রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেটের সাতক্ষীরার সুস্বাদু আম বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা কেজি দামে। আমের এমন রং দেখে কিনতে ইচ্ছে হলো। এমন সময় আমার সঙ্গে থাকা একজন বললেন, এসব আমে ফরমালিন ও কেমিক্যাল মেশানো হয়েছে। বাচ্চাদের জন্য না নেওয়াই ভালো। আমি তখন বললাম, চাষিদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সাতক্ষীরায় হিমসাগর আম পাড়ার সময় পাঁচ দিন এগিয়ে আনা হয়েছে। নতুন সময় অনুযায়ী ১৫ মে থেকেই আম সংগ্রহ ও বাজারজাত শুরু হয়ে গেছে। এখন কেনা যাবে। তবু তিনি কিনতে বাধা দিলেন। আবারও বললাম, ভাই ভেজালমুক্ত থাকার জন্য জানতে হবে প্রাকৃতিকভাবে কোন আম কখন পাকে এবং পরিপক্ব আম খাওয়ার সঠিক সময় কোনটি। হিমসাগরের মৌসুমে যদি আমরা কেউ বলি—ল্যাংড়া আম খাব, তাহলে যারা অসাধু, তারা কেমিক্যাল দিয়ে ল্যাংড়া আমকে পাকিয়ে দেবে। এমন পরিস্থিতিতে, কোন জাতের আম কোন মৌসুমে পাকে সেটা জানলে আমরা সঠিক সময়ে ভেজালহীন আম কিনতে পারব।
আম বিশেষ পুষ্টিগুণেও সমৃদ্ধ। কিন্তু পুষ্টিগুণ থাকা সত্ত্বেও নানান অপপ্রচারের কারণে অনেকে আম খাওয়া ছেড়ে দেন। বাজারে আম কিনতে গেলে অনেকেই দ্বিধায় ভোগেন, তিনি যে আমটি কিনছেন সেগুলো রাসায়নিক দিয়ে পাকানো কি না? কারণ, প্রতিনিয়তই বাজারে এমন প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। আর রাসায়নিক দেওয়া আম খেলে স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে। তবে এমন নেতিবাচক ধারণা একটা সময় ছিল না। এখন পাকা আম বাজারে এলেই নানা প্রশ্ন চলে আসে। ভয় বা বিভ্রান্তি কাজ করে—খাঁটি আম তো? মানে ফরমালিন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড রাসায়নিক দিয়ে আম পাকানো হয়েছে কি না? এ চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। কোথাও যেন স্বস্তি নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সাধারণ মানুষ কীভাবে রাসায়নিকমুক্ত পরিপক্ব আম চিনবেন?
বর্তমানে বাংলাদেশে ভেজালের সার্বজনীন যে উৎসব চলছে তাতে আমরা সবাই কমবেশি আক্রান্ত। ফলমূল, মাছ-মাংস, সবজি এমনকি দুধ বা দুগ্ধজাত মিষ্টিতেও কেমিক্যাল মেশানো হচ্ছে। অবস্থা এমন যে, ক্রেতা জানেন খাদ্যপণ্যটি কেমিক্যাল মিশ্রিত তবুও তিনি কিনছেন। কারণ, অন্য সুযোগ তার কাছে খুবই কম। এরই মধ্যে বাজারে উঠতে শুরু করেছে মৌসুমি ফল আম। খালি চোখে সব আম দেখতে সুন্দর হলেও এতে অনেক সময় রাসায়নিক দ্রব্য মেশানো হয়। বিশেষ করে ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে আম দ্রুত পাকানোর উদাহরণ রয়েছে। এ বছরও কেমিক্যাল মেশানো অপরিপক্ব আম জব্দ করে বিনষ্ট করা একাধিক খবর পাওয়া গেছে।
দেশে উৎপাদিত ফলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পচনশীল হচ্ছে আম। একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী মহল আমে কেমিক্যাল ও ফরমালিন রয়েছে এমন অপপ্রচার করে আমকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া চেষ্টা করে চলেছে। এতে দেশীয় আমচাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
তবে কি আমরা আম খাওয়া ছেড়ে দেব? আমার উত্তর হচ্ছে, মৌসুমে আম মৌসুমে খেতে হবে। কারণ ভরা মৌসুমে আমচাষিরা আসলে কেমিক্যাল ব্যবহার করে কি না? আর দিলেও কেন দেবে? আমার ধারণা, আমচাষিরা এ ধরনের কেমিক্যাল অন্তত ভরা মৌসুমে দেয় না। কারণ হচ্ছে, ভরা মৌসুমে আম এমনিতেই পরিপক্ব থাকে এবং আম আধা পাকা অবস্থায় গাছ থেকে পাড়া হয়। এ সময় আম রেখে দিলে বা আমগাছ থেকে পাড়ার পর ট্রান্সপোর্টের সময়টুকুতে আম এমনিতেই পেকে যায়। তাই ভরা মৌসুমে টাকা খরচ করে ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে আম পাকানোর কোনো প্রয়োজনই দেখি না। আর ভরা মৌসুমে প্রচুর আম বিক্রি হয়, দোকানে স্টক থাকে না। প্রচুর আম আসে, তেমনি প্রচুর আম বিক্রিও হয়ে যায়।
আমের ফরমালিন ব্যাপারে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আমার কথা হয়। তারা জানান, প্রাকৃতিকভাবেই প্রত্যেক ফলমূল ও শাকসবজিতে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় (গড়ে ৩-৬০ মিলিগ্রাম/কেজি মাত্রায়) ফরমালডিহাইড থাকে, যা মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়। মনে আছে, ২০১৪ সালে আমে ফরমালিনের কথা বলে হাজার হাজার মণ আম বিনষ্ট করা হয়। শুধু আম নয়, অন্যান্য মৌসুমি ফলও করা হয় ধ্বংস। অথচ গবেষণায় জানা গেল, শুধু আম নয়; ফলমূল, শাকসবজিতেও ফরমালিনের কোনো ক্ষতিকর ভূমিকা নেই। যে যন্ত্র দিয়ে ফরমালিন মাপা হতো সেটাও কার্যকর ছিল না।
নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এরপর ফরমালিন বিষয়ে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে। তাতে বলা হয়—ফলমূল ও শাকসবজি হচ্ছে তন্তু (ফাইবার) জাতীয় খাবার, যেখানে প্রোটিনের উপস্থিতি অত্যন্ত কম। ফরমালিন হচ্ছে ৩৭ শতাংশ ফরমালডিহাইডের জলীয় দ্রবণ এবং অতি উদ্বায়ী একটি রাসায়নিক যৌগ, যা মূলত প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবারের সঙ্গে বিক্রিয়া করে। তাই ফলমূল, শাকসবজি সংরক্ষণে ফরমালিনের কোনো ভূমিকা নেই। কেউ যদি না বুঝে দেয়, তাহলেও কোনো কাজে আসবে না। সংরক্ষণে কোনো ভূমিকা রাখবে না। কারণ এখানে কোনো প্রোটিন নেই।
আসলে ফল পাকানোর জন্য কার্বাইড ও ইথোফেন ব্যবহার করা হয়, যা সারা বিশ্বে নির্দিষ্ট মাত্রায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কার্বাইড ফলের মধ্যে প্রবেশ করে না, কার্বাইড হিট উৎপন্ন করে, যা আম অথবা অন্য ফলকে পাকাতে সাহায্য করে। আর ইথোফেন কিংবা কার্বাইড দিয়ে পাকানো আমের স্বাদ কিছুটা তারতম্য মনে হলেও তার পুষ্টি উপাদানে খুব বেশি পরিবর্তন হয় না। আর ইথোফেন প্রয়োগ করা হলেও সেটা ২৪ ঘণ্টা কম সময়ের মধ্যেই নির্ধারিত মাত্রার নিচে চলে আসে। তবে যে কোনো ফল খাওয়ার আগে বেসিনের পানিতে কয়েক মিনিট ছেড়ে রাখলে কেমিক্যাল ধুয়ে চলে যায়, ফলে শরীরের ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে না বললেই চলে। তবে প্রাকৃতিকভাবে কোন আম কখন পাকে এবং পরিপক্ব আম খাওয়ার সঠিক সময় কোনটি আমাদের জানতে হবে।
এরই মধ্যে পরিপক্ব আম বাজারজাতে সূচি ঘোষণা করে আসছে স্থানীয় প্রশাসন। সূচি অনুযায়ী আম কিনলে কোনো ভয়ের কারণ নেই। সাতক্ষীরা অঞ্চলের গোবিন্দভোগ, গোপালভোগ, হিমসাগর, বোম্বাই, গোলাপখাস, বৈশাখীসহ স্থানীয় জাতের আম বাজারে আসতে শুরু করেছে। ২৭ মে থেকে পাওয়া যাবে ল্যাংড়া। ৫ জুন থেকে বাজারে উঠবে আম্রপালি জাতের আম। তবে যেসব এলাকায় আবহাওয়ার প্রভাবে আম অগ্রিম পরিপক্ব হয়েছে, সেখানে কৃষি বিভাগ থেকে অনুমোদন সাপেক্ষে আম বাজারজাত করা যাবে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
গত আট বছরের মতো এবারও অপরিপক্ব আম বাজারজাতকরণ ঠেকাতে জাতভেদে আম নামানোর নির্দিষ্ট সময়সূচি ঘোষণা করেছে রাজশাহী জেলা প্রশাসন। এ সময়সূচিই ‘ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার’ নামে পরিচিত। সেই ক্যালেন্ডার গুটি আম বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। গোপালভোগ আম নামানো যাবে ২২ মে থেকে। লখনা (লক্ষ্মণভোগ) ও রানীপছন্দ ২৫ মে থেকে, হিমসাগর ও ক্ষীরসাপাত ৩০ মে থেকে, ল্যাংড়া ও ব্যানানা ম্যাঙ্গো ১০ জুন থেকে, আম্রপালি ও ফজলি ১৫ জুন থেকে, বারি-৪ আম ৫ জুলাই, আশ্বিনা ১০ জুলাই এবং গৌড়মতি ১৫ জুলাই থেকে; এ ছাড়া কাটিমন ও বারি আম-১১ জাতের আম পাকলেই নামাতে পারবেন চাষিরা। তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জে চলতি মৌসুমে থাকছে না ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার বা আম পাড়ার সময়সীমা। আম পরিপক্ব হলেই গাছ থেকে পেড়ে বাজারজাত করতে পারবেন আমচাষিরা। আর একমাত্র আঁশবিহীন রংপুরের হাঁড়িভাঙা আম পাওয়া যাবে জুন মাস থেকে।
তাই আসুন ইথেফন, ইথিলিন ও ফরমালিনের বিষয়টি ভালোভাবে জানি এবং আম না কেনা বা ধ্বংস করা থেকে বিরত থাকি। তবে আমচাষিরা যেন অতিরিক্ত মাত্রায় ইথোফেন ব্যবহার না করেন এবং তা কেবল পুষ্ট কাঁচা আমে ব্যবহার করেন, সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ দান ও ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। আমের ক্যালেন্ডার রাজধানীসহ বিভিন্ন বাজারে লিফলেটের আকারে প্রচার করে প্রাকৃতিকভাবে কোন আম কখন পাকে এবং পরিপক্ব আম খাওয়ার সঠিক সময় কোনটি জানাতে স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। আমরা যদি একটু সচেতন হই তাহলে এ সম্ভাবনাময় শিল্পকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি।
লেখক: কৃষিবিদ, উপপরিচালক
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন