যত দ্রুত সম্ভব জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করুন। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা একটি সময়োপযোগী এবং অপরিহার্য পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে। গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং সময়মতো নির্বাচন, যা জনগণের মতামতকে প্রতিফলিত করে। তবে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ না হওয়ায় রাজনৈতিক অস্থিরতা ক্রমেই বাড়ছে।
জাতীয় নির্বাচন গণমানুষের স্বপ্ন এবং প্রত্যাশার প্রতীক। এটি কেবল একটি ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া নয়, বরং জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরুদ্ধারের সুযোগ। গণতন্ত্রের প্রতি জনগণের আস্থা পুনর্বহাল করবে। সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের উচিত দায়িত্বশীল ভূমিকা নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব একটি গ্রহণযোগ্য এবং সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা। জনগণ তাদের অধিকার প্রয়োগের জন্য প্রস্তুত, এখন প্রয়োজন সরকারের উদ্যোগ। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার মাধ্যমে সরকার জনগণের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারে। জনগণের মনে এ ধারণা সৃষ্টি হবে যে, তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে এবং তাদের অধিকার সুরক্ষিত রয়েছে।
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দেশের অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগ করতে সংকোচবোধ করছেন এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। নির্বাচনের নির্ধারিত সময় অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হতে পারে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে মতপার্থক্য ক্রমেই গভীর আকার ধারণ করছে। বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তার সাম্প্রতিক বক্তব্যে জানান, জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে।
এ ঘোষণা কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ তীব্র হয়ে উঠেছে, যেখানে বিভিন্ন দল ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান প্রকাশ করেছে। বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলোর অধিকাংশ নেতার মতে, জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করা উচিত নয়। তাদের বক্তব্য, অন্তর্বর্তী সরকারের একমাত্র দায়িত্ব হলো জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা এবং নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচন অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নয়; তাদের কাজ শুধু জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা।’
অন্যদিকে, জাতীয় নাগরিক কমিটি মনে করছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করা উচিত। তাদের যুক্তি, এটি দেশের বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে, যা নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে পর্যায়ক্রমে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়ক হবে। যদিও বাংলাদেশের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে তাদের দীর্ঘদিনের যোগসূত্র নেই।
গত বিজয় দিবসে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেন, ‘২০২৫ সালের শেষদিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যেতে পারে।’ তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘প্রধান সংস্কারগুলো সম্পন্ন করে নির্বাচন আয়োজনের জন্য বারবার আবেদন জানানো হলেও, রাজনৈতিক ঐকমত্যের অভাবে যদি কিছুটা সংস্কার করে ভোটার তালিকা নির্ভুলভাবে তৈরি করা যায়, তবে ২০২৫ সালের শেষের দিকে নির্বাচন আয়োজন সম্ভব হতে পারে। তবে যদি নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে আরও সংস্কার করা হয়, তবে অন্তত ছয় মাস অতিরিক্ত সময় লাগতে পারে।’
প্রধান উপদেষ্টার এ বক্তব্যের পর বিএনপি তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে জানায় যে, জনগণের আস্থা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ৩ জানুয়ারি, ২০২৫ তারিখে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এক সমাবেশে বলেছে, ‘প্রয়োজনীয় সংস্কারের উদ্যোগ নিয়ে দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করা উচিত।’
বিএনপি এবং তাদের মিত্র দলগুলো দাবি করেছেন যে, জাতীয় নির্বাচন যত দ্রুত সম্ভব অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত। তাদের মতে, স্থানীয় সরকার নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনকে বিলম্বিত করতে পারে, যা জনগণের ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। বিএনপি নেতা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেছেন, ‘ইতিহাসে এমন কোনো অন্তর্বর্তী সরকার ছিল না, যার অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে!’
বর্তমান সরকার দাবি করছে, তারা একসঙ্গে জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. তোফায়েল আহমেদ জানিয়েছেন, তাদের কাছে বেশিরভাগ সুপারিশ আসছে যে, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করা উচিত। কারণ, বর্তমানে অনেক স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধি না থাকায় নাগরিক সেবা প্রদান ও অন্যান্য পরিষেবা গ্রহণে নানা সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।
নেতৃবৃন্দ আশঙ্কা করছেন যে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের ফলে জাতীয় নির্বাচনের সময় পিছিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। স্থানীয় নির্বাচন একটি জটিল ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া, যা ভোটার তালিকা হালনাগাদ, সীমানা পুনর্নির্ধারণ এবং নানা ধরনের প্রস্তুতির প্রয়োজন। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব ও অশান্তি বাড়তে পারে। বিশেষত যদি এর ফলে জাতীয় নির্বাচনের নির্ধারিত সময়সীমা সংকুচিত হয়, যা দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও জনগণের আস্থা হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
বিএনপি এবং অন্যান্য বিরোধী দল মনে করেন, সরকার জনগণের মৌলিক সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয়েছে; বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে। তারা অভিযোগ করছেন যে, এসব ক্ষেত্রে অবহেলা এবং শিথিলতা সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে।
ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক অভ্যুত্থান কেবল একটি আন্দোলন নয়, এটি ছিল সাম্য, ন্যায়বিচার এবং বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি। এ আন্দোলন সমাজের প্রতিটি স্তরের শোষণ, দুর্নীতি এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে একটি নতুন দিনের আহ্বান জানিয়েছিল। গণঅভ্যুত্থানের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল এমন একটি বাংলাদেশ গড়ে তোলা, যেখানে প্রত্যেক নাগরিক তার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে পারে। শিক্ষার্থী, কৃষক, শ্রমিকসহ সব শ্রেণির মানুষ তখন একত্রিত হয়েছিল একটি বৈষম্যহীন সমাজের প্রত্যাশায়। বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্নপূরণ হয়নি। তবে দুঃখজনকভাবে সেই চেতনা ও লক্ষ্য আজ ব্যাহত হয়েছে।
বিএনপি মনে করে, একমাত্র অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমেই, রাষ্ট্র-রাজনীতি এবং রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সঙ্গে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশীদারত্ব তৈরি হয়। সুতরাং জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সংসদ এবং সরকার প্রতিষ্ঠাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সব সংস্কার কার্যক্রমের প্রথম এবং প্রধান টার্গেটও হওয়া জরুরি। এজন্যই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত জবাবদিহিমূলক সরকার এবং সংসদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকে সামনে রেখেই সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া দরকার। কারণ, জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ছাড়া, সংস্কার কার্যক্রমের প্রক্রিয়ায় জনগণের সরাসরি সম্পৃক্ততা ছাড়া, উন্নয়ন-গণতন্ত্র কিংবা সংস্কার কোনোটিই টেকসই এবং কার্যকর হয় না।
বিএনপি ঘোষিত ৩১ দফার ৭ নম্বর দফায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন যুগের সূচনা ও নির্বাচনী সংস্কারের দৃঢ় পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে, যা দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সংগ্রামের ফলস্বরূপ তৈরি হয়েছে।
দেশে একটি কার্যকর, স্বাধীন ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২’ সংশোধন করা হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত ও বিশিষ্টজনদের অভিমতের ভিত্তিতে এ উদ্যোগ নেওয়া হবে।
ইভিএম ব্যবহারের পরিবর্তে পেপার-ব্যালট পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জনগণের আস্থা নিশ্চিত করা হবে। এ ছাড়া রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইন সংস্কার করে দলগুলোর কর্মকাণ্ড স্পষ্ট ও কার্যকর করা হবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহারের প্রথা বাতিল করে ব্যক্তিগত যোগ্যতার ভিত্তিতে নেতৃত্ব নির্বাচন করা হবে।
৩১ দফা দেশের মৌলিক খাতে পরিবর্তন আনার দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়ে এগিয়ে চলেছে—যার মধ্যে গণতন্ত্রের বিকাশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক খাতে সংস্কার, মানবাধিকার সুরক্ষা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান এবং বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দৃঢ় পরিকল্পনা রয়েছে।
লেখক: সাংগঠনিক সম্পাদক
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন