দুই অক্ষর দিয়ে লেখা যায় এমন একটা ছোট্ট নাম আছে জিনিসটার—চাকা। এ চাকার অস্তিত্বের ওপর নির্ভর করে জমিনে চলা কিংবা আকাশে ওড়া যানবাহন ও বিমানের থাকা না থাকা। সাইকেল থেকে সিএনজি, কার থেকে লরি, ট্রেন থেকে প্লেন—সবকিছুই অচল, যদি চাকা না হয় সচল।
সবাই জানে এ জগতে চলতে গেলে প্রথমে লাগে টাকা, তারপর লাগে চাকা। অথচ এ চাকার প্রতি দৃষ্টি অনেকেরই বাঁকা। কারণ চাকার ভেতরটা ফাঁকা। চাকার অবস্থান আবার গাড়ি, প্লেন ও রেলের বডির নিচে রাখা। এ কারণে অনেকেই ভাবে চাকা ব্যাটা জাতে বড় নিচু! কিন্তু চাকা ঘুরতে দেখলেই ছুটে সবাই পিছু।
মানুষ, বালিশ, পর্দা কিংবা উচ্চবংশীয় ছাগলের মতো চাকাও আবার ভাইরাল হয়, তবে যদি তা বিমানের চাকা হয়। উচ্চবংশীয় এ বিমানের চাকা ক্রয়ের নামে রাষ্ট্রের কত টাকা ক্ষয় কিংবা অপচয় হয় আর বড় বড় কত কর্তার চরিত্রের অবক্ষয় হয়, তার হিসাব কারও জানার কথা নয়। কারণ মুখ খুললেই থাকে চাকরি হারানোর ভয়।
ভয়ে মুখ না খুললেও সম্প্রতি খুলে পড়েছে বিমানের চাকা। ঢাকা আসার পথে কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে ত্যাগ করার পরপরই বিমানটির একটা চাকা খুলে মাটিতে পড়ে যায়। বিমানবন্দরের পাশে সমিতিপাড়ার মাটিতে নিরাপদে অবতরণ করে এ চাকা। ভাগ্য ভালো যে, চাকা অবতরণের স্থানটি ছিল ফাঁকা। তাই ঘটনা স্থলে কেউ করেনি কা...কা...।
তবে বরাবরের মতো পেয়ে বসেছে সোশ্যাল মিডিয়ার কনটেন্ট ক্রিয়েটর নামক আজব মানুষরা, বুদ্ধিতে যারা পাকা। রসিয়ে রসিয়ে বলছে তারা, ছিল না একটি চাকা, তবে পাইলট ছিল পাকা, ফলে পাইলটের টোটকা চিকিৎসায় নিরাপদেই বিমান পৌঁছেছে ঢাকা। অক্ষত ছিল বাকি সব চাকা।
চাকা নিয়ে এমন ঘটনা রহস্যের চাদরে ঢাকা। বিমান উড্ডয়নের আগে চাকাসহ সবকিছু পরীক্ষা করে লিখতে হয় খাতা। তবে কি চাকা নিয়ে লেখার পাতাটি ছিল ফাঁকা? এ প্রশ্নের সোজা উত্তর নেই, উত্তর সব বাঁকা।
উড়ালের পর চাকা না থাকা নিয়ে হয়েছে তদন্ত কমিশন। তবে বড় আজব এ দেশের তদন্ত কমিশনের রসায়ন। বড় বড় কমিশন, সদস্যরা সব গুণী, তবে চূড়ান্ত রিপোর্টের কথা জানতে পারে না আমজনগণ। ফলে কদিন চলে গুনগুন। এরপর যে যার মতো নতুন ধান্দায় করে গমন। বিমানের চাকা না থাকা নিয়েও এমনটাই হয়তো হবে, যেমনটা অতীতে বিমানের কিংবা বিমানবন্দরের অসংখ্য অনিয়মের তদন্তের ক্ষেত্রে হয়েছে। অর্থাৎ কমিশন হবে, তদন্ত হবে, এরপর সময়ের সঙ্গে মানুষের মাথা হবে ফাঁকা আর স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাবে বিমান থেকে খুলে যাওয়া চাকা।
তবে এই অধম কেন যেন আবোলতাবোল স্বপ্ন দেখে। মধ্যরাতে দেখা এমনি এক স্বপ্নে অধমের হাতে পৌঁছে যায় একটি তদন্ত রিপোর্ট। বিমানের চাকা না থাকা নিয়ে তদন্ত করেছিলেন মিস্টার কাদের কাকা। তিনি আবার ভাবেন জনগণ সব বোকা। তাই চাকা নিয়ে দিয়ে গেলেন ধোঁকা। হি মেইড আস ফুলিশ। তিনি জানেন জনগণ সব ন্যাকা, সবকিছু ভুলে যায় খানিকটা করে কা...কা...? এবার আসুন চাকা না থাকা নিয়ে মিস্টার কাদের কাকার করা ও স্বপ্নে পাওয়া তদন্ত রিপোর্টে যাক ঢোকা।
রিপোর্ট করলেই বোঝা যায় চাকা নিয়ে তদন্ত রিপোর্ট প্রদান ছিল নিতান্তই এক ঠ্যাকা। জনগণ জানবে না কিছুই এটাই ছিল মওকা। তাই লেখা যায় সবকিছুই, হোক তা সোজা কিংবা বাঁকা। এই বাঁকা কথার প্রথমেই আসে বিশ্ব পরিস্থিতির কথা। সারা পৃথিবী যখন ফ্রান্সের তৈরি রাফায়েল আর চীনের তৈরি জে-১০ সি জঙ্গি বিমান নিয়ে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধকেন্দ্রিক আলোচনায় মাতোয়ারা, তখন বাংলাদেশের কেন হাত গুটিয়ে বসে থাকা? সুতরাং খুলো ড্যাশ ১০-৪০০ বিমানের চাকা। ড্যাশ কোম্পানির মুখে পড়ুক ছ্যাঁকা। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের সাড়া জাগানো খবর হলো, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কাতারের আমির শেখ তামিম বিমানের নামে উড়ন্ত বাড়ি উপহার দিয়ে আলোচনায় এসেছেন। মার্কিনবিরোধীরা এমন আলোচনা থামিয়ে দিতে বাংলাদেশে চাকা-কাণ্ড ঘটাতে পারে বলে মনে করে কাদের কাকার তদন্ত কমিশন।
তদন্ত কমিশন চাকা খোলার সঙ্গে রাজনৈতিক-সংশ্লিষ্টতা থাকার বিষয়টি খুঁজে পেয়েছে। রোহিঙ্গা ও রাখাইনে সম্ভাব্য করিডোর নিয়ে আলোচনায় বারবার সামনে আসছে কক্সবাজার বিমানবন্দরের কথা। সামনের মাসেই এ বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট ওঠানামা শুরু হওয়ার কথা। মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলে মানবিক করিডোরের জন্য জাতিসংঘ বা অন্য দেশের বিমানও হয়তো নামবে ভবিষ্যতে। তা বন্ধ করতেই একটি কুচক্রী মহল প্রমাণ করতে চাচ্ছে যে, কক্সবাজার বিমানবন্দর নিরাপদ নয়। এখানকার রানওয়েতে বিমান রান করলে চাকা খুলে যায় কিংবা এখানকার চোরেরা ধোলাইখালে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। রানওয়েতে চলন্ত অবস্থায়ও বিমানের চাকা খুলে ফেলার মতো প্রযুক্তি শিখে ফেলেছে কক্সবাজারের বিশেষ চোরের দল। অতএব যদি বাঁচাতে চান বিমানের চাকা, উপায় একটাই, কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে দূরে থাকা।
রোহিঙ্গারা এখন বেপরোয়া। তাদের নেশা এখন যেভাবেই হোক অন্য দেশে যাওয়া। তাই কয়েকজন রোহিঙ্গা ধরে বসে বিমানে চাকা। উদ্দেশ্য চাকায় ঝুলে অন্য দেশে ঢোকা। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ভারে বিমানের চাকাটি হয়ে গেল ফাঁকা। এটাও মনে করে তদন্ত কমিশনের মিস্টার কাদের কাকা।
জগৎ সংসারেও অদৃশ্য চাকা আছে। দৃশ্যমান চাকা থাকে যানবাহনে, যা হাওয়া বললেই চলে। আর অদৃশ্য চাকা থাকে সরকারি অফিসের ফাইল, ঠিকাদার ও সরবরাহকারীদের বিল, পাসপোর্ট ও লাইসেন্স প্রাপ্তির আবেদন, চাকরির তদবির, মামলার নথি, তদন্ত রিপোর্ট ইত্যাদিতে। এসব ক্ষেত্রে অদৃশ্য চাকা হাওয়া নয়, টাকা ভরলেই চালু হয়। এর চেয়ে বেশি লিখলে কে যে দেয় ছ্যাঁকা! দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান চাকা নিয়ে লেখার হাত এখানেই ঠ্যাকা।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত মেজর, গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
ইমেইল: [email protected]
মন্তব্য করুন