বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমার সাম্প্রতিক পদত্যাগ বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিতে গভীর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। এটি শুধু একটি প্রতীকী সিদ্ধান্ত নয়, বরং একটি সাহসী অবস্থান—অন্যায়, বৈষম্য এবং গণতন্ত্রের অবনতির বিরুদ্ধে স্পষ্ট প্রতিবাদ। এমন সময়ে, যখন রাজনৈতিক নৈতিকতা দিন দিন দুর্লভ হয়ে উঠছে, তখন উমামার নীতিনিষ্ঠ পদক্ষেপ সব রাজনীতিকের জন্য একটি সতর্কবার্তা।
এ ঘটনাটির তাৎপর্য অনুধাবন করতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে বিগত দশকের রাজনৈতিক পটভূমিতে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন ছিল একচেটিয়া ও বিতর্কিত। দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি সেই নির্বাচনে অংশ নেয়নি, কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল, রাজনৈতিক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। ফলে প্রায় অর্ধেক আসনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়।
এই একতরফা নির্বাচন ছিল দেশের গণতান্ত্রিক ধারার জন্য একটি ভয়াবহ আঘাত। নির্বাচনের পর দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। গুম, অপহরণ, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের দমনপীড়ন ছিল সাধারণ ঘটনা। মৌলিক অধিকার এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ভয়াবহভাবে সংকুচিত হয়।
২০১৪ সালের এ নির্বাচন ছিল একটি ভয়ংকর দৃষ্টান্ত—যেখানে জনগণের রায় ছাড়াই ক্ষমতায় টিকে থাকার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। দুঃখজনকভাবে, এ ভুল শোধরানো তো হয়নি বরং ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে তা আরও গভীরভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ নির্বাচনগুলোতেও ব্যাপক কারচুপি, ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, বিরোধী প্রার্থীদের হয়রানি এবং প্রশাসনিক যন্ত্রের অপব্যবহার ছিল স্পষ্ট।
এই একতরফা নির্বাচনের ধারাবাহিকতা শুধু বিরোধী দলের জন্য নয়, বরং আওয়ামী লীগের জন্য এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের জনগণের জন্য ছিল চরম ক্ষতিকর। জনগণের ভোটাধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে, নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর আস্থা নষ্ট হয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনৈতিক প্রভাবের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে।
সবচেয়ে হতাশাজনক বিষয় হলো, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে থাকা অভিজ্ঞ ও জ্যেষ্ঠ নেতারা এ নিয়ে কোনো প্রতিবাদ করেননি। তারা ক্ষমতার লোভে নীরব থেকেছেন অথবা পরোক্ষভাবে সমর্থন জানিয়েছেন। তাদের এ নীরবতা শুধু গণতন্ত্রের প্রতি অবহেলা নয়, বরং দেশের জনগণের প্রতি এক ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা।
এ প্রেক্ষাপটে উমামা ফাতেমার পদত্যাগ এক সাহসী ও ব্যতিক্রমী ঘটনা। তিনি কোনো সংসদ সদস্য নন, কোনো মন্ত্রী নন, অথচ তার কণ্ঠস্বর ছিল সাহসিকতার, নৈতিকতার এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রতিফলন। তিনি যে আন্দোলনের অংশ ছিলেন, সেই আন্দোলনের নীতির ব্যত্যয় ঘটেছে বলে তিনি পদত্যাগ করেন। এটাই প্রকৃত নেতৃত্বের চিহ্ন।
যদি ২০১৪, ২০১৮ বা ২০২৪ সালের নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের কিছু সিনিয়র নেতা সত্য উচ্চারণ করতেন—যদি বলতেন যে একতরফা নির্বাচন দেশের গণতন্ত্র ও মানুষের জন্য ভয়াবহ—তাহলে হয়তো পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ হতো না। তাদের পদত্যাগ, প্রতিবাদ বা অবস্থান গ্রহণ হয়তো আগামী নির্বাচনের ধারা পরিবর্তন করতে পারত, গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে পারত এবং আওয়ামী লীগকে আরও জবাবদিহির পথে আনতে পারত।
আমি শুধু আওয়ামী লীগের নেতাদের নয়, বরং বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের প্রতি আহ্বান জানাই—আপনারা উমামা ফাতেমার কাছ থেকে শিক্ষা নিন। কোনো দল বা নেতৃত্ব যদি জনগণের স্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্ত নেয়, যদি গণতন্ত্রকে লঙ্ঘন করে, তাহলে আপনাদের দায়িত্ব তা প্রতিহত করা। অন্ধ আনুগত্য নয়, সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোই একজন রাজনীতিকের আসল পরিচয়।
ধরে নেওয়া যাক, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগের নেতারা একতরফা নির্বাচনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। তাহলে হয়তো enforced disappearance, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং বিরোধী কর্মীদের অপহরণের মতো ঘটনা ঘটত না। হয়তো আজ যারা আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক, তাদের ওপর জনরোষ এতটা ভয়াবহভাবে নেমে আসত না।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে নীরবতা মানেই অপরাধের অংশীদার হওয়া। যখন নেতারা স্বার্থে অন্ধ হয়ে পড়েন, তখন তা জনগণের বিশ্বাস ও গণতন্ত্রকে হত্যা করে। অথচ একজন উমামা ফাতেমার মতো মানুষ যখন সত্যের পক্ষে দাঁড়ান, তখন তিনিই হয়ে ওঠেন পরিবর্তনের অনুপ্রেরণা।
উমামা ফাতেমার পদত্যাগ শুধু তার ব্যক্তিগত প্রতিবাদ নয়, এটি একটি জাতীয় চেতনার জাগরণ। এটি একটি তীব্র আহ্বান, রাজনীতিকে মানুষ ও ন্যায়বিচারের পক্ষে ফিরিয়ে আনার আহ্বান। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, নেতৃত্ব মানে শুধু পদ বা ক্ষমতা নয়; নেতৃত্ব মানে নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ ও সত্যকে ধারণ করার সাহস।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন