বাংলাদেশের হাওর জনপদে এই এপ্রিল একান্তই সোনালি। চোখ যেদিকে যায়, কেবল ধান, সোনার মতো ঝলমল করে উঠছে আলোয়। কৃষকের মুখেও তেমনি একরাশ আলো। তবে সেই আলোয় মিশে আছে এক টুকরো ছায়া, যা ন্যায্য মূল্য না-পাওয়ার আশঙ্কা থেকে জন্ম নেয়। এবারের বোরো মৌসুমে কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ হাওর অঞ্চলে বাম্পার ফলনের যে চিত্র আমরা পাচ্ছি, তা নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক। মাঠে মাঠে ধান কাটার ধুম, মাড়াই-মাড়ানোর কর্মচাঞ্চল্য, পরিবারজুড়ে উৎসবের আমেজ—সবই মনে করিয়ে দেয় আমাদের কৃষিপ্রধান পরিচয়।
তবে এই উজ্জ্বল ছবির পেছনে রয়েছে এক অমোচনীয় দুশ্চিন্তা। খরচের সঙ্গে বিক্রয়মূল্যের ফারাক ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ধানকাটা থেকে শুরু করে মাঠে মাড়াই, শুকানো, বস্তাবন্দি, পরিবহন—সবমিলিয়ে প্রতি মণ ধান উৎপাদনে কৃষকের গড় খরচ পড়ছে ৮৫০ থেকে ১০০০ টাকার মধ্যে। অথচ খোলা বাজারে এখনো যে দাম পাওয়া যাচ্ছে, তা কোনো কোনো জেলায় ১১০০ টাকাও ছোঁয়নি। লাভ তো দূরের কথা, খরচই উঠছে না। করিমগঞ্জের কৃষক বুলবুল সরদার কিংবা নিকলীর সেলিম মিয়া—সবার মুখেই শোনা যাচ্ছে একই কথা: ‘ধান উঠেছে, কিন্তু পেটে পড়বে কি না, জানি না।’
এই হতাশা কেবল বর্তমান মূল্য পরিস্থিতি থেকে নয়, বরং দীর্ঘদিনের এক কাঠামোগত সংকট থেকে জন্ম নিচ্ছে। প্রতি বছর ধান উঠলেই একই দৃশ্য: কৃষক মাঠে ধান তুলছেন, কিন্তু সরকারের সংগ্রহ কার্যক্রম তখনো শুরু হয়নি। ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করতে গিয়ে ঠকতে হচ্ছে। এই প্রক্রিয়াগত দেরি অনেক কৃষকের মাথায় চেপে বসা ঋণ শোধের তাগিদে ধান কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য করে। সে সুযোগে মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভবান হয়, আর প্রকৃত উৎপাদক থেকে যায় কোণঠাসা।
আরেকটি দিক দৃষ্টিগোচর হওয়া জরুরি। প্রযুক্তির প্রসার যেমন কৃষিকে গতিশীল করেছে, তেমনি কিছু শ্রমজীবী মানুষের জীবনেও এনেছে অনিশ্চয়তা। ইটনার গফুর আলী কিংবা মিঠামইনের সিরাজুল ইসলাম—যারা আগে মৌসুমে মৌসুমে হাওরে ধান কাটতে আসতেন, এখন মেশিনে ধানকাটার কারণে তাদের প্রয়োজন অনেক কমে গেছে। এতে পেশাভিত্তিক শ্রমিকদের আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি তাদের মধ্যে এক ধরনের স্থায়ী নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হচ্ছে।
তবে সব কিছুর মধ্যেও চোখে পড়ে হাওরের সামাজিক চিত্র। এই কষ্টসাধ্য সংগ্রামে নারীদের অংশগ্রহণ অনস্বীকার্য। উঠানে ধান শুকানো থেকে শুরু করে গাদা গাদা ধান ঝাড়ার কাজ, বস্তাবন্দি করা—সবই তারা করছেন অক্লান্ত পরিশ্রমে। অনেক ক্ষেত্রে তারা একদিকে সন্তান সামলাচ্ছেন, অন্যদিকে মাঠে নেমে স্বামীর পাশে থেকে শ্রম দিচ্ছেন। এই শ্রম অনির্বচনীয়, এই অবদান আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতির সবচেয়ে অদৃশ্য অথচ গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ।
প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার কি এই বাস্তবতা যথাযথভাবে বিবেচনা করছে? কৃষকদের ধান ন্যায্য দামে বিক্রির নিশ্চয়তা দিতে হলে মাঠপর্যায়ে ধান সংগ্রহ শুরু করতে হবে অবিলম্বে। সরকার ঘোষিত সংগ্রহ মূল্য যেন নামমাত্র ঘোষণা না হয়ে থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে কঠোর নজরদারির মাধ্যমে। পাশাপাশি কৃষক যেন প্রকৃত ক্রয় কেন্দ্রগুলোয় সহজে ধান বিক্রি করতে পারেন—তার জন্য ঘুষ-দালালির সংস্কৃতির অবসান ঘটানো দরকার।
কৃষিতে বিনিয়োগ করা মানে দেশের খাদ্যনিরাপত্তায় বিনিয়োগ করা। একদিকে সরকার খাদ্যঘাটতি মোকাবিলায় আমদানি নির্ভরতা কমাতে চায়, অন্যদিকে যদি স্থানীয় উৎপাদক ন্যায্যমূল্য না পান, তবে কৃষিকাজে অনীহা তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। এ অবস্থায় সরকারি প্রণোদনার চেয়ে বেশি প্রয়োজন সুশাসন ও সংবেদনশীল বাজার ব্যবস্থাপনা।
আমরা ভুলে যেতে পারি না—কৃষিই বাংলাদেশের প্রাণ। হাওরের সোনালি ধান শুধু খাদ্য নয়, এটি কৃষকের গর্ব, তার ঘাম ঝরানো জীবনের প্রতিচ্ছবি। এই ধান যেন তার কাছে হাহাকারের প্রতীক না হয়ে দাঁড়ায়, সেজন্য আজই দরকার কার্যকর হস্তক্ষেপ। নইলে ‘বাম্পার ফলন’ হবে শুধু পরিসংখ্যানের গল্প, আর কৃষকের ঘরে ফিরবে অপচয়, অশ্রু আর অভিমানের দীর্ঘশ্বাস।
কভারেজ এরিয়া: কিশোরগঞ্জ, তথ্য সংগ্রহ: করিমগঞ্জ, নিকলী ও ইটনা
লেখক: কলামিস্ট
মন্তব্য করুন