লিঙ্গসমতা অর্জন ও নারীর মঙ্গল এগিয়ে নেওয়া কেবল নৈতিক কর্তব্য নয়; বরং সমৃদ্ধ অর্থনীতি এবং সুস্থ একটি পৃথিবী গড়ার ক্ষেত্রেও অপরিহার্য। তবে জাতিসংঘের মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে জেন্ডার সমতা অর্জনে প্রায় ৩৬০ বিলিয়ন ডলার বার্ষিক ঘাটতি রয়েছে, যা নারীদের জন্য বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির আহ্বান জানায়। সেই লক্ষ্যে, জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারিত এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল— ‘অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন/নারী ও কন্যার উন্নয়ন’। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের দৃষ্টান্তমূলক অগ্রগতিও আজ সারা বিশ্বে প্রশংসিত। ১৯৭৫ সাল থেকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপনের যে যাত্রা শুরু হয়েছে, সেই অগ্রযাত্রায় শামিল হয়ে বাংলাদেশও নারী উন্নয়নে অবিরতভাবে এগিয়ে চলেছে।
নারী দিবস মানেই বিশ্বজুড়ে নারীদের অসামান্য অবদান ও অর্জনগুলোকে তুলে ধরার প্রয়াস। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, জেন্ডার সমতা অর্জনে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৫৯তম, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থান অধিকার করে আছে (বৈশ্বিক জেন্ডার গ্যাপ-২০২৩-এর রিপোর্ট অনুযায়ী) (দেবনাথ, ২০২৪)।
আমরা জেন্ডার-সংবেদনশীল বাজেট প্রবর্তনকারী প্রথম দেশগুলোর অন্যতম। আমাদের মোট বাজেটের ৩০ শতাংশ নারী উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য বরাদ্দ করা হয়। দেশের সর্বস্তরের নারীর উন্নয়নে সরকার মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নানা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে, যার মূলে রয়েছে প্রযুক্তিগত স্টার্টআপ, ই-কমার্সসহ আইসিটি সেক্টরে লিঙ্গসমতা অর্জন করা। আজ জিডিপিতে নারীর অবদান ৩৪ শতাংশে পৌঁছেছে। অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নারীকে তাদের পরিবার ও সমাজ—উভয় ক্ষেত্রেই সিদ্ধান্ত গ্রহণে আরও বেশি ভূমিকা রাখতে সক্ষম করেছে (জামান, ২০২৩)। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, কর্মক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তিতে প্রায় ১৫ শতাংশ নারী কাজ করছেন। ইন্টারনেটভিত্তিক মুক্ত পেশা ফ্রিল্যান্সিংয়ে বাংলাদেশের নারীরা বৈশ্বিক পর্যায়ে শীর্ষস্থানে উঠে এসেছেন। মফস্বলের নারীরাও এখন ঘরে বসে অনলাইনে কাজ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। বর্তমানে দেশে মোট ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১০ লাখ যার ১১ শতাংশই নারী অর্থাৎ, প্রায় ৭১ হাজার ৫০০ জন নারী ফ্রিল্যান্সার বাংলাদেশ থেকে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে কাজ করছেন। আবার মোট উদ্যোক্তাদের শতকরা ৩১ দশমিক ৬১ শতাংশ নারী (বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা, ২০২২)। আরও আশাব্যঞ্জক চিত্র হিসেবে দেখা যায়, বাংলাদেশের সাতটি বিভাগের ১৬টি জেলার ৫০ জন প্রতিবন্ধী নারী উদ্যোক্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি, ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে যুক্ত করার মাধ্যমে তাদের ব্যবসার উন্নয়ন ঘটেছে। ডিজিটাল জগতের বাইরেও বাংলাদেশের নারীদের অদম্য অগ্রযাত্রা ও ক্ষমতায়নের চিত্র বিস্মিত হওয়ার মতো। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ এখন পর্যন্ত মোট ৯৬২ জন নারীকে শান্তিরক্ষী হিসেবে জাতিসংঘের মিশনে পাঠিয়েছে, যাদের মধ্যে ৪১৫ জন বর্তমানে বিভিন্ন মিশনে কর্মরত আছেন।
গত কয়েক বছরে, যদিও বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর উন্নয়ন আমাদের দৃষ্টি কেড়েছে, তবুও, ম্লান হয়ে যায়নি নারীর প্রতি বৈষম্যের চিত্র। এই বৈষম্যকে দূর করতে প্রয়োজন সমাজের কিছু কাঠামোগত পরিবর্তন আনা, যার মূল ভিত্তি হবে নারীর উন্নয়নে বিনিয়োগ। এই বিনিয়োগ মানে শুধু জেন্ডার বাজেট নয়। সমতা বিধানের ক্ষেত্রে যে ব্যবধান রয়েছে, তা চিহ্নিত করে, সেগুলো পরিবর্তনের লক্ষ্যে বিনিয়োগ করতে হবে। এর জন্য একটি সুনির্দিষ্ট রূপরেখা তৈরি করতে হবে। যুগের পর যুগ নারীরা পরিবার থেকেই প্রথমে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। মেয়েকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার ক্ষেত্রে বাব-মা-ই প্রধান ভূমিকা রাখে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্যই নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করেছে। একদিকে যেমন মেয়েদের প্রতি বৈষম্যকে বৈধতা দানের মাধ্যমে আমাদের সমাজে অসমতা জেঁকে বসেছে, অন্যদিকে পুরুষের ওপর সক্ষমতার চেয়ে বেশি দায়িত্ব দেওয়ার ফলে নারী-পুরুষের মাঝে বিদ্যমান স্বাভাবিক জেন্ডার রিলেশনশিপ-ডায়নামিক্সের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। দেশে বর্তমানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ পুরুষের চেয়েও বেশি। কিন্তু উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় নারীরা অনেক পিছিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে নারী শিক্ষার্থী মাত্র ৩৬ শতাংশ। অন্যদিকে, বিজ্ঞান ও গবেষণায় নারীর অংশগ্রহণ ২৮ শতাংশ হলেও দেখা যায়, গবেষণায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন মাত্র ১৭ শতাংশ নারী। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের সব স্টেম পেশাজীবীর মধ্যে নারীর সংখ্যা মাত্র ১৪ শতাংশ। সুতরাং, বলার অপেক্ষা রাখে না যে, খুব বেশি সংখ্যক নারী গতানুগতিক বিষয়গুলোর বাইরে গিয়ে আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক ক্ষেত্রগুলোয় সঠিক শিক্ষা, দক্ষতা ও প্রশিক্ষণের অভাবে কাজের সুযোগ পাচ্ছে না।
এ ছাড়া, রাজনৈতিক অঙ্গনে নারীর পদচারণা লক্ষ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোয় কমপক্ষে ৩৩ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ আবশ্যক হওয়া সত্ত্বেও আশানুরূপ সংখ্যায় নারীর উপস্থিতি দেখা যায় না। কেননা রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য তার হাতে যে পরিমাণ অর্থ থাকা দরকার, তা নারীর কাছে নেই। তৃণমূলের রাজনীতিতে অংশ নিতে নারীরা শতভাগ প্রস্তুত হলেও উচ্চপর্যায়ে যাওয়ার মতো পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও সামর্থ্য তার নেই। যে কোনো ক্ষেত্রেই নারীর পিছিয়ে পড়ার কারণ উদ্ঘাটনের চেষ্টা করলে আমরা দেখতে পাই, এর মূলে হয়েছে নারীর প্রতি সহিংসতা, বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন ও যৌন হয়রানির করুণ চিত্র। এ ছাড়া তথ্য-উপাত্ত বলছে, পর্যাপ্ত আইন থাকা সত্ত্বেও তার যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ায় সহিংসতা নিরসনের বদলে ভিন্ন মাত্রায় ভিন্ন আঙ্গিকে অনেক ক্ষেত্রেই তা বেড়ে চলছে, যার উদাহরণস্বরূপ চোখে পড়ে প্রতিনিয়ত বেড়ে চলা—সাইবার সহিংসতা ও নির্যাতন, যা নারীর সব অর্জনকে ম্লান করে দেয়।
উপরন্তু, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নারীদের ওপর অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে প্রভাব ফেলে এবং নারীর প্রতি বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তোলে। নারীরা প্রায়ই নিম্ন বেতনের কাজে নিয়োজিত থাকে এবং অবৈতনিক পরিচর্যার কাজের বোঝা বহন করে। অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণও সীমিত। এত কিছুর পর এই নারীদের সফলতা একদিকে যেমন তার সক্ষমতার প্রকাশ, অন্যদিকে তার অফুরন্ত প্রাণশক্তি ও অসীম সম্ভাবনার কথা সবার সামনে উন্মোচন করে। বাংলাদেশের সব অর্জনের পেছনে নারীদের অবদান কোনো অংশে কম নয়; বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী।
নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করতে ও টেকসই উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে কার্যকর উদ্যোগ হচ্ছে নারীর জন্য বিনিয়োগ বাড়ানো। তবে, বাংলাদেশের সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে প্রশ্ন জাগে—নারীর উন্নয়নে বিনিয়োগ বলতে কীসের বিনিয়োগ, বা, কোন খাতে বিনিয়োগ বোঝাচ্ছে। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক—প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিনিয়োগ প্রয়োজন; কিন্তু স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে এই বিনিয়োগ হতে হবে এক ভিন্ন আঙ্গিকে:
l অর্থনৈতিক বিনিয়োগের পাশাপাশি দরকার নৈতিকতায় বিনিয়োগ।
l পুথিগত শিক্ষার পাশাপাশি প্রয়োজন মানবিক শিক্ষায় বিনিয়োগ ।
l গৃহস্থালি বা ঘরের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রয়োজন অবৈতনিক সেবামূলক কাজের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ।
l সংখ্যাগত উন্নয়নের পাশাপাশি প্রয়োজন গুণগত উন্নয়নের লক্ষ্যে বিনিয়োগ।
l সময় এসেছে, গবেষণাভিত্তিক আইন প্রণয়ণের।
l সময় এসেছে, খতিয়ে দেখার যে—নারীর প্রতি সহিংসতার মাশুল কেবল নারীকে বহন করতে হচ্ছে এমনটি নয়; বরং এই সহিংসতা সার্বিক উৎপাদনের হারকেই ক্রমান্বয়ে হ্রাস করছে কি না।
আমাদের মনোযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলো গবেষণা এবং জ্ঞান সৃষ্টি। একবিংশ শতাব্দীতে একটি জাতির উন্নতির জন্য, গবেষণা ও উন্নয়নে যথেষ্ট বিনিয়োগকে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। নারী সম্পর্কিত বিষয়গুলোর ওপর গবেষণাকে অগ্রাধিকার দিয়ে, আমরা তাদের ক্ষমতায়নে অবদান রাখতে পারি এবং আমাদের জাতিকে জ্ঞান উৎপাদনের অগ্রভাগে রাখতে পারি। নারীদের দ্বারা সম্পাদিত গৃহস্থালির কাজসহ সব সেবা বিনিয়োগ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পরিমাণগত অবকাঠামোগত উন্নয়নের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, দেশের নির্দিষ্ট খাতে গুণগত উন্নতির জন্য বিনিয়োগ প্রয়োজন। দুঃখজনকভাবে, নারীর বিরুদ্ধে প্রায় সব ধরনের সহিংসতা এখনো আমাদের সমাজে অব্যাহত রয়েছে, যা মানবিক ও অর্থনৈতিক উভয় ক্ষেত্রেই ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হলে আগামী দিনে এমন ঘটনার সাক্ষী হতে হবে, যা আমাদের কারও কাম্য নয়।
নারীর অধিকার, মর্যাদা এবং অবদানের প্রতি সম্মান আলোচনার বিষয় নয় কারণ এটি একটি মৌলিক নীতি, যা আমাদের একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের পথে পরিচালিত করবে। ‘সবার জন্য এক বিশ্ব’ এর দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করার জন্য বৈষম্য, অবিচার দূর করা এবং মানব মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন।
আমাদের বুঝতে হবে, নারীর ক্ষমতায়ন ,সমতা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠাপূর্বক একটি বাংলাদেশ বিনির্মাণে আরও সক্রিয় ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। Gender Inequality থেকে Gender Parity এর দিকে অগ্রসর হতে হবে। কারণ আমরা স্বপ্ন দেখি একটি বিকল্প সমাজ ব্যবস্থার যেখানে পুরুষ নারীর প্রতিযোগী নয় বরং সহযোগী শক্তি হিসেবে কাজ করবে। সম্মানের সঙ্গে কোনো ধরনের আপস না করে, মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ তৈরির মাধ্যমে নারী পুরুষের জন্য তৈরি হবে এক অভিন্ন পৃথিবী। যেখানে নারীদের জয় হবে, মানবতার জয় হবে, মানবাধিকারের জয় হবে—এই প্রত্যাশা ব্যক্ত করছি।
লেখক: অধ্যাপক, ওমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন