একটা সময় ছিল যখন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু প্রায় এককভাবেই ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ছিল তখন প্রায় নিষ্ক্রিয়। গাজার মতো পশ্চিম তীরে যুদ্ধাবস্থা না থাকলেও সেখানে ইসরায়েল সরকারের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও কূটনৈতিক প্রভাব ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। আর আন্তর্জাতিক আইনকে অবজ্ঞা করে ফিলিস্তিনের পূর্ণ ভূখণ্ডের ওপর তেল আবিবের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়নে সমর্থন দিতে প্রস্তুত ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। নেতানিয়াহু মনে করছিলেন, তার গাজাকে সম্পূর্ণভাবে দখল করার ইচ্ছা পূরণ হতে যাচ্ছে। যেই ভূমি বহু বছর ধরে ইসরায়েলের দমনমূলক অবরোধ প্রতিহত করে আসছে, সেই ভূমি যেন তার অস্তিত্বের শেষ অধ্যায়ে এসে পৌঁছেছে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনগুলো দেখে মনে হচ্ছে যে, নেতানিয়াহুর আগ্রাসী অভিলাষগুলোর গতি রোধ হতে চলেছে।
ইসরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রশংসা কুড়িয়েছেন বিবি। তিনি ইসরায়েলের নাগরিকদের শুধু দীর্ঘস্থায়িত্বই নয়, একই সঙ্গে অভূতপূর্ব সমৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এ প্রতিশ্রুতির নিদর্শন হিসেবে তিনি অনেক দিন ধরেই একটি দৃষ্টিনন্দন উপকরণ ব্যবহার করে আসছেন। আর সেটি হলো মধ্যপ্রাচ্যের একটি প্রতীকী মানচিত্র। তার ভাষ্যমতে, সেটা ‘নব্য মধ্যপ্রাচ্য’, যেখানে তিনি কল্পনা করেছেন ইসরায়েলের নেতৃত্বাধীন একটি ঐক্যবদ্ধ সবুজ অঞ্চল। এ মানচিত্রটা যেন অগণিত আশীর্বাদে গড়া ভবিষ্যতের একটি দৃষ্টান্ত। তবে এ মানচিত্রে যে একটা দেশ অনুপস্থিত, সেটা হলো ফিলিস্তিন। ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের পূর্বেকার ফিলিস্তিনের কোনো নিশান যেমন এখানে নেই, তেমনই বর্তমান ফিলিস্তিনের স্বায়ত্তশাসিত দুটো অঞ্চল, গাজা আর পশ্চিম তীরের কোনো চিহ্নও এ মানচিত্রে নেই।
২০২৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে নেতানিয়াহু এ মানচিত্র উন্মোচন করেন। তার দাম্ভিক ভাষণের দরুন অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের খুব অল্পসংখ্যক প্রতিনিধি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আর যারা উপস্থিত ছিলেন, তাদের মাঝেও সমর্থন বা উচ্ছ্বাসের কোনো ছাপ ছিল না। কিন্তু তাদের অসম্মতি, নেতানিয়াহু, তার চরমপন্থি সমর্থকগোষ্ঠী বা ইসরায়েলের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকদের জন্য তেমন গুরুত্ব বহন করে না। কারণ ঐতিহাসিকভাবে ইসরায়েলের সমর্থনের মূল ভিত্তি হলো পশ্চিমা বিশ্বের গুটিকয়েক পরাশক্তি রাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের কিছু দেশের সমর্থনের কারণেই ইসরায়েল তার দখলদারী কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের চালানো আক্রমণকে ব্যবহার করে ইসরায়েল পশ্চিমা বিশ্ব এবং আন্তর্জাতিক মহলের সহানুভূতি অর্জন করে। সেটাকে পুঁজি করে ইসরায়েলের সরকার যেমন একদিকে তাদের চলমান অবৈধ কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দিতে শুরু করে, অন্যদিকে পাল্টা আক্রমণ চালানোর জোর প্রস্তুতি নিতে থাকে। তবে বিশ্ববাসী যখন বুঝতে পারে যে, ইসরায়েলের পাল্টা আক্রমণটা কোনো নিরাপত্তাজনিত পদক্ষেপ না, বরং গণহত্যার অভিযানে রূপ নিতে শুরু করেছে, তখন এই সহানুভূতির মাত্রা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। ক্রমেই এটা সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, গাজার অধিবাসীদের নির্মূলীকরণ এবং ফিলিস্তিনিদের জাতিগত নিধনই ইসরায়েলি বাহিনীর প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গাজার বিভীষিকাময় হত্যাযজ্ঞের চিত্র যখন বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পেতে থাকে, তখন ইসরায়েলের প্রতি বিভিন্ন দেশের সাধারণ জনগণের মধ্যে বিরূপ মনোভাব তৈরি হতে শুরু করে। ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডের জন্য দেশটির ঘনিষ্ঠ মিত্র রাষ্ট্রের সরকারগুলো বিপাকে পড়ে যায়। ৫০ হাজারেরও অধিক সংখ্যক মানুষ এ গণহত্যায় প্রাণ হারিয়েছে, যাদের অধিকাংশই ছিল নারী ও শিশু। এ ঘৃণ্য হত্যাযজ্ঞের সাফাই গাওয়া বা এর যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা দেওয়া এখন ইসরায়েলের বন্ধুদের জন্য অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাজ্যের মতো কিছু দেশ ইসরায়েলের ওপর আংশিক অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। তবে আবার ফ্রান্সের মতো কিছু দেশে সাধারণ নাগরিকদের ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে দেওয়া হচ্ছে না, যদিও সরকারের পররাষ্ট্রনীতি মোতাবেক তারা সবাই যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে। এসব কারণে পশ্চিমা বিশ্বে ইসরায়েলপন্থি প্রচারণা ক্রমেই অসংলগ্ন হয়ে পড়েছে।
যুদ্ধের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অধীনে আমেরিকার সরকার ইসরায়েলের প্রতি অটল সমর্থন বজায় রাখে। তবে স্বল্প সময়ের মধ্যে ইসরায়েল তার পরিকল্পিত লক্ষ্য অর্জন করতে ব্যর্থ হলে, তাদের প্রতি বাইডেন প্রশাসনের প্রকাশ্য সমর্থন ধীরে ধীরে শিথিল হতে থাকে। ইসরায়েলের ওপর কোনো জোর চাপ প্রয়োগ না করলেও, তিনি ২০২৪-এর মাঝামাঝি সময়ে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান। নভেম্বর মাসের নির্বাচনে বাইডেনের ডেমোক্রেটিক পার্টির হেরে যাওয়ার পেছনে ইসরায়েলের প্রতি ঢালাও সমর্থন একটি অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
এরপর দ্বিতীয় দফায় আগমন ঘটে ডোনাল্ড ট্রাম্পের। ফিলিস্তিনের পাশাপাশি লেভান্ত অঞ্চলের অন্যান্য রাষ্ট্র যেমন লেবানন, সিরিয়া প্রভৃতি দেশকে নিয়ে ইসরায়েলের পরিকল্পনা ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যপ্রাচ্য নীতির সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে বলে ধারণা করেছিলেন নেতানিয়াহু এবং তার সমর্থকরা। ওয়াশিংটনকে ব্যবহার করে তারা ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানো, গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক উৎখাত করা, ইয়েমেনের হুতি গোষ্ঠীর শক্তি খর্বকরণ, সিরিয়ার ভৌগোলিক বিভাজন—এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল। আর এর জন্য যেন নিজেদের বড় রকমের কোনো ক্ষতি না হয়, সেটা নিশ্চিত করার জন্য তারা আমেরিকার সহযোগিতার অপেক্ষা করছিল। প্রাথমিকভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্প এ পরিকল্পনাকে সমর্থন দেন। তিনি ইসরায়েলকে পূর্বের থেকে অধিক শক্তিশালী বোমা সরবরাহ করেন, ইরানকে সরাসরি হুমকি দেন, হুতিদের বিরুদ্ধে চলমান অভিযান জোরদার করেন এবং গাজার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দখল ও সেখানকার জনসংখ্যাকে উৎখাত করার ব্যাপারে স্পষ্ট আগ্রহ প্রকাশ করেন।
তবে শেষ পর্যন্ত নেতানিয়াহুর প্রত্যাশাগুলোর সম্পূর্ণ বাস্তব রূপান্তর ঘটেনি। তার আশা এবং প্রতিশ্রুতিগুলো অপূর্ণই রয়ে গেছে। এ কারণে বিশেষজ্ঞরা কেউ কেউ প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন যে, ট্রাম্প কি ইচ্ছাকৃতভাবেই নেতানিয়াহুকে বিভ্রান্ত করেছিলেন, নাকি পরবর্তীকালে লাভ ও লোকসানের হিসাব কষে নিজের অবস্থান ও সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ফেলেছেন? এ দুটোর ভেতরে দ্বিতীয়টাই বেশি গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়। ইরানকে ভয় দেখানোর প্রচেষ্টা কার্যত নিষ্ফল প্রমাণিত হয়েছে। তবে পরে ওমানে এবং ইতালির রোম শহরে তেহরান ও ওয়াশিংটন ডিসির মধ্যে কূটনৈতিক বৈঠকের আয়োজন করা হয়।
হুতিদের তৎপরতার কারণে চলতি মাসে ইয়েমেনে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক অভিযান শিথিল করতে বাধ্য হয়। গত শুক্রবার মার্কিন সামরিক বাহিনী ঘোষণা করে, এ অঞ্চল থেকে তারা হ্যারি এস ট্রুম্যান বিমানবাহী জাহাজটি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। অন্যদিকে ইসরায়েলের অনুপস্থিতিতে গত সপ্তাহে হামাস এবং ওয়াশিংটন ডিসি একটি সমঝোতার চুক্তি ঘোষণা করে, যার আওতায় মার্কিন-ইসরায়েলি নাগরিক এডান আলেকজান্ডারকে মুক্তি দেওয়ার ব্যাপারে সম্মত হয় হামাস।
এ নাটকীয় পালাবদলের চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে যখন ট্রাম্প গত সপ্তাহে রিয়াদে অনুষ্ঠিত একটি মার্কিন-সৌদি বিনিয়োগ ফোরামে ভাষণ দেন। সেখানে তিনি আঞ্চলিক শান্তি ও সমৃদ্ধির পক্ষে কথা বলেন, সিরিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেন এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ় করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এ নতুন নকশায় যার উপস্থিতি লক্ষ করা যায়নি, তিনি হলেন নেতানিয়াহু।
তবে এ পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে নেতানিয়াহু যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, তার জন্য বরাবরের মতো গাজাকেই মূল্য দিতে হয়েছে। গাজার হাসপাতালগুলোয় আক্রমণ চালিয়েছে ইসরায়েল, বিশেষ করে নাসের ও ইউরোপীয় হাসপাতালে চিকিৎসারত রোগীদের লক্ষ্য করে। এমনিতেই এ অঞ্চলের মানুষ নিরুপায়, তদুপরি সবচেয়ে অসহায় মানুষগুলোর ওপর এ নিষ্ঠুর হামলা চালিয়ে নেতানিয়াহু ওয়াশিংটন ডিসি ও আরব বিশ্বের নেতাদের এ হুঁশিয়ারি দিয়ে দিলেন যে, তাদের নীতির পরিবর্তন হলেও ইসরায়েলের নীতির কোনো পরিবর্তন হবে না।
আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রাঙ্গণে ইসরায়েলের সমর্থন ক্রমাগত কমে চলেছে, তাই শক্তি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে নেতানিয়াহু সামরিক অভিযানে নতুন মাত্রা যুক্ত করতে উদ্যত হয়েছেন। এ বর্ধমান উত্তেজনার কারণে ফিলিস্তিনে প্রাণহানির সংখ্যা বিপজ্জনক হারে বেড়ে চলেছে। এর সঙ্গে দেখা দিচ্ছে তীব্র খাদ্যসংকট। অনেক জায়গায়ই দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে, যার জন্য ভুক্তভোগী হতে চলেছে প্রায় ২০ লাখ মানুষ।
বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু কতদিন ক্ষমতায় থাকবেন, তা নিশ্চিত হয়ে বলা মুশকিল। কিন্তু একটা বিষয় নিশ্চয়তার সঙ্গে বলা যায়, সেটা হলো যে, তার ব্যক্তিগত রাজনীতির ভিত্তি ক্রমাগত নড়বড়ে হয়ে চলেছে। নিজের দেশের অভ্যন্তরে তিনি ব্যাপক বিরোধিতার সম্মুখীন হতে শুরু করেছেন। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও তার নিন্দুকের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। তার প্রধানতম মিত্র যুক্তরাষ্ট্রও ইসরায়েলবিষয়ক নীতিতে পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে যেন আসন্ন সময়ে নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটতে চলেছে। আশা করা যায় যেন একই সঙ্গে ইসরায়েলের ধ্বংসাত্মক নীতিগুলোরও সমাপ্তি ঘটে।
লেখক: সাংবাদিক, লেখক ও ‘দ্য ফিলিস্তিন ক্রনিকল’ পত্রিকার সম্পাদক এবং ‘সেন্টার ফর ইসলাম অ্যান্ড গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স’-এর জ্যেষ্ঠ গবেষক। নিবন্ধটি আরব নিউজের মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন অ্যালেক্স শেখ
মন্তব্য করুন