১৬ আগস্টের ঘটনা। পাকিস্তানের ফয়সালাবাদ জেলার জারানওয়ালা এলাকায় দুই খ্রিষ্টান ভাইয়ের বসবাস। ২৪ বছর বয়সী উমর সেলিম রকি এবং ২১ বছরের উমায়ার রাজা। সকালে ঘুম থেকে উঠে কাজে যাওয়ার জন্য বের হয় রকি। ওদের ঘরের দুয়ারেই দেখতে পায় কতগুলো কাগজ। কাগজগুলো কুড়িয়ে হাতে নিয়ে রকি হতবাক হয়ে যায়। দেখতে পায় প্রথম কাগজের ওপর দুই ভাই রকি ও রাজার ছবি। সেই কাগজের নিচেই পবিত্র কোরআন শরিফের অর্ধেক পোড়ানো পাতা এবং হাতের লেখায় কিছু অবমাননাকর উক্তি। নার্ভাস হয়ে যায় রকি। ততক্ষণে দুই প্রতিবেশী মুসলমান তরুণ এসেই রকিকে কিল-ঘুসি দিয়ে হাত থেকে কাগজ ছিনিয়ে নেয়। আর যায় কোথায়! সংবাদ পেয়ে পাকিস্তানের পঞ্চম বৃহৎ রাজনৈতিক দল তেহরিক-ই-লাব্বাইক ও সংগঠন খতমে নবুয়াত মুভমেন্টের নেতৃত্বে হাজার হাজার লোক এসে খ্রিষ্টান এলাকা আক্রমণ করে। তারা পাঁচটি চার্চ এবং কমপক্ষে ২০০ বাড়ি সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে দেয়। ৫০০ বাড়ি ও ২০টি চার্চে হামলা চালিয়ে ধ্বংস করে, এমনকি খ্রিষ্টানদের সমাধিস্থলও বাদ যায়নি। হাতের কাছে যে কয়টি খ্রিষ্টানদের পবিত্র গ্রন্থ বাইবেল পাওয়া যায়, তা পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এমনকি এলাকায় যে কয়েকজন পুলিশ ছিল তারাও পালিয়ে যায়। কয়েক ঘণ্টা ধরে এ তাণ্ডব চলতে থাকে। পাকিস্তানে যে স্বল্পসংখ্যক খ্রিষ্টান অবশিষ্ট আছে (মোট জনসংখ্যার ১.৬ শতাংশ) তার মধ্যে পাঁচ হাজার ওই এলাকায় বসবাস করে। তারা দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে এদিক-সেদিক পালিয়ে যায়। এর মধ্যে স্থানীয় কিছু শান্তিপ্রিয় মুসলমানের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করে। অনেকেই এ ধ্বংসাত্মক আক্রমণের ভিডিও ধারণ করে ফেসবুকে আপলোড করেছে। অত্যন্ত দরিদ্র এ জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ মানুষ কোনো লেখাপড়া জানে না, অর্থাৎ অক্ষরজ্ঞানই নেই। তাদের বেশিরভাগই সুইপার, স্যানিটারি শ্রমিক ও মুচির কাজ করে। আরও করুণ বিষয়, ওই দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে ব্লাসফেমি আইনে চার্জ গঠন করা হয় এবং পরদিন তাদের দুই ভাইকে গ্রেপ্তার করা হয়। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক যে, পাকিস্তানে যেই বা যারাই সরকারে থাকুক না কেন, নিয়মিত এ অপশক্তিকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদত দিয়ে যাচ্ছে। যে দলটি এই হিংসাত্মক কাণ্ডে নেতৃত্ব দিয়েছে, সেই তেহরিক-ই-লাব্বাইক প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১৫ সালে। এর প্রধান নেতা খাদিম হুসেন রিজভি অত্যন্ত কঠোর ধর্মীয় মতবাদে বিশ্বাসী। তিনি তার কট্টর কার্যকলাপ দিয়েই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। ২০১১ সালে পাকিস্তানের পাঞ্জাবের সেক্যুলার গভর্নর সালমান তাসিরকে হত্যা করে তারই দেহরক্ষী মালিক মুমতাজ হুসেন কাদরি। কারণ সালমান একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে ব্লাসফেমি আইনের সমালোচনা করেন। বিচারে মুমতাজ কাদরিকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়ে তা কার্যকর করা হলে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফেটে পড়েন খাদিম হুসেন রিজভি এবং তার অনুসারীরা। মূলত সেই সময় থেকেই পাকিস্তানের রাজনীতিতে খাদিম প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন।
২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে তারা ২২ লাখ মানুষের ভোট আদায় করে। প্রাদেশিক নির্বাচনে এই দল মানুষের সমর্থন নিয়ে সিন্ধুতে তিনটি আসনে জয়লাভ করে। এই দলের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছেই, যদিও রিজভি ২০২০ সালে মৃত্যুবরণ করেছেন। মনে আছে ধর্ম অবমাননার মামলায় অভিযুক্ত খ্রিষ্টান নারী আছিয়া বিবিকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়? পরে পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণের অভাবে ২০১৮ সালে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট নির্দোষ বলে রায় দিলে এই তেহরিক-ই-লাব্বাইক পাকিস্তানব্যাপী প্রতিবাদের আয়োজন করে এবং রাওয়ালপিন্ডিতে ব্যাপক সড়ক অবরোধ করে। তেহরিক-ই-লাব্বাইক দলের অন্যতম নেতা মোহাম্মদ আফজাল কাদরি রায় প্রধানকারী বিচারপতিদের হত্যা করার জন্য তাদের ড্রাইভার, নিরাপত্তা প্রহরী এবং কর্মচারীদের প্রতি আহ্বান জানান। অবশেষে ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে ইমরান খানের সরকার একটি চুক্তিতে আসে যে, আছিয়া বিবিকে এক্সিট কন্ট্রোল লিস্টের অধীনে কোনো বিমানে দেশের বাইরে যেতে দেওয়া হবে না। এ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করলে আদালত আদেশটি বাতিল করে। পরে আছিয়া বিবিকে অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে নেদারল্যান্ডসের একটি চার্টার প্লেনে করে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করা হয়। আছিয়ার পক্ষে যে আইনজীবী লড়েছেন তাকে প্রাণ বাঁচাতে পাকিস্তান ছেড়ে লন্ডনে পাড়ি দিতে হয়েছে। এ ধরনের কাহিনি একটিই নয়, অসংখ্য এবং ঘটছেই। এই তো গত ৮ জুলাই ৩৫ বছর বয়সী জাকি মাসিহ নামে এক খ্রিষ্টানের বিরুদ্ধে ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনা হলে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। তার বিরুদ্ধে পাকিস্তান পেনাল কোডের ২৯৫/এ এবং ২৯৮ ধারায় মামলা রুজু করা হয়। এ ধারা অনুযায়ী যথাক্রমে ১০ বছরের এবং এক বছরের কারাদণ্ড এবং জরিমানার বিধান রয়েছে (২৯৫/সি ধারায় মৃত্যুদণ্ড রয়েছে)। সেন্টার ফর সোশ্যাল জাস্টিসের হিসাব অনুযায়ী পাকিস্তানে ১৯৮৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১ হাজার ৯৪৯ জনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধারায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনা হয়। ২০২৩ সালের শুরু থেকে ১৫ মে পর্যন্ত ৫৭টি ব্লাসফেমি আইনে মামলা হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না এর অধিকাংশই অমুসলিম। সেইসঙ্গে কিছু অসহায় মুসলমানের বিরুদ্ধেও এ মামলা করে প্রভাবশালী ধনী ব্যক্তিরা, যারা জমি দখল ও নানা ধরনের হয়রানি করার উদ্দেশ্যে এ আইনের ব্যবহার করে। প্রতিটি ধর্মই শান্তির কথা বলে। ইসলামকে বলাই হয় শান্তির ধর্ম। অথচ দেখা যায় যে দেশগুলোতে দুঃশাসন আছে সেই দেশগুলোতেই ধর্মকে হাতিয়ার করে একশ্রেণির হিংস্র মানুষ অন্যের ওপর নির্যাতন চালানোর প্রয়াস পায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ কোন ধর্ম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ঘাড়ে চেপে বসেছে? এতটুকু বোধ তারা হারিয়ে ফেলেছে যে, এই হিংসা, এই প্রতিহিংসা, এই সাম্প্রদায়িক মনোভাব কখনোই কোনো ধর্ম সমর্থন করতে পারে না? পাকিস্তানের রাজনীতি এবং অর্থনীতি যত অস্থির হয়ে উঠছে, জনগণের একটি বৃহৎ অংশ যেন তত অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি।
পাকিস্তানের এ নারকীয় পরিস্থিতির জন্য শুধু অশিক্ষিত, ধর্মান্ধগোষ্ঠীই দায়ী নয়। এর পেছনে রয়েছে দেশটির প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা। ১৯৪৭ সালের শুরু থেকেই দেশটির জনগণের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলতে শুরু করে জামায়াত-ই-ইসলামী, জমিয়াতে উলেমা ইসলাম, মজলিশ-ই-তাহাফুজ-ই-খতম-ই-নবিয়ত, মজলিশ-ই-আহরার-ই-ইসলাম নামক সংগঠনগুলো। দ্বিতীয়ত, অত্যন্ত গোড়া মনোভাবাপন্ন সেনাবাহিনীর রয়েছে পাকিস্তানের সরকার ও জনগণের ওপর ব্যাপক প্রভাব। দেশটির স্বাধীনতার পর থেকেই প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রপরিচালনার ভার দখল করে রেখেছে সেনাবাহিনী। তার চেয়েও বড় কথা, দেশটির শিক্ষাব্যবস্থা সাম্প্রদায়িকতায় পূর্ণ। কী শেখানো হচ্ছে পাকিস্তানের শিশু-কিশোরদের! পাকিস্তানের ন্যাশনাল কমিশন ফর জাস্টিস এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘পাকিস্তানের টেক্সটবুক এবং কারিকুলাম অমুসলমানদের প্রতি ঘৃণা ও অসহিষ্ণুতায় পরিপূর্ণ। শিশুদের পড়ানো হচ্ছে এবং উৎসাহিত করা হচ্ছে মৌলবাদ ও চরমপন্থায়। আমরা আসলে তৈরি করছি মুসলিম যোদ্ধা, কারণ আমরা বেছে নিয়েছি যে, সুফি দার্শনিক বা কবি নয়, আমাদের হিরো হচ্ছে অস্ত্র হাতে যোদ্ধারা।’
যুক্তরাষ্ট্রের ‘কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম’ এক রিপোর্টে বলেছে, ৪১ মিলিয়ন পাকিস্তানি শিশুকে টেক্সটবুকের মাধ্যমে নেতিবাচক শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘পাকিস্তানের সরকারি স্কুলের বইগুলোতে অত্যন্ত বিপজ্জনক বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এতে অমুসলমানদের বহিরাগত, দেশপ্রেমহীন এবং নিচু জাত বলে উল্লেখ করা আছে।’ এরকম একটি দেশের সভ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে এটাই স্বাভাবিক।
ছোট একটি ইতিহাস দিয়ে শেষ করি : মহারাজা রঞ্জিত সিংয়ের ছিল এক চোখ। তিনি তরুণ বয়সে এক যুদ্ধে একটি চোখ হারান। রঞ্জিত সিংয়ের খুবই প্রিয় মন্ত্রী ছিলেন ফকির আজিজুদ্দিন। একবার এক দরিদ্র মুসলিম ক্যালিওগ্রাফার অত্যন্ত চমৎকার অক্ষর বিন্যাসে কোরআন শরিফ লিখে মুসলিম রাজা ও রাজকুমারদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে থাকেন বিক্রয়ের আশায়। কিন্তু সর্বত্রই ব্যর্থ হন। আজিজুদ্দিনের কাছে গেলে তিনিও ফিরিয়ে দেন। কিন্তু রঞ্জিত সিং জানতে পেরে সেটি দেখতে চান। কোরআন শরিফটি দেখে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হন এবং হাতে নিয়ে ভক্তির সঙ্গে চুম্বন করতে থাকেন। অবশেষে উচ্চমূল্য দিয়ে তিনি সেটি ক্যালিওগ্রাফারের কাছ থেকে কিনে নেন। মন্ত্রী আজিজুদ্দিন অবাক হয়ে মহারাজাকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনি একজন শিখ হয়েও এ কোরআন এত উচ্চমূল্য দিয়ে কেন কিনলেন?’
মহারাজা উত্তরে বললেন, ‘খোদার ইচ্ছা, আমি যেন সব ধর্মকে এক চোখে দেখি। তাই তিনি আমার এক চোখ কেড়ে নিয়েছেন।’ এমন শাসকের দেশ কোনো শক্তি দুর্বল করতে পারে না। রঞ্জিত সিংয়ের শাসনকাল ছিল পাঞ্জাবের সবচেয়ে গৌরবময় স্বর্ণযুগ। যে দেশ তার সব সন্তানকে সমান চোখে দেখে না, এক বিশ্বাসে স্থির থেকে অন্য বিশ্বাসকে অবহেলা করে নির্যাতন নিপীড়নের পথে ঠেলে দেয়, সে দেশ শুধু একটি হিংস্র আস্তানা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। কোনো রাষ্ট্র নয়।
লেখক : সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
মন্তব্য করুন