বিচারকদের বদলি, নিয়োগ ও শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিষয় নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণে থাকায় জনগণের মধ্যে বিচার বিভাগের প্রতি আস্থাহীনতা সৃষ্টি হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন অধস্তন আদালতের বিচারকরা। তারা সংবিধানের ২২ ও ১১৬ক অনুচ্ছেদের আলোকে বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা এবং নির্বাহী বিভাগ থেকে এর কার্যকর পৃথকীকরণের দাবি জানিয়েছেন।
বিচারকরা বলেন, সুপ্রিম কোর্টের অধীনে একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা ছাড়া বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয়।
ফরিদপুরের চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের সম্মেলন কক্ষে শনিবার (২৩ আগস্ট) বৃহত্তর ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদী জেলায় কর্মরত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের নিয়ে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন (বিজেসাএ) ‘পৃথক বিচার বিভাগ মানে স্বাধীনতা, সচিবালয় গঠনে আসবে নিশ্চয়তা’ স্লোগানকে সামনে রেখে এক গুরুত্বপূর্ণ মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। সভায় বিচারকরা এসব কথা বলেন।
সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- ফরিদপুরের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ, মো. জিয়া হায়দার। সভাপতিত্ব করেন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আমিরুল ইসলাম, বিজ্ঞ বিচারক (জেলা জজ), নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল, খুলনা। এ ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মুহাম্মদ মাজহারুল ইসলামসহ নির্বাহী কমিটির অন্য সদস্যরা।
সভায় স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি মো. ফারুক ইকবাল। বর্তমান কমিটির গৃহীত বিভিন্ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরে কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম শরিয়ত উল্লাহ গণতান্ত্রিক অ্যাসোসিয়েশন নির্বাচনের লক্ষ্যে ‘ইয়াং জাজেস ফোরাম’-এর বিশেষ ভূমিকা তুলে ধরেন।
বিচারকরা আশা প্রকাশ করেন, বর্তমান প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ বিচার বিভাগের সংস্কারে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। ২০২৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর তিনি অধস্তন আদালতের বিচারকদের উদ্দেশে প্রদত্ত অভিভাষণে বিচার বিভাগের জন্য যে ঐতিহাসিক রোডম্যাপ তুলে ধরেন, তার উদ্ধৃতি দিয়ে বিচারকরা দাবি করেন, সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ের যৌথ এখতিয়ার সম্পূর্ণরূপে বিলোপ করে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে অনতিবিলম্বে একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ ছাড়াও, ‘সুপ্রিম কোর্ট বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ, ২০২৫’ প্রণীত হয়েছে এবং প্রধান বিচারপতি নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ও জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের মতো বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেছেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় গঠনের বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং উপস্থিত সবাই সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
সভার শুরুতে বিচারকরা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদ ও আহতদের স্মরণ করেন। বক্তারা তাদের আত্মত্যাগকে গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় একটি নতুন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করেন।
বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস (বেতন ও ভাতাদি) আদেশ, ২০১৬-এর ২২নং অনুচ্ছেদের বৈষম্যমূলক বিধান নিয়ে উপস্থিত আলোচকরা উল্লেখ করেন, ২০১৫ সালে গঠিত বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস পে-কমিশনের সুপারিশ অগ্রাহ্য করে সরকার বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস (বেতন ও ভাতাদি) আদেশ, ২০১৬ প্রণয়ন করেন, যার ২২ নং অনুচ্ছেদে ‘জুডিসিয়াল সার্ভিসের সদস্যগণ প্রতি মাসে ৩০ জুন ২০১৫ তারিখে আহরিত ভাতার সমপরিমাণ (প্রাপ্য অঙ্কে) টাকা (মূল বেতনের শতাংশ হিসেবে নয়) জুডিসিয়াল ভাতা (বিশেষ ভাতা) প্রাপ্য হবেন এবং জুলাই, ২০১৫ তারিখে বা পরবর্তী সময়ে যোগদানকৃত, পদোন্নতিপ্রাপ্ত, উচ্চতর গ্রেডপ্রাপ্ত বা প্রেষণে কর্মরত জুডিসিয়াল সার্ভিসের সদস্যরা বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস বেতন স্কেল, ২০০৯ অনুযায়ী অনুরূপ মূল স্কেলের উপর ভিত্তি করে বিদ্যমান হার অনুযায়ী জুডিসিয়াল ভাতা (বিশেষ ভাতা) প্রাপ্য হইবেন’ মর্মে বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তারা জুডিসিয়াল সার্ভিস (বেতন ও ভাতাদি) আদেশ, ২০১৬-এর ২২নং অনুচ্ছেদ সংশোধনপূর্বক জুডিসিয়াল সার্ভিসের সব সদস্যের জন্য বর্তমান বেতন স্কেলের ওপর ভিত্তি করে বর্তমানে আহরিত বেতনের ৩০ শতাংশ জুডিশিয়াল ভাতার বিধান অন্তর্ভুক্ত করে ১ জুলাই, ২০১৫ তারিখ থেকে অদ্যাবধি ভূতাপেক্ষ জুডিসিয়াল ভাতা প্রদানের জোর দাবি জানান।
মন্তব্য করুন