেন্ডে তিনটি প্যারাসুটের সাহায্যে প্রায় পাঁচ কেজি প্লুটোনিয়াম (Plutonium) তেজস্ক্রিয় বিস্ফোরকসমৃদ্ধ ফ্যাট ম্যান ভূমির ১৬৫০ ফুটের মধ্যে চলে আসে এবং একটি টেনিস কোর্টের ওপর বিস্ফোরিত হয়। হিরোশিমার চেয়ে নাগাসাকিতে ধ্বংস বেশি হওয়ার কথা থাকলেও ফ্যাট ম্যান নাগাসাকির দুটি পাহাড়ের মাঝে বিস্ফোরিত হওয়ায় তা ঘটেনি। এ সময় বহু ভাসমান মানুষ, সেনাসদস্য, মৌসুমি শ্রমিক ও বিদেশি শ্রমিকের উপস্থিতি ছিল নাগাসাকিতে। এ বোমাবর্ষণের কারণে প্রকৃত প্রাণহানির তথ্য নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। তবে অধিকাংশের মতে, সেদিন নাগাসাকিতে কমপক্ষে ৬০ থেকে ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে। একই পরিমাণ মানুষ আহত হয় বলেও জানা যায়। বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে নাগাসাকিতে প্রায় ১.৬ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের একটি এলাকা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। আর ওই এলাকাসহ আশপাশের বহু এলাকায় আগুন জ্বলতে থাকে। পরবর্তী সময়ে বহু চেষ্টায় সেই আগুন নিভেছে বটে, তবে প্রতিবছর ৯ আগস্ট এলেই জাপানিদের মনে পূর্বপুরুষদের স্মৃতি যেন নতুন করে আগুন ধরিয়ে দেয়।
লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
মন্তব্য করুন